গল্প - সাথী সেনগুপ্ত


প্রিয় বান্ধবী


নেতাজী সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থামল ট্যাক্সিটা। যদিও এই বিমানবন্দরে প্রবেশ করে কোন বৈদেশিক বিমানে চেপে বিদেশে পাড়ি দেবার ঘটনা ইতিপূর্বে আমার ঘটেনি এবং সুদূরতম ভবিষ্যতেও ঘটবার সম্ভাবনা নেই। তা সত্বেও এখানে আমায় আসতে হয়েছে। কারণ আমার ভাগ্নী মানে বড়দির মেয়ে ঈশা আজ পাড়ি দিচ্ছে সিঙ্গাপুর। সাত মাস আগে ঈশার বিয়ে হয়েছে মৈনাকের সঙ্গে।  মৈনাক পেশাগত ভাবে এঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে চাকরীস্থল সিঙ্গাপুর। বিয়ের পর দশ দিনের মাথায় ফিরে যেতে হয়েছে কমস্থলে। ঈশার এম এ ফাইনাল বাকি ছিল। সেটা শেষ করে, ভিসা ইত্যাদি ফর্মালিটিস এর ধাক্কা পেরোতে এই ক মাস সময় লেগে গেল।  সুতরাং আমি এসেছি ঈশাকে সি অফ করতে। বড়দিও আসত কিন্তু তার আবার তিনদিন ধরে তেড়ে ভাইরাল চলছে। একেবারেই বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারছে না। আর বছর তিনেক আগে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে জামাইবাবুর মৃত্যুর পর থেকে আমিই হয়ে উঠেছি বড়দির ডান হাত, বাঁ হাত। ঈশা এমনিতে আজকালকার স্মার্ট মেয়ে। তবু প্রথমবার দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ যাত্রায় বক্ষ দুরু দুরু। যদিও গত কয়েকদিন যাবত ঈশার কান থেকে ফোন আর নামছেই না। কারণ মৈনাক ক্রমাগত যাত্রাপথের ‘ডুস অর ডোন্টস’ সম্বন্ধে ইনসট্রাকশান দিয়েই চলছে।  

 


ট্যাক্সি থেকে মালপত্র নামিয়ে , ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। ঈশা কানে ফোন চেপেই আমার দিকে তাকিয়ে বলল –‘ ছোটমামা একটা ট্রলি টেনে নিচ্ছি।’ ট্রলিতে মালপত্র তুলে দিই । ঈশা কান থেকে ফোন নামিয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘তুমি কিভাবে ফিরবে ছোট মামা?’ 

-‘সে কিছু একটা পেয়ে যাব নিশ্চয়ই। ওদিকে ভলভো বাস গুলোও তো আছে।’

খানিকক্ষণ আমি আর ঈশা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলি। কফি কাউন্টার থেকে কফি খাই। তারপর ঘড়িতে সময় দেখে ঈশাকে বলি –‘তুই এবার ভেতরে ঢুকে যা। ফর্মালিটিস সেরে নিয়ে অপেক্ষা কর। কাগজপত্র, পাসপোর্ট খুব সাবধানে রাখবি। বড় সুটকেসটা লাগেজে দিয়ে দে।’ এইসব কথাবার্তা বলে ঈশাকে বিদায় দি। ঈশা ট্রলি ঠেলে, কাগজপত্র দেখিয়ে স্বয়ংক্রিয় কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে গিয়ে একবার পেছন ফেরে, আমার দিকে হেসে হাত নাড়ে। আমিও হাত নাড়ি।


আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। মেয়েটা প্রথম বিদেশ যাচ্ছে। বড়দি অনেক কষ্ট করে বিয়েটা দিয়েছে। ঈশার নিজের পছন্দের বিয়ে নয়, সম্বন্ধ করে বিয়ে। অল্প কদিনের দেখায় মৈনাক ছেলেটাকে তো ভালোই লেগেছে। মেয়েটা যেন সুখী হয় ।


দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবছি অর্ণাকে সঙ্গে নিয়ে আসলেই পারতাম। তাহলে এত বোর লাগত না।কিন্তু অর্ণার কালকে খাতা জমা দেবার দিন। ফলে সারা সন্ধ্যে পাগলের মত খাতা দেখছে । স্কুল টিচারদের এই এক দুর্গতি – কি আর করা। খানিকক্ষণ বাদে ঈশার ফোন এল সব ফর্মালিটিস হয়ে সিকিউরিটি চেকিং ও হয়ে গেছে। আমি যেন চিন্তা না করি।


