গল্প - শুভংকর গুহ





খঞ্জর


 ধুলো রাখা যায় না। টোকা দিতে হয়। টোকা দিলে ধুলো উড়ে যায়। আর নাকে সুড়সুড়ি, গন্ধে প্রবল হাচ্চি ...তারপরে সর্দি আর চোখের জলে একাকার, হাহাকারে ব্যতিব্যস্ত। জমানো একটি পালক দিয়ে নাকের ফুটোতে ফেদার টাচ, অনুভূতির মধ্য দিয়ে তুলে আনা স্মৃতির দুপুর ও শব্দহীন চারপাশে ঝিমানো আলোর মন্থর গতি।    

তা ফেললাম।  

কোথায় ? 

পাখির সঙ্গে দেখা হবে, রাস্তা আঁকি নিজে, নিজের মতো করে রাস্তা বরাবর গিয়ে একটা মাঠ, কিছু ঘাস, দিঘি বা পুকুর, ঘাইয়ের দৃশ্য ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাছের চকচকে লেজ সাবধানী মাছরাঙার ভয়ে, সরাসরি গোত্তা, ডানার ঝাঁপ স্থির পুকুরের জলে একটার পর একটা জলের বৃত্ত। বজ্রপাতের আগুনে পুড়ে যাওয়া বা ইলেকট্রিকের তারে ঘষটে যাওয়া মরা পাখি নাকের কাছে তুলে নিলে স্রেফ ধুলোর গন্ধ। সেই গন্ধে বিস্তর সর্বনাশ আছে, নির্জনতা আছে, বখাটে ছেলের ঢিলের দাগ আছে, আছে পাখুয়ার ফাঁদকাঠির ভয়।  

আসছি। 

বলেই পা বাইরে রাখতে গিয়ে খালি বালতির শব্দ দুয়ার টপকানোর গতিতে বাঁধা দিল যেন। একটু থমকে দাঁড়িয়ে, পিছনে ফিরে তাকাতেই সেই আদ্যিকালের ইটের গাঁথনি পরের পর উঠে গিয়ে খসে গেছে, আবার দড়ি খেলার মতো ফাঁস লাগিয়েছে দালান কোঠায়।   

চার শরিকির খুপ্পি বাড়ি, অংশিদারদের জিভের লোল পড়ছে যেন। সে মানে ফটিক, হ্যাঁ বগ্গা উপড়ে যাওয়ার মতো, সারাদিন চৈ চৈ আর মাঠ ভাঙ্গার ব্যামো।         

তল্লাট !!!  

হাতের তালুতে তুলে রাখা, সামান্য বিবরণ, মাটির ও পাকাবাড়ির ছেঁড়া ছেঁড়া বিন্যাস। গাছ গাছালির খাপছাড়া নিসর্গ। ধানমাঠ, নয়ানজুলি, রেল লাইন আর গ্রামের মোড়ে বদ্যি ডাক্তারের চেম্বার, ভবঘুরে নাটকের দল চলে যাওয়ার দাগ, দারোগার জিপ গাড়ি নিয়ে অভ্যাসে নিয়মিত রেকির অন্তরালে কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনার আঁচর। খামারবাড়ি, শাখা ব্যাঙ্কপ্রধানের ছাগল হাঁস  মুরগির ঘুপচি, শ্যালোর ভুট ভুট শব্দ।  

গ্রামীণ ব্যাঙ্কের শাখাপ্রধান পঞ্চানন গোলদার গ্রামের মানুষের কথা রাখলেন। ব্যাঙ্কের শাখা ঘর উড়িয়ে নিয়ে গেলেন চৌপাটির চার মাথায়। কত ঋণ খেলাপির নথিপত্র ও নানা কগজপত্রে ধুলো পড়ে আছে, ফেলতেও পারছেন না। কি যে করবেন ? নিজেই বুঝে ফিরে পেরে উঠছেন না। একবার ভাবছেন ঘুরে আসবেন ফটিকদের বাস্তুভিটা থেকে। 

সেখানে গেলে এই সবের টেনশন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। ব্যাঙ্ক অফিসের বারান্দায় ছাগল উঠে নাদি দিয়ে থেমে যাওয়া বৃষ্টির জমি জল টপকাচ্ছে।    



