গল্প - কণিকা দাস

সংবর্তন 

টেলিফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলেছে। টুকরো টুকরো ছেঁড়া তারগুলো জোড়া লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন এক প্রৌঢ়া। গোধূলির আলো নিভে গিয়ে সবে চারদিক অন্ধকার হতে শুরু করেছে। দখিনা বাতাসে বাগান থেকে বেলিফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। একটা সময় ছিল যখন এই গন্ধটা পাওয়ার জন্যই সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বসে থাকতেন অতনু বসু আর বিদিশা বসু।


পঁয়ত্রিশ বছর আগে অতনুর সাথে বিয়ে হয় বিদিশার। সেই থেকে সুখেই কাটছিল দুজনের জীবন। পাঁচ বছর পর যখন ছেলে তমালের জন্ম হল তখন সংসারের ঔজ্জ্বল্য যেন আরো বেড়ে গেলো। তারপর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে গিয়ে কোথা দিয়ে যে এত সময় পাড় হয়ে গেল টেরই পাননি। ছেলে বড় হল। কলেজ ছেড়ে এমবিএ-তে ভর্তি হল। অতনুর চাকরির মেয়াদ ফুরলো।

টেলিফোন থেমে গিয়েছিল। আবার বেজে ওঠায় ভাবনার সুতোয় টান পড়ল বিদিশার। বিরক্তিতে মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন বিদিশা। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীরের শেষ শক্তিটুকুও যেন নিঃশেষ হতে চলেছে। আর কতদিন এভাবে চলবে ভেবে পান না। এখন আর কোন স্বপ্ন খেলা করে না মনের ভেতর।

স্বপ্নগুলো তো সেদিনই মরে গিয়েছিল যেদিন অতনুর হার্টঅ্যাটাক হলো আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন অতনু। সেও তো প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। তখন তমাল সবেমাত্র চাকরিতে ঢুকেছে। অতনুর চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি বিদিশা। নিজেকে শেষ করে দেবার একটা জেদ যেন চেপে বসেছিল তাঁর মনে। তমালের সেবা আর ভালোবাসায় আবার সংসারের ফিরে এলেন বিদিশা। নিজেকে তৈরি করে নেন বাবা-মা দুজনের দায়িত্ব পালনে। 

তমাল একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে চাকরি করে। তাকে সময়মতো রান্না করে খাইয়ে অফিসে পাঠানো, অফিসের টিফিন তৈরি করে দেওয়া সব নিজের হাতেই করতে ভালোবাসে বিদিশা।

ফোনটা অনেকক্ষণ বেজে এবার থেমেছে। এখন আর ফোনও রিসিভ করতে ইচ্ছে করেনা। গত সতেরো দিনে ফোন আর আত্মীয়-বন্ধুদের অনুকম্পায় বিধ্বস্ত বিদিশা, বিরক্তও। এখন অবশ্য বন্ধুদের আনাগোনা কমে এসেছে। একদিন হয়তো ফোনটাও আর বেজে উঠবে না। এটাই তো স্বাভাবিক। হৃদয় বিদীর্ণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বিদিশার।

      ---বৌদি, এবার ঘরে চলো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। 

      অনিমা এখন বিদিশার একমাত্র ছায়াসঙ্গী। 

তমালের জন্মের সময় থেকে অনিমা এ বাড়িতে আছে। অতনুদের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে। ভাইদের অভাবের সংসারে স্বামী পরিত্যাক্তা অনিমা ছিল বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো। উঠতে বসতে বৌদিদের গঞ্জনা শুনতে শুনতে একদিন আত্মহত্যার চেষ্টায় পুকুরধারে কলসি নিয়ে বসে। অতনুর দূরসম্পর্কের এক ভাই দেখতে পেয়ে অনেক বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। অতনুর সংসারে তখন সারাক্ষণের জন্য ঠিকে ঝি চাই। সে-ই অতনুদের বাড়িতে পাঠায় অনিমাকে। বিদিশাও যেন হাতে চাঁদ পান। নইলে ছেলেকে একা হাতে সামলাতো কী করে? তখন থেকে অনিমা এ বাড়ির সদস্য  হয়েই আছে। তমাল তো অনিমার কোলেপিঠে করেই বড় হয়েছে।