লিফটে করে এক্সিটের দিকটায় এলাম। এই সময় কোন বিদেশী বিমান হয়ত ল্যান্ড করেছে। কিছু যাত্রী ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। সানগ্লাস পরা খোলা চুলের এক চটকদার যাত্রিণীর দিকে নজর পড়ল। পরনে কালো প্যান্ট, সাদা টপ, পায়ে ম্যাট ফিনিশ রুপোলী রঙের স্টিলেটো, সব মিলিয়ে নজরে পরার মতই চেহারা। ভদ্রমহিলা খুব অল্পবয়সী নন। যত্নে সুসজ্জিত চেহারা প্রকৃত বয়সকেও প্রকাশিত হতে দেয়না।  ইনি পঁয়ত্রিশও হতে পারেন আবার পঁয়তাল্লিশ হলেও আশ্চর্য হবার নয়। অনিচ্ছাকৃত ভাবে হলেও আমার দেখাটায় বোধহয় একটু  আদেখলে ভাব ফুটে উঠেছিল। সানগ্লাস থাকায় ভদ্রমহিলার চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে মনে হচ্ছিল লিপস্টিক রাঙা ঠোঁটের গড়নে কি একটা চেনা চেনা ভাব। কে জানে বাবা ফিলিম স্টার টার নয়। নইলে এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কালো চশমাই বা পরতে যাবে কেন?


ভদ্রমহিলা ট্রলি টানতে টানতে ফোনে কথা বলছিলেন। মনে হল 

ড্রাইভারকে ডাকলেন। ভদ্রমহিলা হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। - 'কেমন আছো সুরঞ্জন ? চিনতে পারছ না?’


চমকে উঠে বিষম খাবার জোগাড়। কোন রকমে আমতা আমতা করে বলি –‘আপনি? মানে আপনি?’


এবার বিরক্তিতে ঠোঁট বাঁকান মহিলা, সানগ্লাসটাও হাতে খুলে নেন –‘সত্যি, ঠিক একই রকম ক্যালাস রয়ে গেছ।’ 

এবার চেনা নাম মনে আসে, তবু উচ্চারণ করতে ভরসা হয়না।

ততোক্ষণে অপর পক্ষ অধৈর্য হয়ে ওঠে। - 'ও বাবা, একেবারে ভুলেই গেছ। 'আমি আমতা আমতা করে বলি – ‘লোপিতা?’

-‘যাক মনে পড়ল তাহলে। তা এখানে ?’

এবার সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করি।-'একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি।’


ঝকঝকে সাদা দাঁত বার করে হাসল লোপিতা।

-‘আম? দুবাই থেকে ব্যাক করছি। প্রতীক লাস্ট ফাইভ ইয়ারস দুবাইতে চাকরি করছে।’

- ‘আর তুমি থাকো না ওর সঙ্গে ?’  

- ‘থাকি। বাট নট অলওয়েস। এখানে আমার নিজের একটা বিজনেস আছে। সেটা দেখতে হয়। সেতো হল, আর তুমি কি করছ বুদ্ধুরাম?’

-‘আমি নবান্নে আছি। সরকারী চাকুরে।’

-‘হু। কোথায় থাক আজকাল? সেই বরাহনগরে?’

- ‘না, যাদবপুরের কাছে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।’

- ‘ ওরে বাবা, একেবারে উত্তর থেকে দক্ষিণে।’

- ‘হ্যাঁ, আসলে অর্ণার বাপের বাড়ির কাছে। আর অর্ণা যে স্কুলে পড়ায় সেও সাউথেই।’

-‘আচ্ছা আ। মাস্টারনি।’


আমি উত্তর না দিয়ে হাসলাম। এমন সময় ঈশার ফোন এল, ছোটমামা ,ফ্লাইটে উঠে গেছি। এভরিথিং ইজ ওকে।পৌঁছে কল করব।’ আমি বাই করলাম।


লোপিতা ভুরু কুচকে তাকাল। আমি বললাম – ‘বড়দির মেয়ে ঈশা। ওকে সি অফ করতেই এখানে আসা। ঠিক আছে আসি তাহলে।’


লোপিতা ঝলসে উঠল ।- 'সত্যি তুমি কি বলত? এতদিন বাদে দেখা হল সেল নাম্বারটা দেবেনা। নাকি বউএর ভয়ে সেটাও মানা।’


তারপর ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বার করে এগিয়ে দিল – ‘এই নাও।  আমার এড্রেস,  সেল নম্বর সব কিছু। ইচ্ছে হলে যোগাযোগ কর।’

হাত বারিয়ে কার্ডটা  নিলাম। লক্ষ করলাম গাঢ় চকলেট রঙের নেলপলিশ লাগানো ম্যানিকিওর করা হাতের অনামিকায় দৃশ্যমান চেহারার এক টুকরো হীরকদ্যুতি।