পঞ্চানন নেমে এলেন, ডাইনে না গিয়ে বাঁয়ে পথ নিলেন, একটু এগিয়ে গিয়ে ভুষোকালির মাঠ, মাঠের ওপাশে বাঁশ ও দরমা এবং চোখা চোখা কাঠের খাঁড়ি, খালের অংশ বিশেষে গোবর নাদি ভেসে ওঠার বুদবুদ, দমবন্ধ করে পার হতে পারলে, বাঁক তারপরে, ফটিকদের বাড়ি।      

পঞ্চানন দাঁড়ালেন উঠোনে, হাঁক দিলেন, অপেক্ষা করলেন অনেকক্ষণ, কিন্তু না ফটিকের কোনো অস্তিত্বই নেই। হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে বাইরের আলো দেখে বুঝতে পারলেন, সময় বোধহয় অনেকটা আলো খেয়ে নিয়েছে। 

পঞ্চানন ঢোঁক গিলল বার কয়েক। গলা শুকিয়ে আসছে। পাতকুয়োর কাছে গেলেন, উঁকি দিলেন, প্রতিদিনের মতো আজকের দিনটিও কুয়োর গভীর জলের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা কালো মেঘ নিয়ে পড়ে আছে। কুয়োর ভিতরে গোলাকার একটি দিন, ঝুঁকে পড়ে জল গলা দিয়ে নামিয়ে, এক মুঠ বাতাসা মুখে ঢেলে দিয়ে মিষ্টি চিবিয়ে নিলেন।    


ফটিক নিজেকে ঘাসের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে, জলা জমির শুকনো অংশে পা মেলে দিয়ে, নিস্পলক তাকিয়ে ছিল, বৈষম্যের খালের দিকে। অনেকক্ষণ পরে ভাবল, বাসা বানানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পায় নি। প্রজননের সময় কি? তাহলে কচিপাতা থেকে সুতো খুঁজে নিক। পাখি আসবে, ঠিক আসবে, সময় করে একবার এসে বাসা বানানোর জায়গা নির্বাচন করে চলে যাবে। মনের মধ্যে ফটিকের অস্থির অস্থির ভাব।     

গ্রাম নেই চারধারে। কোথাও কোনো জনমুনিষের চিহ্ন মাত্র নেই। গঙ্গা ফড়িং উড়ে আসছে। ফটিক নিজের মনে বলল,-- চিঠি লিখে দিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মাতব্বর এহসান মল্লিক এবং বরদারঞ্জন গিরগিটির রূপ ধরে সাধারণ গ্রামীণ শিকার করছে, বারে বারে আলোর উৎসের সঙ্গে রঙ পাল্টে নিচ্ছে। মাতব্বররা এমন করে।      

ফটিক ঘাসের ওপরে গড়াতে গড়াতে এলিয়ে গিয়ে চমকে উঠল শুকনো রক্তের দাগ দেখে। ঘাসের ডগায় রক্তের দাগ দেখে ফটিকের গোটা শরীর শির শির করে উঠল। এ পাশটা ধরে গেলে, পরের ধাপে ভাঙ্গা সিঁড়ির মতো মাটির বাঁধ, টপকাতে গেলে, আগে কয়েকটি খেজুরের গাছ দেখে নিতে হয়, তারপরে হ্যামলিন সাহেবের বাগান বাড়ির টানা দেওয়াল।     

ওখানেই নানা চিহ্ন পড়ে আছে গ্রামসভা ও গ্রামসমিতির ক্ষমতা দখলের জন্য ফাঁস লাগিয়ে চপারের পরের পর আঘাতে খুন ও রক্তের স্রোত ও ছাপ। ফটিক জানত, ওই দিকটায় এমন হয়, সংঘর্ষ হয়, আবার যারা সংঘর্ষ করে, কিছুদিন পরে সব মিলেমিশে একাকার। যেখানকার তরবারি, ভোজালি, পেট্রল বোম, লাঠিসোটা, সব একঘরে থাকে। ওইদিকটায় এমন হয়, হয়ে আসছে,  মাসের পর মাস, ফি বছর আর প্রতিদিন।      

