রম্যরচনা - সুনৃতা মাইতি


স্বর্গে ধুন্ধুমার


কৈলাসের রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুনীল আকাশে শারদীবার্তার সুস্পষ্ট উদ্ভাস। মৃদুমন্দ সমীরণ বইছে। বর্ষার শেষে মেঘরাজি শ্বেতশুভ্র বর্ণ ধারণ করেছে। এক স্বপ্নলালিত আবেশ জড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে। অহো! শরৎকাল আগতপ্রায়। কৈলাসের প্রকৃতি অপরূপ রূপ ধারণ করেছে। চারিদিক পারিজাতের সুগন্ধে বিভোর। একখণ্ড শ্বেতশুভ্র ক্ষুদ্র মেঘখণ্ডের ওপর পা রেখে উড়ে চলেছেন দেবর্ষী নারদ। তিনি বায়ুপথে বিহার করতেই ভালোবাসেন। কৈলাসের মাটিতে পা রাখতেই নারদ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন...


 "নারায়ণ! নারায়ণ! ইতনা সন্নাটা কিউ হেয় ভাই!"


পরক্ষণেই জিভ কেটে নিজেই নিজের মাথায় একটা চাপড় মারলেন। কী যে হয়েছে আজকাল! ভুলো হয়ে যাচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। কৈলাসে তো কড়া লকডাউন চলছে। হাইলি কন্টেন্টমেন্ট জোন বলে কথা ! তা গোলটা হল গিয়ে ওই প্রথমপূজ্য গণশার জন্য। এবার মর্ত্যে  না গেলে কি তার  চলত না! না। সে ব্যাটা গণেশ চতুর্থীর অপেক্ষায় হাঁ হয়ে বসে থাকে বছরভর। বছরে  দু দুবার মামার বাড়ি যাওয়া !  তো যাবি তো স্যানিটাইজার আর মাস্কটার ব্যবহার কর! সঙ্গে নিয়ে যা। তা নয় শুঁড় দোলাতে দোলাতে চলল ব্যাটা। বলে কি না,


"হাতি ঘোড়া গেল তল, করোনা বলে কত জল ! ফু্ঃ! "


 তবে গণশার  জন্য মাস্ক বানানটা হেবি চাপের ব্যাপার। পুরো শুঁড়টি  কাভার করা চাট্টিখানি কথা বাপু! তার উপর আবার অন্তত থ্রি লেয়ার না থাকলে মাস্ক কোনও কম্মের না। গণু মর্ত্যে গেল হুড়মুড়িয়ে, কদিন নানা রকম লাড্ডু- মেওয়া সেবন করল আর সটান করোনা নিয়ে হাজির হল দেবলোকে।  গণু  মহাশক্তিধর! তাঁকে কাবু করা কি যে সে ব্যাপার! সে তো অ্যাসিম্পোটোম্যাটিক। কিন্তু তারপর  ধাঁ ধাঁ করে করোনা ছড়িয়ে পড়ল কৈলাশ সহ পুরো স্বর্গে। প্রথমদিকে তো শিবের সাঙ্গপাঙ্গরা কেশে কেশে অস্থির! সমবেত কাশীর শব্দে কৈলাস  থরহরিকম্পমান। এমনিতেই হার্ড জিনিস টেনে টেনে ফুসফুসের অবস্থা তো কৈলাসের কারোরই খুব একটা সুবিধের নয়! হেঁ হেঁ! তাঁরা আবার ডুবে ডুবে ডুবি টানে। মর্ত্যে তো এখন প্রিয়াকাণ্ড  ও খেপাব্লিক টিভির সৌজন্যে আপামর জনসাধারণও ওই সব তুরীয়ানন্দের ঠিকুজি কুষ্ঠি জেনে গেছে। মর্ত্যবাসীগুলোরও বলিহারি! কিছুই কি আর স্বর্গ - এক্সক্লুসিভ থাকতে দিবিনা তোরা! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন নারদ। বলে ওঠেন...


“নারায়ন! নারায়ন!”