ফেরার পথটা কাটল কেমন একটা ঘোরের মধ্যে। এত বছর পরে লোপিতার সঙ্গে এমন অদ্ভুত ভাবে দেখা। অথচ একসময় আমরা দুজন একজন অন্যজনকে না দেখে থাকতে পারতাম না। লোপিতা আর আমি দুজনেই স্কটিশের ছাত্র ছাত্রী।  তবে দুজনের সাম্মানিক বিষয় আলাদা। আমি বাংলা অনার্সের ছাত্র, লোপিতা ইংরেজি অনার্সের। উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ির মেয়ে লোপিতা। ইংলিশ মিডিয়াম, মিশনারী স্কুলের ছাত্রী। ফলে ভাবনা সাজপোশাকে আধুনিকতার সঙ্গে রক্ষনশীলতার মিশেল ছিল। নজরে পরার মত সুন্দরী।  সাজগোজের বাহুল্য ছিল না। আমি তখন প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবী চড়িয়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে তথাকথিত আঁতেল হয়ে নাটক করে বেড়াই। আমাদের একটা ড্রামা ক্লাব ছিল। সেবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগে ঠিক হল আমরা অভিনয় করব রক্তকরবী। অন্য চরিত্র পেয়ে গেলেও পছন্দ মতো ‘নন্দিনী’ পাচ্ছিনা। একদিন হঠাৎ ই সাহস করে বলে ফেললাম লোপিতাকে। - 'এই, নন্দিনীর রোল করবে?’ শুনল। ফিরিয়ে দিল না। বলল ‘ভেবে দেখি।’


রাজি হল। আমি বিশু পাগল, লোপিতা নন্দিনী। রোজ কলেজ ছুটির পর রিহার্সাল চলত। রিহার্সাল দিতে দিতে টের পাচ্ছিলাম দুজনেরই ভেতরে একটা ভাঙচুর চলছে। আমার গানের গলা খুব মধুর নয়। একটা খ্যাসখ্যাসে ভাব আছে। তবে ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে গান শুনে শুনে গানের কান ছিল তৈরি। খ্যাসখ্যাসে গলায় গাইলেও গানের সুর, লয়, তাল বেঠিক হতোনা। বরং অন্যদের কাছে শুনেছি ওই অরাবীন্দ্রিক গলায় নাকি অন্য এক আবেদন ছিল। ….. সেদিন বিশু পাগলের ভূমিকায় গাইছি –‘ও চাঁদ চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে। 'গাইতে গাইতে নিজেই কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে গেছি। হঠাৎ নন্দিনী রুপী লোপিতার দুচোখ ভর্তি জল। আমি গান থামিয়ে বললাম – 'কি হল রে'? উত্তরে কোন কথা না বলে লোপিতা ফুঁপিয়ে কান্না। সে কান্না আর থামতেই চায় না। রিহার্সাল হচ্ছিল রনদীপদের বাড়ির ছাদের ঘরে। ওটা আমাদের জন্য ছিল মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র। আমাদের নাটকের মহলা, হাতে লেখা ম্যাগাজিনের কার্যালয়, গানের ব্যান্ডের প্রাকটিস, সব কিছুই ওখানে। আমাদের নাটকে রনদীপ করেছিল রাজার অভিনয়। তখন আমরা তিনজনই পৌঁছেছি। বাকিরা আসবে, আসছে করছে। সবাই মিলে শুরু হওয়ার আগে রনদীপ গেছে বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে চা, সিগারেটের অর্ডার করতে।  অনেক সময় রনদীপের মা দোতলা থেকে পাঠিয়ে দেন। সেদিন উনি বাড়ি নেই তাই এই ব্যবস্থা। আমি আর লোপিতা এই অবসরে নিজেদের অংশটুকু ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। তখন এই বিপত্তি। মেয়েরা কাঁদলে ছেলেদের কি করতে হয় জানা ছিল না। আর আমার মতো হাবা গঙ্গারাম ত কোন ছাড়। ফলে চূড়ান্ত রকমের ভ্যালভ্যালে হয়ে বসে রইলাম। খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করে চোখের জল মুছে লোপিতা বলল – ‘আমার আজ ভালো লাগছে না। আমি চললাম।’ বলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল।  রনদীপ এসে তো হাঁ। -‘কিরে তোর নন্দিনী  কোথায় গেল?' আমি বোকার মতো সবটাই  বললাম। 


রনদীপ সব শুনে আমার পিঠে একটা সশব্দ চাপড় বসিয়ে বলল –‘শাল্লা, একেবারে গা— মাইরি। ও চলে গেল, আর তুই যেতে দিলি। ফাঁকা ছাদের ঘর।  ধারে কাছে কেউ নেই।….. কোন মানে হয়।’