কিন্তু এই দিকটায় তেমন, কিছু ছিল না। ফটিক নিজের ভাবনার সাথে, মিলিয়ে নিয়েছিল এখানকার চারপাশ। ঘাসের ওপরে শুকনো রক্তের দাগ দেখে, এবং মনের ভিতরের অস্থিরতা তাকে অন্তরালে যেন বলে দিল, হ্যাঁ, এইখানে এখন হ্যামলিন সাহেবের পাঁচিল এসে পড়েছে।  

ফটিক এইখানে এসে আলস্যকে আদর করতে করতে, নিজের একান্ত নির্জনতাকে উপভোগ করত। পাখির বাসা দেখত। নেউলের ফোলা লেজ দেখে মাটির দেওয়ালে পোতা দিয়ে চুনকামের সাদা বিস্তার দেখে ভাবত, পশুর সব আচরণের সঙ্গে কোথায় যেন মানুষের আচরণের মধ্যে অনুকরণ আছে।   

খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে এক অশরীরী, এসে উপস্থিত হয়েছে যেন। কয়েকটা কালো কুচকুচে ভামবিড়াল রক্তচক্ষু নিয়ে ফটিকের দিকে তাকিয়ে ক্ষণেক নিঃশ্বাস নিল, ক্রোধে ফুঁসছে। ফটিক ঘাসের আস্তরণ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, জমির ওপরে একপ্রকার হলুদ পড়ে গেল।  

এতবছর ধরে ফটিক এখানে আসে, নিজের মতো নিজে সময় কাটিয়ে ভাঙ্গা চাঁদ পানসিটোলার মাথায় উঠে এলে, নিস্পলক তাকিয়ে হেঁটে চলে যায়, ফিরে যায় বাসার দিকে। সে প্রতিদিন যে ভাবে রেখে যায়, সবকিছু ফিরে পায় পরের দিন। সবকিছুই একই ভাবে থাকে, ঘাসের মাঠ, পুকুর। সরে যাওয়া ফালি পথ। ভাঙ্গা মাটির বাড়িগুলি দূরে দূরে, এখান থেকে দেখা বিদ্যালয়ের ছবি। ধানকল অবিকল।   

কিন্তু আজকে ফেরার সময় সে বুঝতে পারল, এই মহাজাগতিক জীবন্তগ্রহে সামান্য বিন্দুর মতো গ্রামটি, তার প্রতিদিনের ছবি থেকে সরে গেছে। ঘাসে ঘাসে রক্তাক্ত হত্যার চিহ্ন। টেনে হিঁচড়ে লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে ডোবার ধারে। কেমন একপ্রকার পচা লাশের গন্ধ ভেসে উঠছে। পশু এবং মানুষের লাশ পচে গেলে গন্ধ একই থাকলেও, গন্ধের অনুভব চিনিয়ে দেয় পশু  ও মানুষের গন্ধের পার্থক্য। গন্ধটা ক্রমশ জীবন্ত হয়ে উঠছে। বোধহয় শেয়াল কিম্বা খাটাশ পচা লাশের মাংস খুঁড়ে খুঁড়ে ঘাটাঘাটি করছে।  

এক ঝাঁক পাখি আদিম গড়ন, পালক নেই, শুধু বাদামি মাংসল আবরণে, কুৎসিত কুৎসিত চেল্লাতে চেল্লাতে উড়ে গেল আতঙ্কিত হয়ে। চারপাশের নিসর্গে ও চরাচরের রঙ বদলে যাচ্ছে। ফটিক চলতে চলতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। মুখ থুবড়ে, পেটের ভিতর থেকে গুলিয়ে উঠছিল, ওয়াক থুঃ। ওয়াক থুঃ।   