কৈলাসে এমন পিন ড্রপ সাইলেন্স নিতান্তই বেমানান। শিবুচন্দ্রর সাঙ্গপাঙ্গদের হট্টরোল আর আমোদে কান পাতা দায় হয়  অন্যসময়ে। তার উপর আছে ওই নন্দী বুল! ইদানীং স্বর্গকে সরা জ্ঞান করে সে। মর্ত্যে তো তাদেরই রবরবা চলছে ইদানিং।  নন্দী আজকাল "পিসিকে পেলেই গুঁতিয়ে দেব" মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ব্যাটা অবশ্য এখন করোনাসুরের কৃপায় আইসোলেশনে। তা সে যা হোক, এমন অপূর্ব শোভাময়  নিস্তব্ধ কৈলাসে পা রেখে নারদের ভিতরের কবি  চাটুজ্জে জেগে উঠলেন। শিবুচন্দ্রর গৃহের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নারদ বলে উঠলেন...


 “নারায়ণ! নারায়ণ!


দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে কৈলাশ পাড়া! হঠাৎ  শোনো নারদের কড়া নাড়া। শিবুদা বাড়ি আছেন?”


 শেষোক্ত  লাইনটিতে খানিক উচ্চস্বরের প্রয়োগ করলেন নারদ।


শিবুচন্দ্রের বাড়িতে মেজাজমর্জি কদিন ধরে কারোরই বিশেষ ভালো নেই। শিবুচন্দ্রর মন খারাপ। বছরে কটা দিন মাত্র গুষ্টির থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়; এ বছর মনে হচ্ছে সেটাও হবে না। ভেবেছিলেন চারটে দিন চুটিয়ে সর্গফ্লিকস দেখবেন আর ইয়ে পার্টি করবেন। সে গুড়েও বালি ! দুর্গাগিন্নির বাপের বাড়ি যাওয়া এবার অনিশ্চিত। ছেলেপুলেগুলোও শোকে মুহ্যমান। তার ওপর আবার সরস্বতীর ইউনিভার্সিটি  যাওয়া বন্ধ। কাতুর প্রজেক্ট অসম্পূর্ণ  অবস্থায় ঝুলে আছে। লক্ষ্মীটা কতদিন বাপের বাড়ি আসতে পারছে না। তাই গাত্রোত্থান করে কেউই দরজা খোলার বিশেষ উদ্যোগ দেখাল না। এমতাবস্থায় গণশাকেই উদ্যোগী হতে হয়। এমনিতেই ফরেন ল্যান্ড থেকে করোনার জার্ম ক্যারি করে নিয়ে এসেছে বলে স্বর্গ বাজার আর স্বর্গ আজকাল পত্রিকাগুলোতে কম লেখালিখি হয়েছে তাঁকে নিয়ে! কম হেনস্থা হয়েছে শিবুচন্দ্র অ্যান্ড কোং? এই সব কারণে গণশা আজকাল সবিশেষ চাপে আছে। সে জানলা খুলে ভুজিয়া চিবোতে চিবোতেই নিরীহ মুখে প্রশ্ন করল...


 “কৌন হৈ? ইয়ে... রসোরে  মে কৌন হৈ? না না.. দরবাজে পে কৌন হৈ?”


  “আমি নারদ হে  প্রথমপুজ্য। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের নিয়ন্ত্রক  শিবুদার সাক্ষাৎ  প্রার্থনা করি।” 


নারদ গলা তুলে বলেন। এদিকে ডাইনিং রুম থেকেই নারদের গলা শুনেই প্রমাদ গুনলেন দুর্গা। শিবুর সামনে নারদকে দাঁড়  করালেই বিপদ! নারদ অতি সাংঘাতিক! কথায় কথায় শিবুর পেট থেকে পরিবারের  সব কথা বের করে নেবে। কী গেরো রে বাবা! শরীরটা ইদানীং ভাল যায় না দুগ্গার।  কথায় কথায় মুড সুইং হয়। হট ফ্লাশ তো আছেই। ইদানীং খুব ঘনঘন চণ্ডিকা রূপ ধারণ করেন তিনি। অতশত ভদ্রতা  বজায় রেখে কথা বলার মতো ধৈর্য্য  থাকে না মাঝে মাঝে। তবুও তিনি  দরজায় হাজির হয়ে  বিরস বদনে বললেন...


 “লকডাউনের মধ্যে টোটো করে ঘুরে বেড়াতে লজ্জা করে না আপনার? বুড়ো হয়েছেন বাতাসে। কথা নেই, বার্তা নেই চলে আসেন মু উঠাকে। শিবুদা বিজি আছেন। যা বলার আমাকে বলুন। আর ইয়ে মাস্ক পরেননি কেন?"


 বিনীত মুখে নারদ বললেন...