আমি খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে তারপর বুঝতে পারলাম রনদীপ কি বলতে চাইছে। তখন রণর ওপর ভীষণ রেগে গেলাম। সেদিন আর রিহার্সাল হলনা। …. কিন্তু সেদিন রাত্রে আমার ঘুম এলো না। লোপিতার জল ভরা টলটলে চোখ দুটো মনে পড়তে লাগল। আরও অনেক কিছু মনে আসছিল যেগুলো দিনের বেলা কল্পনাও করতে পারব না।


এ ঘটনা নিয়ে আমি আর লোপিতা কোন কথা বলিনি। রক্তকরবীর অভিনয় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে আমার আর লোপিতার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গিয়েছিল। কলেজ শুদ্ধ সবাই আমাদের প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে চিহ্নিত করলেও আমরা কেউ কাউকে প্রপোজ করিনি। কিন্তু দুজনেই জানতাম কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতাম না। …… গ্রাজুয়েশান শেষ হল। আমি ইউনিভারসিটিতে এম এ ক্লাসে ঢুকলাম। লোপিতা তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষ। ক্যাম্পাস আলাদা হয়ে গেলেও আমাদের মেলামেশার কমতি নেই। লোপিতার বিএ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল। তখনও রেজাল্ট বেরোয় নি। আমরা দুজনেই গিয়েছি ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সেখানেই লোপিতা আমাকে জানালো ওর বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা। ভালো ছেলে , এঞ্জিনিয়ার পাত্র, ধনী পরিবার , বংশ কৌলীন্যেও ওদের মাপমতো ইত্যাদি ইত্যাদি।  এক মাস পরে বিয়ে। আমার কান দিয়ে আর কোন কথা ঢুকছিল না। কোন রকমে হাসবার চেষ্টা করে বললাম –‘বাঃ বেশ ভালো তো। নেমন্তন্ন পাচ্ছি তো?’ লোপিতা আমার দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল।  বলল –‘তোমার কিছুই মনে হচ্ছেনা, তাই না?’

 

আমার বুকের ভেতরটা যেন ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু কিভাবে কি বলব আমি জানি না। এতদিন তো কিছু বলিনি। নিজেকে লোপিতার তুলনায় খুব হীন মনে হতে লাগল। ওর বাবা মা যে পাত্র খুঁজে সেতো লোপিতার যোগ্য পাত্র। আমার বরানগরের দু কামরার বাড়িতে, আমার মতো চালচুলোহীনের সঙ্গে লোপিতাকে কি মানায়? তাই মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল – ‘কী মনে হবে?’ লোপিতা সেদিন কাঁদল না। কাঁদলে অন্য রকম হত কিনা জানি না। শুধু গাঢ় অভিমানের গলায় বলল –‘ সত্যি, ভুল মানুষকে চিনেছিলাম।’ 


সেদিন রাত্রে আমি কেঁদেছিলাম। বরাহনগরের দু কামরার বাড়িতে কাঁদবার আড়ালটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়না। একই ঘরে আমি মাটিতে শুতাম বিছানা পেতে, আর ছোট বোন কনা আর মা শুত চৌকিতে। কনা টের পেয়ে ছিল ছোড়দা কাঁদছে। চুপিচুপি পাশে এসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল –‘এই ছোড়দা, কি হয়েছে তোর?’


 …… লোপিতার বিয়ে হয়ে গেল শুভলগ্নে। আমায় নিমন্ত্রন করেনি। তবু অন্য বন্ধুদের হাত দিয়ে উপহার পাঠিয়েছিলাম আমাদের দুজনের প্রিয় কয়েকটি  বই। তার মধ্যে অবশ্যই ছিল ‘রক্তকরবী’। ছোট করে লিখেছিলাম ‘নন্দিনকে বিশু।’  


এসব নানা কথা মনে আসছিল বাড়ি ফেরার পথে। ভলভো বাসটা ভালই পেয়েছিলাম ।জানালার ধারে সিটটাও জুটেছিল।এয়ারপোর্ট থেকে যাদবপুরের পথটা বেশ দীর্ঘ। ফলে এইসব ভাবতে ভাবতে আসছিলাম। এত বছর পরে এভাবে লোপিতাকে দেখতে পাব কোনদিন ভাবিনি। লোপিতা কি বদলে গেছে অনেক? বদলানোই তো স্বাভাবিক।  আমিও কি বদলাইনি। সত্যি কথা বলতে কি এখনকার ব্যস্ত জীবনে লোপিতার কথা মনেও পড়েনা সেভাবে। পকেট থেকে কার্ডটা বের করলাম। লোপিতার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর। খুব কি প্রয়োজন আছে আজ। ভাবলাম জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দি। ফেলতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে আবার পার্সের খাপে ঢুকিয়ে রাখলাম । 

                                            

ফোন করেছিলাম লোপিতাকে। ওপার থেকে সাগ্রহ সাড়া মিলেছিল। খানিকক্ষণ কথা বলার পর লোপিতাই বলেছিল –‘চল না, কোথাও মিট আপ করি। অনেক গল্প করব তালে।’

-কোথায় মিট করতে চাও?