সে বুঝতে পারছিল তার শরীরের ভিতরে থেকে উগরে আসছিল পচা মাংসের গন্ধ। ফটিক বারে বারে উঠতে চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। বারে বারে প্রতিবার, একই ভাবে। কিন্তু পারল না, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতে পারল না। আধশোয়া অবস্থায় বমি করল বার কয়েক, ঘাসের ওপরে শুকনো রক্তের ছোপগুলি তাজা তরল হয়ে উঠল। ফটিকের হাত চলে গেল তাজা রক্তের দাগের ওপরে। একপ্রকার উষ্ণ অনুভবে, সে কাঁত হয়ে পাশে ফিরে সান্ধ্য আকাশের দিকে তাকিয়ে উঃ উঃ উঃ উফফ করে উঠল, আকাশ থেকে নেমে আসছে তার দিকেই আগুনের গোলার মতো একটি খণ্ড। উল্কা খণ্ড। এ মহাকাশের খেয়াল।    


ভোরের বেলায় আলো পরিষ্কার ফুটে উঠল, লতানো রোদ মাঠের বালি খুঁড়ছিল। ফটিক উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু দাঁড়াতে গিয়ে দুইবারই পড়ে গেল। আবার উঠে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকল। মাঠ পার হয়ে, খালপোল নিল। যতই ফটিক এগিয়ে যাচ্ছে, ততই তার বাসাবাড়ি পিছিয়ে যাচ্ছে। যতই হাঁটছে অনুমানে সে বুঝতে পারছে, পথ দীর্ঘ হয়ে উঠছে। আর কিছুটা গেলেই সামনে বিভোর বাজার। সকালের দিকে চতুর দাড়িপাল্লাবাজেরা আসে, আনাজপাতি বোঝাই করে। ফটিক চাইছিল অন্য পথ ধরে, ফিরে যেতে। কিন্তু একটি পথকেও আজ তার নির্জনতর পৃথবীর একটি পথ মনে হচ্ছিল না।    

নিজের হাঁটার গতিকে মন্থর করে, অনেকটা ভুমধ্যসাগরের অজানা দ্বীপের বাতাসের মতো নিজেকে অলস করে তুলল। হাঁটতে হাঁটতে তার শরীর কেমন গুলিয়ে উঠছিল। মুখের ভিতরে দলা দলা থুতু উঠে আসছিল। কাছে এসে দেখতে পেল চৌপাটির মোড়ে তার প্রাণবন্ধু পঞ্চানন গোলদাররে ব্যাঙ্ক অফিসের বারান্দায় দুটি মহিষকে কেটে আঙটার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ কী বিচিত্র দৃশ্য। ফটিক বুঝতে পারল, চারদিকে কেমন যেন দৃশ্যগুলি ভেঙ্গে যাচ্ছে।     

কখন যে, সে তার বাড়ির বারান্দায় এসে বসেছে বুঝতেই পারে নি, যা কিছু ঘটে যাচ্ছে, তার চেতনের বাইরে। নিজের মধ্যে আর সে নিজে নেই। নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে দেখতে থাকল উঠোনে নানান জাতের ফুলগাছের নিচে ছড়িয়ে আছে বিচিত্র সব মাটির পুতুলের ভাঙ্গা অংশ। সব মনিষীদের পুতুল, ফেরিওয়ালা কোমর ভেঙ্গে পড়ে আছে। লাঙ্গল কাঁধে কৃষক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সাইকেলচারি পুতুল ব্যালান্স হারিয়ে কাঁত হয়ে পড়ে আছে। উঠোনের ফুল গাছগুলি দুমরে মুছরে দিয়েছে কেউ কোনো এক নিষ্ঠুর ঘাতক। 

ফটিক কয়েকবার ডাক দিল,- ও দিলু, দিলু তোরা সবাই কোথায় গেলি ? কাউকে দেখছি না যে ? এক গিলাস জল দে তো।  

পঞ্চানন গোলদার সাইকেল থেকে নেমে ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে হাজির ফটিকের সামনে। হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, তারপরে হি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল,-খঞ্জর খঞ্জর খঞ্জর......   

চিত্র - শ্রীহরি

Comments

  1. খুব ভাল লাগল গল্পটি। অনবদ্য

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ একটা গল্প অদ্ভুত জীবনের ছড়াছড়ি। তবে বহমানতায় রক্ত আছে।

    ReplyDelete
  3. খুব ভাল একটি গল্প।

    ReplyDelete

Post a Comment