 “মা জননী আমি  অন্তরীক্ষ পথে পরিভ্রমণ করি?  আমার মাস্কের কি দরকার?”


খেঁকিয়ে উঠে দুর্গা বলেন...


 “জলে- স্থলে -অন্তরীক্ষে যে চুলোতেই থাকুন বাইরে বেরোলে  সব সময় মাস্ক পরবেন বুঝলেন!”


 না, নারদ রেগে যান না সহজে। বা রেগে গেলেও তার হাবেভাবে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে দেন না। তিনি ঘাগু প্রাণী। মনের ভাব মুখে প্রকাশ করেন না। বৈষ্ণববিনয় বিজড়িত মুখে তিনি বলে ওঠেন...


 "নারায়ণ! নারায়ণ! পরব মা। তবে আমার আসা অমূলক নয়। কথা আছে, বার্তাও আছে। জরুরি বিষয়। শিবুদার হোয়াতে মেসেজ পাঠিয়েছেন দেবরাজ। শিবুদা সিন করেননি। সিন করলেও অবশ্যি আসতে হতো। শিবুদা আলাভোলা মানুষ। সব ভুলে মেরে দেন। তাছাড়া ত্রিদেবকে  সাক্ষাতে খবর দেওয়াটাও তো পরম ধর্ম আমাদের। তা মা জননী, পরিবার  ভালো আছে তো? এই লকডাউন দেখে আপনার বাপের বাড়ির সেই গুড ওল্ড দিনগুলোর কথা মনে পরে। যখন দুদিন বাদে বাদেই ধর্মঘট আর চাক্কা জ্যাম হয়ে কর্মসংস্কৃতির বাম্বুইং হত...হে! হে!"


 শুনেই  দুগ্গার পিত্তি জ্বলে গেল। তিনি বিরক্ত মুখে বল্লেন...


“হ্যাঁ, সব ভালো। ভ্যানতারা না করে আপনি পয়েন্টে আসুন দেবর্ষি। মেলা কাজ পড়ে আছে ঘরে। দেবরাজ কী খবর পাঠালেন ?”


 “কাল স্বর্গধামে একটি  ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে মা জননী। স্বর্গগুল মিট অ্যাপটা ডাউনলোড করা আছে তো? আপনাদের নম্বরে লিংক পাঠিয়ে দেওয়া হবে কাল সকালে। ইভনিং  সাতটায় অতি অবশ্য মিটিং জয়েন করবেন কিন্তু সবাই।”  


 দুগ্গার শুভ্র কপালে এবার সত্যিই দুশ্চিন্তার রেখা দেখা যায়। তার ঘামে ভেজা সুডৌল সুন্দর মুখে ছায়া নেমে আসে। সত্যিই কি করোনা দেবলোকে চরম অব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে? হায় মানুষ! তোমাদের কয়েকজনের অপরিণামদর্শিতার আর অবিবেচনার ফল কি মারাত্মক! স্বর্গ, মর্ত্য কিংবা পাতাল... বোধহয়  কাউকেই ছেড়ে কথা কইবেনা  এই করোনা।



নারদ বৈকুণ্ঠলোকে পৌঁছে একটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কৈলাস হয়েই ব্রহ্মলোকে গিয়েছিলেন। সেই  বুড়ো হা তেএঁটে। ব্রহ্মাবুড়ো একবার ধরলে ছাড়তে চান না। সরস্বতীর সর্বপ্রকার খবর চাই তাঁর। এদিকে দুগ্গা গিন্নির যা মেজাজ দেখা গেল কৈলাসে; তাতে ওই ফ্যামিলির খবর সংগ্রহ করা মুশকিলই হি নেহি, না মুমকিন। তিন মাথা নাড়িয়ে বুড়ো ব্রহ্মা চুক চুক করে আক্ষেপ করছিলেন.. 


"মেয়েটা যে কী করল! কিছুতেই আমার আন্ডারে পি এইচ ডি টা করতে রাজি হল না। স্বর্গমান ইউনিভার্সিটিকে পাত্তাই দেয় না। খালি মাধবপুর আর ওই মে এন ইউ।" 


এদিকে বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মীর মনমেজাজ বিশেষ ভালো না। বিষ্ণুবাবুর সাথে নিত্য খিটিমিটি লেগে আছে। প্রতিবার একটা প্রলম্বিত সময়ের জন্য লক্ষ্মী মর্ত্যে  যান। এ বার সেটা অনিশ্চিত। বিরক্ত বিষ্ণু লক্ষ্মীকে বোঝাচ্ছিলেন...