- কোথায় যাবে বল? তবে আমার কয়েকটা ক্লাব মেম্বেরশিপ আছে, ইচ্ছে করলে সেখানেও যেতে পারি।


আমার ঠিক ক্লাব টাবে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। তুমি যেখানে বলবে।


- বুদ্ধুরাম একটা। ঠিক আছে আমি তোমাকে পিক আপ করব।


কথা অনুযায়ী লোপিতা আমায় পার্ক স্ট্রীট মেট্রো স্টেশানের কাছ থেকে একটা দামি গাড়িতে তুলে নিল। লোপিতাই নিয়ে গেল মধ্য কলকাতার এক দামি ক্লাবে।  আমি সেদিন অনেক তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমার খুব শিহরণ বোধ হচ্ছিল । লোপিতার মসৃণ ত্বক, ঘন কালো নরম চুল, আধুনিক পোশাক, সানগ্লাসে ঢাকা আবছা দুটি চোখ। সবকিছুই লোপিতার সঙ্গে কেমন একটা ব্যবধান তৈরি করেছিল। লোপিতার সঙ্গে একসময় সারা কলকাতা চষে বেড়িয়েছি।  কিন্তু কখনও তো এরকম মনে হয়নি। কাঁচ তোলা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে আমার পার্শ্ববর্তিনী পরিচিতা রমনীকে মনে হচ্ছিল দূরবর্তী রহস্যময়ী। যার জন্য যুগে যুগে যে কোন পুরুষ পাগল হতে পারে। কিন্তু সে আমার নিজস্ব নারী নয়।


মধ্য কলকাতার নামী ক্লাবের পুল সাইডে আমরা বসলাম। বিকেল তখন সন্ধ্যাকে আলিঙ্গন করছে। জলের ধারের স্নিগ্ধ হাওয়ায় লোপিতার খোলা চুল বারে বারে অবিন্যস্ত হচ্ছিল। সযত্নে চর্চিত আঙ্গুলগুলো দিয়ে বারে বারে চুল ঠিক করছিল। লোপিতা আমায় জিজ্ঞেস করল ‘কি নেবে বল?’                 আমি বললাম – ‘তোমার যা ইচ্ছে।’

ও কিছু স্ন্যাক্স আর পানীয় অর্ডার করল। অভ্যস্ত ভাবেই পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অনর্গল কথা বলছিল লোপিতা। অনভ্যস্ত পরিবেশে আমি খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলাম না। দু একজন লোপিতার পরিচিত, ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। লোপিতাও কথা বলতে বলতে তাদের দিকে তাকিয়ে হাসি ফিরিয়ে দিল,  কাউকে বা বলল –‘হাই।’ আমার অবশ্য এই পরিবেশে পরিচিত জনের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি শুধু লোপিতাকেই দেখছিলাম আর মনে মনে বর্তমান আর অতীতকে মেলানোর চেষ্টা করছিলাম।


লোপিতা আমার বর্তমান জীবনযাপন সম্পর্কে অনেক কথা প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছিল । বন্ধু বান্ধবদের কথাও উঠল। আমি যাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তাদের কথা বললাম। লোপিতার সঙ্গে আমাদের নাটকের গ্রুপটার কারুরই যোগাযোগ নেই। 


লোপিতা সম্পর্কে যেটুকু জানলাম, তা হল লোপিতার স্বামী বেশিরভাগ সময় বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি সুত্রে। লোপিতাও বিভিন্ন জায়গায় তার সঙ্গে থেকেছে। তবে ইদানীং বেশির ভাগ সময় কলকাতাতেই থাকে। ওর একটা  সখের বুটিক আছে। সেটা মূলত ওর সময় কাটাবার ব্যসন। ওর একটিই ছেলে। দুন স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। হোস্টেলে থাকে । ওর ছুটির সময় প্রতীকও কলকাতায় আসবার চেষ্টা করে। নইলে লোপিতা ছেলেকে নিয়ে বিদেশে প্রতীকের কাছে যায়। 


আমি লোপিতার মুখ থেকে এক অন্য জগৎ, অন্য জীবনের গল্প শুনছিলাম। যে জীবনের সঙ্গে আমার টিফিন বক্সে রুটি তরকারি কিংবা ছুটিতে পুরী ,দীঘা জীবন যাপনের বিস্তর ফারাক। অর্ণার কথা একটু বললাম। বললাম আমার ক্লাস ফাইভে পড়া রিয়ার কথা।


এসবের মধ্যে একবার বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম –‘ কলকাতার ফ্ল্যাটে তুমি একাই থাকো? অসুবিধে হয়না?’