অনিমার কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বিদিশা। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। এবার বিরক্ত হয় অনিমা। রিসিভারটা তুলে আবার রেখে দেয়। সন্ধ্যা আহ্নিক করার সময় এখন ফোনে কথা বলার সময় নেই।    

সতেরো দিন আগে একটা ফোনই তো বজ্রপাতের মতো মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দিয়ে গেল জীবনের সব হিসেবনিকেশ। বিদিশা তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিলেন। আর অনিমা সকালের রান্নার আয়োজন করে রাখছিল। তার দেখভালও করছিলেন বিদিশা। সকাল আটটায় বের হয় তমাল। তার জলখাবার আর টিফিন বানিয়ে দিতে হয়। রাতে আয়োজন করে না রাখলে সকালে দেরি হয়ে যাবে যে।

টুকটাক কাজ আর গল্পের মধ্যেই ফোনটা বেজে ওঠে। ঘড়ির দিকে তাকান বিদিশা। রাত আটটা বাজে, এখন আবার কে ফোন করেছে? ফোনটা ধরেন বিদিশাই।

      --- হ্যালো কে বলছেন? 

 ওপাশ থেকে ভরাট গলায় কেউ একজন বলেন-- এটা কি তমাল বসুর বাড়ির নাম্বার? আমি থানা থেকে বলছি। তমাল কিছুক্ষণ আগে একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্টে…...। কানের মধ্যে কেউ যেন গরম তরল সীসা ঢেলে দেয়। বাকি কথাগুলো আর কানে ঢোকে না বিদিশার। কোন সাড়া না পেয়ে অনিমা ছুটে আসে।

        --- কি হয়েছে বৌদি? 

জড়বৎ দাঁড়িয়ে থাকা বিদিশাকে ধরতে গেলে নেতিয়ে পড়েন অনিমার কোলে। তারপর থানা পুলিশ লোকজনের আনাগোনা এসবের কিছুই কানে পৌঁছায় না বিদিশার। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তমালের মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে এলে আবারো জ্ঞান হারান বিদিশা। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়িয়ে দেন। 

সাতদিন পর যখন দিল্লি থেকে রক্তিমা আসে তখন তাকে জড়িয়ে ধরেই বিদিশা প্রথম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এই মেয়েটার সাথেই তো এই ডিসেম্বরে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তমালের। ভারী মিষ্টি মেয়ে। যেমন মার্জিত ব্যবহার তেমনি কথাবার্তাতেও। বিদিশাকে কত আপন করে নিয়েছে গত দুই বছরে। বিদিশার নিজের পছন্দ করা মেয়ে। তারপর তমাল আর বিদিশার দুজন দুজনকে চেনাশোনা। এবছর পিএইচডি শেষ হবে সেপ্টেম্বরে। তারপর ডিসেম্বরে বিয়ের দিনক্ষণ পাকা। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বিদিশার বুকের গভীর থেকে। 

অনিমা ঘরের আলো জ্বালিয়ে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছে ঠাকুরঘরে। এসব কাজ এখন অনিমা-ই করে। ঠাকুরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা উঠে গেছে সেদিন থেকেই যেদিন তমাল….। ধুপের গন্ধ এখন বিদিশার কাছে শ্মশানের পোড়া গন্ধ বলে মনে হয়। ফ্রেমে বাঁধাই করা অতনু আর তমালের বড় ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে পলকহীন চোখে 

ফোনটা তখনই আবার বেজে ওঠে। অনিমা ধুপের ধোঁয়া ঘরময় ছড়াতে ছড়াতে ফোনের ওপাশের লোকের গোষ্ঠীর তুষ্টি করতে থাকে। বিদিশা ধীরে ধীরে ফোনের কাছে গিয়ে রিসিভারটা তুলে আস্তে করে নামিয়ে রাখেন টেবিলে। 

তারপর নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দেন বিছানায়।



চিত্র - শ্রীহরি

Comments