গল্প - সৌম্যশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

এক মুঠো রোদ্দুর 


এক

‘আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা ---

ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা!’


নাঃ, সুকুমার রায়ের মতো ছায়ার সঙ্গে নয়, সকাল থেকে একটা রোদকে ধরতে গিয়ে আমার তখন প্রায় নাজেহাল অবস্থা – ঘেমে নেয়ে একসার!

ছোট্ট মতো রোদ – ভারি চমৎকার দেখতে। হলুদের ওপরে সোনা জলের রঙ করা। কিন্তু খুবই চালাক, যতবারই ধরার জন্যে হাতটা বাড়াচ্ছি, ততবারই ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে মেঘেদের আড়ালে গিয়ে মুখ লুকোচ্ছে!



আসলে এখনকার রোদগুলোই হয়েছে এই রকম। যত্ন করে ধরতে গেলে পালায়। আবার দূরছাই করে যেতে বললেও কথা না শুনে গরমের দিনে জাঁকিয়ে বসে আগুন ছড়ায়। জীবন অতিষ্ট করে একেবারে যেন ভুত ভাগায়!


অথচ এই রোদটাকে আজ আমার খুব দরকার। ধরতে পারলে ওটা ঝুমাদিকে দেব। কিন্তু ঝুমাদিটা কে? সে সব কথা না হয় পরেই বলা যাবে। এখন বরং আরো একবার রোদটাকে ধরার চেষ্টা করি। চুপি চুপি ওটার পেছনে গিয়ে ঝপ করে চেপে ধরি!

কিন্তু চেপে ধরি বললেই তো আর ধরা যায় না– চাই বললেও সব কিছু পাওয়া যায় না। এবারেও তাই রোদটাকে ধরতে পারলাম না। ওটা বোধহয় আগে থেকেই আমার মতলবটা বুঝে ফেলল– তাই আমি এগিয়ে যাওয়ার আগেই হঠাৎই মেসির মতো একটা ডজ মেরে ফুরুৎ করে উড়ে গিয়ে আবার একটা কাল মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো! মেঘটাও কিন্তু থেমে থাকল না। আমাকে চূড়ান্ত দুয়ো দিতেই যেন সঙ্গে সঙ্গেই ঝিপ ঝিপিয়ে বৃষ্টি নামালো!

আমার এবারে কেমন যেন রাগ হয়ে গেল। কিছুতেই নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। প্রায় দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একটা গালাগাল দিয়ে উঠতে গেলাম। কিন্তু সেটাও পারলাম না। তার আগেই বিছানার পাশে রাখা মোবাইলের অ্যালার্মটা ককং কং– ককং কং শব্দে বেজে উঠে আচমকাই আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল।


মুহূর্তেই আমি ধড়মড় করেই বিছানায় উঠে বসলাম। আর ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল, আরে তাই তো – আজ যে ঝুমাদির কলকাতায় আসার কথা! একটু পরে দার্জিলিং মেলে করে এসে শিয়ালদায় নামবে। ট্রেনটা তো আমাকে অ্যাটেন করতে হবে– ঝুমাদিই ফোন করে যেতে বলেছে।   



দুই

ঝুমাদি হচ্ছে বাসবদার দিদি- অমিতের প্রেমিকা। অমিত আমার বন্ধু– স্কুলে আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। সম্ভবত আমরা তখন ক্লাস নাইনে, বাসবদা সবে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে আর ঝুমাদি তখন  প্রেসিডেন্সী থেকে গ্র্যাজুয়েশান কমপ্লিট করে রাজাবাজার সাইন্স কলেজের এমটেকে- সেই সময়েই অমিতের প্রেমের শুরু। অবশ্যই এক তরফা প্রেম।  


আমরা তখন প্রতিদিন বিকেলে বাসবদাদের বাড়ীর পাশের ছোট মাঠটাতে ফুটবল খেলতাম। অমিতও খেলত – ভালই খেলত। তবে বড্ড নাটক করত। ঝুমাদি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেই শো-বাজী শুরু করে দিত। একটা করে বল মারত আর ইচ্ছা করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ত। এইভাবে করতে গিয়ে একবার হাঁটুতে খুব বড় চোট পেয়েছিল।লিগামেন্টটা ছিঁড়ে দু’টুকরো হয়ে যায়। অপারেশান করানোর পর মাস তিনেক বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। তাতেও সম্পূর্ণ সারেনি – পরে তাই যেন একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। স্বাভাবিক কারণেই এরপরে ওর ফুটবল খেলারও ইতি পড়ে যায়।