লোপিতা উত্তরে তার কোলগেট হাসি ছড়িয়ে বলল –‘অভ্যেস হয়ে গেছে। ইউ নো সুরঞ্জন, আজকাল প্রতীক আর বাপটু এসে বেশিদিন থাকলে আমার কেমন অস্থির অস্থির করে।’ 


সেদিনের পর ভেবেছিলাম লোপিতার সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরির খুব কি দরকার? কে বলতে পারে আমার সাদামাটা নিরুদ্বেগ জীবনে এ থেকে কোন ঝড় উঠবে না? রাতে বিছানায় শুয়ে অর্ণার সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে অর্ণাকে বললাম– 'জানো, আমাদের কলেজ জীবনে লোপিতা বলে একটা মেয়ে ছিল না, তার সঙ্গে আজ দেখা হল।’

অর্ণা আদুরে গলায় বলল –‘ও, যার সঙ্গে তোমার ইন্টু মিন্টু ছিল?’

‘দূর, কি যে বল, আমরা একসঙ্গে নাটক টাটক করতাম। এই আর কি।’

-‘তা সে এখন কি করে?’

-‘ ও বাবা, তার এখন বিশাল বড়লোকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। হাজব্যান্ড ব বচাকরি করে।  বিশাল পয়সা।’


অর্ণা আমার খোলা বুকে মুখ ঘসে। -‘দূর, অত বড়লোকদের সঙ্গে আমাদের পোষায় না।’

-‘তা যা বলেছ।’- আমি নিজেকেও এ কথা বলে আশ্বস্ত করে অর্ণার সঙ্গে দৈনন্দিন অভ্যাসের খেলায় মেতে উঠি।


ইতিমধ্যে লোপিতা দুয়েকবার ফোনে কথা বলেছে। একদিন ডেকে নিয়ে গেল গঙ্গাবক্ষে ভাসমান রেস্তোরাঁয়। অনেক গল্প হল সেদিন। কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছে পুরনো কথা। আমাদের যৌবনের কলকাতার কথা। আমাদের পরিচিত পথগুলি, পরিচিত স্থানগুলি, যেসব জায়গায় আমরা মিলিত হতাম, সেসব জায়গার কথা। সে সব জায়গায় আমরা আর ফিরে যেতে পারিনা। কারণ আমাদের চেনা কলকাতা বদলে গেছে অনেকটা।

লোপিতা বলল –‘ সুরঞ্জন, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ইউ ক্যান কাম টু মাই প্লেস অলসো। একটু ফোন করে এসো প্লিজ।আমরা দুজনে অনেক গল্প করব।’


বেশ কয়েকমাস কেটে যায়।

সেদিন অফিস গিয়েও অফিস করা হল না। এক প্রাক্তন সহকর্মীর আকস্মিক মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চলে যেতে হল সেখানে। সহকর্মীর বাড়ি পার্ক সার্কাসের কাছাকাছি। আমি এবং দু তিনজন সহকর্মী ফুল মালা নিয়ে উপস্থিত হলাম সেখানে। ভেবেছিলাম ওখানেই থেকে যাব। কিন্তু আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতির সংখ্যা ভালোই ছিল।  ফলে আনুষ্ঠানিক শোক জ্ঞাপন করে দুপুর দুটো নাগাদ  বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে দু তিনজন মিলে ট্যাক্সি নিলাম। সবারই সাউথের দিকে যাবার কথা।  ট্যাক্সিটা যখন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির দিকে সিধে চলছে , তখনই মনে হল লোপিতার কথা। এদিকেই কোথায় থাকে না?  কি মনে হতে পকেট থেকে পার্সটা বের করে লোপিতার কার্ডটা খুঁজে বের করলাম। বিড়লা মন্দিরের কাছাকাছি একটা বহুতলের ন তলায় লোপিতার অ্যাপার্টমেন্ট। লোপিতাকে কি একটা ফোন করব? না থাক, ওকে বরং সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। যদি বাড়িতে না থাকে? না থাকলে ফিরে আসব। আর যদি থাকে, তাহলে ও ভীষণ চমকে যাবে।  ট্যাক্সি থেকে দরকারি কাজ আছে বলে নেমে পড়লাম। ফ্ল্যাটে সিকিউরিটির ঝামেলা পেরিয়ে লিফট বেয়ে উঠে গেলাম ন তলায় লোপিতার ফ্ল্যাটের সামনে। পালিশ করা মেহগনি দরজায় সোনালি নেমপ্লেট।