“বলি  ধরায় গিয়ে লক্ষ্মীশ্রী উপাধিটা খাতায়কলমে না নিয়ে আসা পর্যন্ত তোমার স্বস্তি নেই গো? এ বারের মতো না হয় ছাড়ো। তাছাড়া দেবরাজ ইন্দ্র এবার কিছুতেই মর্ত্যে আমাদের কারোর  যাবার সপক্ষে না।এই নিয়ে  লাস্ট স্বর্গ অধিবেশনে কম  কথাচালাচালি হয়নি।” 


লক্ষ্মী গম্ভীরমুখে শেষনাগের লেজে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। শুনেই  বেজার মুখে  বললেন... 


"তুমি যে জন্মাষ্টমীতে ঘুরে এলে সেই বেলা!  নিজের বেলায় আঁটিশুটি, পরের বেলায়  চিমটি কাটি!  জানোই তো মা চলে এলেও আমি মর্ত্যে স্টে করি আরও আট নয় দিন। ধরাধামের লোকেরা কোজাগরী পূর্ণিমার অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে সারা বছর বসে থাকে। ধরায় এমনিতেই গ্লোবাল ইকোনমির চরম বিপর্যয় চলছে। দেশে জিডিপি মাইনাসে রান করছে। আমি গিয়ে হাল না ধরলে হবে? আর বাইদা ওয়ে আমার ইনস্টার ফলোয়ার কত ডিক্রিস করেছে  তার কোনো আইডিয়া আছে তোমার? "


এমন সময় নারদ  বিষ্ণুবাবুর  সমক্ষে উপস্থিত  হলেন  বারতা নিয়ে।



স্বর্গগুল মিটে মিটিং শুরু হয়েছে সবে। দেবরাজের অবশ্য ইচ্ছে ছিল দেবজাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেবার। ত্রিদেবের ভয়ে সেটা সাহসে  কুলোয় নি। অতএব আপামর স্বর্গবাসী সম্প্রদায়ের গুটিকয়েক প্রতিনিধি নিয়ে মিটিং করাটাই বিধেয় বলে মনে হল তার। মিটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে স্বর্গবাসী প্রতিনিধিরা মিট প্রকোষ্ঠ থেকে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছেন দেবরাজ ইন্দ্রের দিকে। কিছু দেবী -দেবতা প্রতিনিধির সাথে হাজির গন্ধর্ব, কিন্নর অপ্সরী এবং যক্ষ-যক্ষিণী প্রতিনিধিরাও।  গলা খাঁকারি দিয়ে ইন্দ্র শুরু করলেন...


"বিগত কয়েক যুগে এই রকম বিপদ স্বর্গে আসেনি। ওই ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট মানুষ, যাদের কল্যাণে আমরা সততই উপুড়হস্ত, তাঁরা এই রকম একটি ভয়ানক ভাইরাস ম্যানুফ্যাকচারিং করে সমগ্র সৃষ্টিকে একটি প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই বলছি ওই অপদার্থ মানব গোষ্ঠীকে আজ থেকে বয়কট। আমরা এখন থেকে আত্মনির্ভর স্বর্গ গড়ে তুলব। দেবতাদের  মর্টালিটি নেই বলে রক্ষে। কিন্তু  স্বর্গের ঘরে ঘরে জ্বর আর কাশিতে বেহাল অবস্থা। কত দিন আর কোয়ারান্টাইন আর আইসোলেশন চলবে  বলতে পারো বন্ধুরা? আমোদ আহ্লাদ বন্ধ। নৃত্যগীত বন্ধ। ক্রীড়া, প্রমোদ- ভ্রমণ সব বন্ধ।তাই  আজ থেকে আমরা কেউ মর্ত্যে যাবনা, মর্ত্য থেকে পুজোও নেবনা আনটিল এবং আনলেস করোনা বিদায় নিচ্ছে।"


“তা কি করে হয় দেবরাজ ! মানুষরা আহুতি আর নৈবেদ্য না দিলে আমাদের অস্তিত্বই তো বিপন্ন হয়ে পড়বে।”


চিন্তাগ্রস্ত মুখে অগ্নিদেব অডিও অন করে বলেন। তার ভিডিও কোয়ালিটিও দুর্দান্ত! তাকে ব্যাপক দেখাচ্ছে।


