ভ্রমণ - দিব্যেন্দু ভৌমিক

ভাললাগার ঠিকানা কুমাই


চালসা থেকে খুনিয়া মোর। আর এরপরই জংগল পথ ধরে এগিয়ে চলা। তিন কিমি পথ পাড় হলেই চাপড়ামাড়ি রিজার্ভ ফরেস্ট এর গেট। এখান থেকে দুপাশের ঘন জঙ্গল পথে গা ছম ছম পরিবেশ ধরে এগিয়ে চলা। যেকোন মুহূর্তেই বেড়িয়ে আসতে পারে বুনো হাতির দল। তবে 'দলহাতি' হলে ব্রেক কষে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে গেলে কোন ভয় নেই। বহু বার ওদের সামনে পড়েছি। কিন্তু বাচ্ছা থাকলে দূরত্ব আরও বাড়াতে হবে। হাতি বা বাইসন একা থাকলে কিন্তু খুবই বিপদজনক! এগিয়ে চলেছি এসব ভাবতে ভাবতে। গাড়িতে আমার মা, স্ত্রী মনামী এবং আমার বাবান -তাতান। "বাবা হাতি আসে না কেনো! ওরা কোথায়?"- প্রশ্ন উড়ে আসে আমার ছোট্ট তাতানের। মনে মনে আমিও ওদের দেখা মিলুক সেটাই চাইছিলাম মাঝে গাড়ির সামনে দিয়ে ডানা মেলে উড়ে গেল একটি ময়ূর। পেখম মেলে দাঁড়িয়ে থাকা ময়ূর বহুবার চোখে পড়েছে। কিন্তু এভাবে ময়ূরের ওড়া দেখিনি এতক্ষণ ধরে। ক্ষিপ্ত গতিতে তিনটি বাইসন রাস্তা পাড় করল। একটু থামলাম। কেননা ওদের দল ৪০ টি বাইসনও থাকে। না। আর এল না। দুপাশ দেখে এগিয়ে গেলাম। চলে এলাম এসএসবি ক্যাম্প ও বস্তি পাড় করে কুমলাই মোড়ে। খুনিয়া মোড় থেকে ১২ কিমি। ডান দিকে চলে গেছে দলগাঁও, জলঢাকা, বিন্দু। আমি বা দিকে টার্ন নিলাম। ছোট্ট কুমলাই জনপদ পেড়িয়ে নয়াবস্তি। অপূর্ব। প্রত্যকটি বাড়ির গঠন শৈলী, ফুলের বাহার, আর মানুষগুলোর হাসি হাসি মুখ মন ভাল করে দেয়। নয়া বস্তির বাদিকের পথে চলে যাওয়া যায় জলঢাকা নদী পেড়িয়ে চা - বাগিচার সবুজ ধরে মেটেলি, ন্যাওড়াভ্যালি, রকি আইল্যান্ড। তবে আজ আমার লক্ষ্য পাহাড়ি পথ ধরে উঠে গিয়ে একশ ভাগ ভার্মি টি গার্ডেন, কুমাই চা - বাগান ও কুমাই গ্রাম।


চা - ফ্যাক্টরি, নয়া বস্তি পেড়িয়ে খাড়া পাহাড়। দু নম্বর গিয়ারে গাড়ি গা গা করে উঠে যাচ্ছে সংকীর্ণ পথে। দুপাশে চা বাগান। একটু এগিয়ে টার্ন নিতেই বাম দিকে সূর্যমুখী ও ডান পাশে চা বাগান। লাইন ধরে চা পাতা তুলে কাটা করাতে চলেছে চা -শ্রমিকরা। অসাধারণ দৃশ্যপট। গাড়ি পার্ক করলাম বাগানের ভার্মি প্ল্যান্টের সামনেই। অসংখ্য ময়ূরের অনায়াস বিচরণ! অদ্ভুত! 


উত্তরবঙ্গের চা - বাগিচায় পাতা তোলেন শুধুই মহিলারা। উত্তরাপথে তিন শতাধিক চা-বাগান সৌন্দর্য বহন করে আসছে। এর মধ্যে গোটা ২০ চা-বাগান বন্ধ। সব বাগানেই অস্থায়ী অনেক মহিলাও পুরুষ মজদুর আছে। মুলত: মহিলা মজদুররাই পাতা তোলার কাজ করে থাকে। এই অস্থায়ী মজদুররা দৈনিক হাজিরা-বিনিময় ১৫৯ টাকা পান। কাজ করতে হয় সকাল ৭:০০ টা থেকে সকাল ১১:৩০ টা পর্যন্ত এবং দুপুর ১:৩০ টা থেকে বিকাল ৪:৩০ টা পর্যন্ত। একটা ব্লকে (এরিয়া) পাতা তোলার সাতদিন পর আবার পাতা তোলা যেতে পারে, তার আগে নয়। পাতা তোলার কাজ বন্ধ থাকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস। এই দু'মাস বাগান পরিচর্চার কাজ হয়। মজদুরদের ১০ মাস প্রতিদিন ২৫ কেজি করে পাতা তুলতে হয়। কেউ বেশী পাতা তুললে স্থানীয় ভাষায় 'ডাবলি হাজিরা' বলা হয়। এরজন্য মজদুর কেজি প্রতি ৫ টাকা বেশী পায়। অন্যদিকে কেউ কম পাতা তুললে তাকে স্থানীয় ভাষায় 'পরোটা হাজিরা' বলে। এরজন্য কম তোলার কেজি প্রতি টাকা টাকা কাটা যায়। অস্থায়ী মজদুররা মাসে ৪দিন ছুটি নিতে পারে কিন্তু এরজন্য ঐ ৪দিনের টাকা পাবে না। মজদুররা বছরে একবার কম্বল-ছাতা-চটি-ছোট ত্রিপাল (আপ্রোণ) পায়। এছাড়া অন্তদ্যয় যোজনার ৩৫কেজি চাল, জ্বালানি কাঠ, চিকিৎসা পায়। 


কিন্তু এদের সামাজিক উন্নয়ন আরো প্রয়োজন। যাইহোক ওদের কাটাঘরে বসে আমাদের সঙ্গে থাকা টিফিন খেতে খেতে দুই বাগানবাবু উমর ওঁরাও ও বাপি গোয়ালার সঙ্গে কথা বলে অনেক তথ্যই পেলাম। এরই মধ্যে সার বেঁধে পাতা তুলে চলে আসে চা-শ্রমিকরা। শুরু হলো কাটা করার কাজ। আমরা কুমাই চা বাগান ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আজ রাতের ঠিকানা কুমাই পাহাড়ের কোলে 'হোয়াইট হাউজ'। রাতের কুমাই অন্য এক সৌন্দর্যবার্তা নিয়ে এল। গ্রীষ্মেও শীতের অনুভবে রাত আরও বেড়েও চলল। কাছেই পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে তোড়ে জল নেমে আসার শব্দ সারারাত অনুভব করলাম। দোতলার কিচেন থেকে গিটার নিয়ে একের পর এক নেপালি-হিন্দি গান করে চলেছে লজ মালিকের ভাই বিজেন থাপা। রাত শেষে সুন্দর এক সকাল এল। ফুলে ফুলে ভরা চারপাশ। সলালের খাবার খেয়ে ছাড়লাম কুমাই। গাড়ি ছুটল মেটেলি - চালসা হয়ে মূর্তির দিকে। সেখান থেকে ফেরে যাব কোচবিহার। আমার শহরে।


কুমাই

ছবি - লেখক 

Comments