কলিংবেল বাজালাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, কেউ তো খুলছেনা। তবে কি বাড়ি নেই?  না দরজার উপর ‘ইন’, ‘আউট’ অপশন দেওয়া আছে।  তাতে তো ‘ইন’ই দেখানো আছে। ফোন করে এলেই বোধ হয় ভালো হত। আজকালকার দিনে সারপ্রাইজ দেওয়ার ভাবনার চেয়ে ছেলেমানুষি কিছু হয়।

ফিরে যাব কিনা ভাবছি। হঠাৎ চেন দিয়ে আটকানো দরজা আধখানা খুলল। হ্যাঁ লোপিতা, লোপিতাই। ভীষণ অবাক হয়ে বলল – ‘তুমি’?

- হ্যাঁ, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোমায় একটু সারপ্রাইজ দি। কি হল ঘুমুচ্ছিলে নাকি?

-‘ওই আর কি। ভেতরে আসবে?’


আমার অবাক লাগলো। এতদিন পরে আমি এসে দাঁড়িয়েছি লোপিতার দুয়ারে আর লোপিতার মুখে এই প্রশ্ন, ভঙ্গিতে অনীহা। 

তবু বলি – ‘সেরকম ইচ্ছেই তো ছিল। তোমার কোন অসুবিধে আছে?’ 

-‘আরে না না। লোপিতা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। দরজা বিস্তৃতভাবে উন্মুক্ত হয়  -‘এসো এসো ভেতরে এসো।’

আমি লোপিতার সুসজ্জ্বিত অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করি। নানা ধরণের দেশি বিদেশী আসবাবে সাজানো বৈঠকখানা। পায়ের তলায় রঙ মেলানো নরম কার্পেট। দেয়ালে মূল্যবান ছবি। মখমলের গদি আঁটা সোফা , দামি আলোর স্ট্যান্ড ।কালো কাঁচ দেওয়া সেন্টার টেবিলের ওপর সাজানো রয়েছে ঝকঝকে ক্রিসটালের গৃহসজ্জার উপকরণ। একদিকে কাশ্মীরি কাঠের জাফরি কাটা পার্টিশান সদর, অন্দরকে আড়াল করেছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। এই ফ্ল্যাট এই সুসজ্জিত বৈঠকখানা কোন কিছুর মধ্যেই আমার কলেজবেলার লোপিতার কোন মিল নেই। কর্নার টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা আছে লোপিতার পারিবারিক ছবি। ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাথায় টুপি পরা ছেলেটি নিশ্চয় লোপিতার ছেলে। পাহাড়ি প্রকৃতির মাঝখানে লোপিতা এবং সুপুরুষ সফল চেহারার ভদ্রলোকের ছবি রূপোর ফ্রেমে আঁটা। নিশ্চয় লোপিতার স্বামী প্রতীক।


আমি সোফায় বসলাম। লোপিতাও বসল আমার মুখোমুখি। লোপিতার পরনে ঢিলেঢালা সাদা কালো ছাপের দামি কাফতান। ফর্সা গায়ের রঙ তৈলাক্ত উজ্জ্বল। রাজহংসী গলায় কালো তিলটিও বেশ চকচক করছে। দ্যুতিময় মুখমণ্ডলের ধার ঘেসে নেমে এসেছে নরম, ফাঁপা অবিন্যস্ত চুল। আমি দেখছিলাম, লোপিতাই নীরবতা ভাঙল।

- ‘হাঁ করে এত কি দেখছ বলত? খুব সারপ্রাইজ দিলে যাহোক। একটা ফোন করে আসতে তো পারতে। যদি বাড়িতে না থাকতাম।’


তারপরই ফর্সা মসৃণ হাত দু্টোকে তুলে অবিন্যস্ত চুলগুলোকে জড়াবার চেষ্টা করে। আমি ওর দেহ বিভঙ্গে বুঝতে পারি ও ভেতরে অন্তর্বাস পরা নেই। লোপিতা উঠে পড়ল। -‘ দাঁড়াও তোমায় কিছু ড্রিঙ্কস দি। এই দুপুরে তেতে পুড়ে এসেছ, কি নেবে বল ?’ লোপিতা ভেতরে যেতে যেতে বলল –‘ আমার আবার কাজের মেয়েটা দুপুর বেলা বেরিয়ে যায়।’


-‘ তুমি কি ঘুমুচ্ছিলে?’ আমি প্রশ্ন করি। লোপিতা একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল –‘আমার ম্যাসিওর এসেছে। আমি ম্যাসাজ নিচ্ছিলাম। তাই দরজা খুলতে দেরি হল।’