“তাই তো আত্মনির্ভর দেবলোকের অ্যাজেন্ডা সকলের কাছে রাখছি”। 


 বলতে বলতে  দেবরাজ কান  চুলকে নেন।


“ঠিকই তো ...ঠিকই তো। তাছাড়া স্বর্গে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো গিয়ে ইমিউনিটির অভাব।  দেবতাদের অধিকাংশই  ফ্যাট আর কার্বোহাইড্রেড উৎসর্গ করা হয়। প্রোটিন যৎসামান্য। সেটা না পেলে ইমিউনিটি বাড়বে কী করে বলুন তো? আর মানবপ্রেরিত ওই সব ট্যালটেলে ভেজিটেবল প্রোটিনে  কি আর সবরকম অ্যামাইনো এসিড আছে? তাই সেল্ফ ডিপেন্ডেন্সি ইস কল অব দ্য আওয়ার। কিন্তু কথা হচ্ছে এটা হবে কী করে? ”


বলেই বরূনদেব কৌতুহলী মুখে দেবরাজ ইন্দ্রের দিকে তাকান। 


“নো প্রব। ধন্বন্তরি আছেন। আমাদের অশ্বিনীকুমারদ্বয় আছেন। আছেন সপ্তর্ষি। সবার উপরে আছেন ত্রিদেব। তারা একটা উপায় নিশ্চয়ই বের করবেন। এমন কোনও সাধনার নিদান দেবেন যা আমাদের বডির ইমিউনিটিকে বুস্ট আপ করবে। মানবলোকের আহুতি ব্যতিরেকেও আমরা  হেলদি থাকব।” 


দৃপ্ত কন্ঠে বলেন ইন্দ্রদেব।


“হু! সাদনা দেকাচ্ছে! থাকে তো সারাদিন শুয়েবসে আর অপ্সরীদের নিয়ে। সে করবে সাদনা! পোঁদে নাই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি!” 


থুকদানীতে পানের পিক ফেলে সানগ্লাসটা একটু উঠিয়ে দেবী মনসা ফুট কাটেন। কাণি বদনাম ঘোচাতে আজকাল তিনি সর্বক্ষণ সানগ্লাস পরে থাকেন। ভাগ্যে তার অডিও অফ!


“হোল্ড অন ! হোল্ড অন! আপনারা ভেজিটেরিয়ান বলেই এত সমস্যা ইমিউনিটির।  এতে মর্ত্যের মানুষের আর কী দোষ? আপনারা যদি অ্যানিমেল প্রোটিন না খান ইমিউমিনিটি ডেফিসিয়েন্সি তো হবেই। ক্যাটল বা  বার্ডের লাইভস্টক ছেড়ে দিন। অ্যাট লিস্ট আমার মত ফিশটাও তো খেতে  পারেন !”


 দেবী বারাহী অডিও- ভিডিও অন করে বলে ওঠেন।


“ক্যাটল কে বলল বে! নেটটা এত উইক যে সব কথা শুনতে পাচ্ছিনা। তবে ক্যাটল ঠিক শুনেছি। ক্যাটল খাবে কে বে? ” বলেই...


 ডান দিকে তিন নম্বর প্রকোষ্ঠ থেকে হনুমানজি হুঙ্কার দিলেন।


 “তবে রে! এত বড় সাহস! এ বার তো টেম্পল এহি বনায়েঙ্গে। জয়.....”


আর থাকতে না পেরে দেবী মনসা অডিও অন করলেন।


"প্যাঁচাল সৃষ্টি করবার আর সময় পেলেন না হনুমানজী? ডাইভাটেড হয়ে যাচ্ছেন! বুইতে পারচেন না যে ইন্দ্রের গতিক বিশেষ সুবিধার না। আবার কি গোল বাঁদাবে কে জানে। এখন আত্তনিরভরতার কাঁদুনি গাইচে। এ কোনও প্যাকটিকাল পোস্তাব? ৩৪ কোটি কল্প কেটে গেল, স্বর্গের উন্নতিকল্পে কি করেচে ওই মাল! এবার পরিবত্তন আশু পয়োজন।"


অমনি বামদিকের ষষ্ঠ প্রকোষ্ঠ থেকে গান্ধর্বী চিত্রলেখা বলে উঠলেন...


"মনসাদি বলে যান।থামবেন না। হ্যাশ ট্যাগ পাশে আছি। মিটুর বন্যা বইয়ে দেব এইবার স্বর্গে। 

কল্পের পর কল্প ধরে ধ্যাষ্টামো আর ইয়েবাজি চলছে।"


সপ্তম প্রকোষ্ঠ থেকে অপ্সরা প্রতিনিধি স্পন্দনা চেঁচিয়ে উঠলেন....


“আর  নেপোটিজমের তো হদ হয়ে গেছে। কয়েক কল্প ধরে ওই রম্ভা, মেনকা আর উর্বশীকেই প্রিভিলেজ দিয়ে যাচ্ছে।  অমুকের ধ্যান টারমিনেট করা, তমুকের সাধনা ভঙ্গ... সব  কেরদানি মারবে ওরাই! আর আমরা সারা জীবন স্ট্রাগলিং অপ্সরা হয়েই থাকব? ”


“আর দিদি কাস্টিং কাউচ? সেটা তো বল্লেন না..”.


 গান্ধর্বী চিত্রলেখা গলা সপ্তমে তুলে চিৎকার করে উঠলেন। আর অমনি  স্বর্গগুল মিট এর সব কটা অডিও অন হয়ে গেল এবং মিট অচিরেই  ঘন্টা খানেক সঙ্গে ইন্দ্রদেবের বিতর্ক সভায় পরিণত হল।


কী হল্লাগুল্লা রে বাবা! সইতে না পেরে নারায়ণ আকা বিষ্ণুবাবু ভিডিও অফ করে চক্ষু নিমীলন করতঃ পুনরায় অর্ধশায়িত হয়ে গেলেন। ব্রহ্মা তিনটে পপকর্নের বাটি নিয়ে ত্রিমুখে এই তামাশা দেখতে দেখতে মৃদুমন্দ হাস্য করতে লাগলেন। আর শিবুচন্দ্র মোবাইলে স্বর্গ আমার জোনে নতুন বাঘছালের ভ্যারাইটি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুরোনোটার যা শতছিন্ন অবস্থা! নতুন না কিনলেই নয়।


 সব দেখেশুনে দুর্গা প্রবল রাগত হয়ে অনলাইন হুঙ্কার দিলেন। সবাই ধমক খেয়ে চুপ! এ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না যে। রাগলে তিনি মহাকালী হয়ে যান।


“চুপ কর সব অপদার্থের দল! তোদের দৌড় আমার জানা হয়ে গেছে। মর্ত্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে! অত সোজা! মনে রাখিস...


মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই কৃপার পরে করে দেব মহিমা নির্ভর।


 আমাকে বাপের বাড়ি যাওয়ার থেকে আটকাবে কোন বাপের ব্যাটা শুনি! হিম্মত থাকলে সামনে আয়। মারবো এই মিটে; লাশ পড়বে শ্মশানে।  সরো, কাতু, গণশা আর লক্ষ্মী... ব্যাগ আর সমস্ত  অস্ত্রশস্ত্র প্যাক কর। দেখি ওই করোনাসুরের কত দাপট! দুগ্গা থাকতে কি না সৃষ্টি উচ্ছন্নে যাবে !"


 ৫


এদিকে মর্ত্যলোকের একটি ছোট্ট ঘরের বারান্দায় বসে ঠাম্মার কাছে বসে মা দুগ্গার মহিষাসুর বধের গল্প শুনছিল ছোট্ট শালুক। কাল মহালয়া। ঠাম্মা গল্প শেষ করে ছলোছলো মুখে তাকিয়ে বল্লেন...


এ বার কি সত্যিই তুমি আসবে না? তোমার পুজো হবে না মা! 


ছোট্ট শালুক ঠাম্মার গা ঘেষে বলল ...


"কেন হবে না! তুমি বলছিলে না, এ বার দুগ্গামা আসছেন দোলায়। ফল মারি ও মড়ক। আর ফিরবেন গজে। ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। শান্তি আর শান্তি। দেখো, মা এসে সব ঠিক করে দেবেন। করোনাসুরও বিদায় হবে।"


 কপালে  দু হাত ছুঁইয়ে  প্রণাম করলেন ঠাম্মা...


 "তাই যেন হয় মা। তোমার কৃপায় সব বিপদ যেন কেটে যায়।

চিত্র - শ্রীহরি

Comments

Post a Comment