আমার অস্বস্তি লাগলো। আমি হঠাৎ লোপিতার ব্যক্তিগত মুহূর্তে এসে পড়েছি। আজকাল অনেক মহিলাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের ম্যাসাজের কাজ করেন। হঠাৎ এসে লোপিতাকে অসুবিধেয় ফেললাম। কিন্তু একথাও ঠিক এমন অসময়ে না এলে লোপিতার এই এলোমেলো সৌন্দর্য দেখতে পেতাম না। আমার মতো একজন এলেবেলে মানুষের এমন রমনীয়া বান্ধবী ছিল ভেবে মনে মনে প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব হল। লোপিতা ভেতরে যাওয়ার পর কাঁচের গ্লাসের মৃদু শব্দের সঙ্গে কানে এল চাপা গলার আওয়াজ। লোপিতা যেন কারুর সঙ্গে চাপা গলায় কথা বলছে। 


একটু পরে লোপিতা এল ভাসমান বরফকুচি সহ রঙিন পানীয় নিয়ে । পাণীয়র গ্লাস হাতে তুলে দিয়ে সহজ হবার ভঙ্গিতে মিষ্টি হেসে লোপিতা বলল,               

-‘শেষ পর্যন্ত আমার বাড়িতে তুমি এলে।  ভাবতেই পারছি না।’

পানীর গ্লাস লোপিতার গ্লাসের সঙ্গে ঠেকিয়ে বললাম ‘চিয়ার্স’।

তারপর বললাম –'এলাম ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছে অসময়ে।’

লোপিতা ভ্রূ ভঙ্গি করল।-‘ অসময়কে সময় করে নিতে জানতে হয়।’

লোপিতার কথা, দেহভঙ্গি, চোখের চাউনি, সুচর্চিত হাতে পানীয়র গ্লাস এবং আমার মস্তিস্কে ছড়িয়ে পড়া রিমঝিমে আমেজ এক অদ্ভুত মায়া সৃষ্টি করেছিল।  মনে হচ্ছিল এমন একজন নারীর কাছে আজও নতজানু হতে পারি।


লোপিতা এমনিতে যথেষ্ট প্রগলভ। আজও কথা বলছিল। কিন্তু আজ কথাবার্তা, রসিকতা সব কিছুর মধ্যে একটা সচেষ্টতা লক্ষ করা যাচ্ছিল। যেন মনে হচ্ছিল কি যেন একটা অস্বস্তি লুকিয়ে রয়েছে ওর মনে।  বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল ওর বেডরুমের দিকে। আমার মনে হল ও তো বলছিল ম্যাসাজ করাচ্ছিল, তাহলে ম্যাসিওর মেয়েটা কি ঘরেই রয়েছে? কাউকে তো বেরোতে দেখলাম না।

লোপিতাকেই প্রশ্ন করি –‘ ঘরে কি কেউ আছে?’

লোপিতা হঠাৎ যেন মনে পড়ল এমন ভাবে বলল – ‘ও হ্যাঁ, আমার ম্যাসাজের লোকটি। দাঁড়াও, ওকে বিদেয় করে আসি।’

লোপিতা উঠে চলে গেল শোবার ঘরে। কিছু চাপা স্বরে কথাবার্তা শুনতে পেলাম। লোপিতার বসার ঘরের জাফরি কাটা পার্টিশানের ওপার দিয়ে হেঁটে গেল একটি দীর্ঘ চেহারা। পরনে নীল জিনস আর সাদা টি শার্ট। পার্সে টাকা গুনে ভরতে ভরতে পুরুষ কণ্ঠ গমগম করে উঠল – ‘থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। সি ইউ এগেইন। আই হোপ এভরিথিং ইজ স্যাটিসফ্যাকটরি।’


ছেলেটা চলে গেল। লোপিতা দরজা লাগিয়ে ফিরে এল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। লোপিতা বলে –‘তোমায় আরেকটু ড্রিঙ্কস দেব?’             

আমি কোন রকমে বলি –‘এই ছেলেটি তোমার ---’ আমার কথা শেষ হয়না। লোপিতা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেটে কেটে বলে –‘ঠিকই ধরেছ। এই ছেলেটি আমার ম্যাসিওর। হি ইজ আ ভেরি নাইস গাই। এমন আরও অনেকেই আমার কাছে আসে। আমি আমার সময়মত, ইচ্ছে মত ডেকে নিই। একটা টেলিফোন আর কয়েকটা কাগুজে নোট।… বাই দ্য ওয়ে, আমারও তো ইচ্ছে থাকতে পারে।’


নিচের ঠোঁটটা কামড়ে, শরীরে কম্পন তুলে হাসতে থাকে লোপিতা। হাসতে হাসতে ওর চোখের কোণ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

আমি আর কোন কথা বলিনা। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে যাই।

চিত্র - শ্রীহরি

Comments