ফুটবল খেলার ইতি অবশ্য আমাদেরও পড়ে যায়। খেলার মাঠটাই বিক্রি হয়ে যায়। বাসবদার বাবা ওটা কিনে নেন। তারপরে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ওখানেই বাসবদাদের প্রমোটিং কম্পানির ব্যানারে প্রথম একটা ছতলা ফ্ল্যাট বাড়ী তৈরী করেন অমিতও এরপরে কেমন যেন পালটে যায়। স্কুল আর টিউশানি ছাড়া বাড়ী থেকে বেরনোই প্রায় বন্ধ করে দেয়। সারাক্ষণ বই মুখে করে পড়াশুনো শুরু করে। ফলও পায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। একেবারেই সাধারণ মেধার ছেলে থেকে মাস ছয়েকের মধ্যে পড়াশুনোতে রীতিমত ভাল ছাত্র হয়ে ওঠে। হায়ার সেকেন্ডারিতেও দুর্দান্ত রেজাল্ট করে। আইআইটি জয়েন্টে খুব ভাল র‍্যাঙ্ক করে খড়গপুরে ভর্তি হয়। ভাগ্যের অদ্ভুত চক্রে ঝুমাদিও তখন খড়গপুরে। রাজাবাজার থেকে এমটেক করে আইআইটিতে পিএইচডি করছে।


এরপরে যে কী হয় কে জানে – হঠাৎই বছর দুই পরে অমিত একদিন একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হোস্টেলের মধ্যেই নিজেকে শেষ করে দেয়। ঝুমাদিরও এরপরে আর কোন খবর পাওয়া যায় না। পিএইচডিটা কমপ্লিট না করেই খড়গপুর থেকে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তারপর প্রায় দীর্ঘ আঠেরো উনিশ বছর পর বর্ষার এক কুয়াশা মাখা সন্ধ্যায় কার্শিয়াং-এর এক জনবিরল রাস্তায় ঝুমাদিকে  আবিষ্কার করি! ঝুমাদিই বলে ও এখানে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করে – উঁচু ক্লাসে সাইন্স পড়ায়। আমাকে ওর বাড়ীতে যেতে বলে। কয়েকটা দিন ওর কাছে থেকে যাবার জন্যে অনুরোধও করে। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। পরদিন সকালেই শিলিগুড়ি ফিরে এসে রাত্রের ট্রেনে কলকাতা রওনা হই!


তিন

দার্জিলিং মেল শিয়ালদায় পৌঁছল আধ ঘন্টা লেট করে। আমি প্ল্যাটফরমেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। দূর থেকে ঝুমাদিকে আসতে দেখলাম। ঝুমাদি যেন একটু বুড়িয়ে গেছে। গত বছর কার্শিয়াং-এ যেমন দেখেছিলাম তার চেয়েও যেন একটু শুকনো রোগা রোগা লাগছে। সেটা এত লম্বা ট্রেন জার্নির জন্যেও হতে পারে। দেখতে পেয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ঠিক তখনই ঝুমাদির পাশে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখে বিস্ময়ে একেবারেই যেন হতবাক হয়ে গেলাম।

একটা ছেলে – আঠেরো উনিশ বছর বয়স! সেই চোখ, সেই মুখ, সেই নাক – নাকের ডানপাশে কাল রঙের একটা জড়ুল। পার্থক্য শুধু একটাই – রঙটা ঝুমাদির মতো ফর্সা আর চোখে একটা চশমা। ঠিক যেন আজ থেকে অনেক বছর আগে আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়া আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু – অমিত!


আমি বোধহয় কিছু একটা বলতে গেলাম। কিন্তু সে সুযোগই পেলাম না। তার আগে ঝুমাদিই কথা বলে উঠল। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটাকে বলল, “রনিত – প্রণাম কর। তোমার এক মামা। আমরা বাগবাজারে একই পাড়ায় থাকতাম।”


আমি এবারে নিজেকে একটু সামলে নিলাম। ঝুমাদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায় যাবে?”

ঝুমাদি উত্তর দিল। বলল, “আপাতত কাছাকাছি কোন একটা হোটেলে। তারপর একটু ফ্রেস হয়ে এগারোটা নাগাদ শিবপুরে – বেঙ্গল ইনজিনিয়ারিং কলেজে। রনিত ওখানে চান্স পেয়েছে – অন লাইনে টাকা পয়সা সব জমা করা হয়ে গেছে। আজ শুধু অফিসে গিয়ে ভর্তি হয়ে ওর হোস্টেল জীবনের শুরু। তাই ওকে দিতে এসেছি।


আমি নিজেই এখন কলকাতার কিছু চিনি না – প্রায় আঠেরো কুড়ি বছর পর এলাম – আর রনিত তো কোনদিনই আসেনি – তাই তোকে এই কষ্টটা দেওয়া।”


চার

রনিতকে হোস্টেলে রেখে হোটেলে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল। চলে আসার সময় আমারই গলার কাছটা কেমন যেন ব্যথা ব্যথা করছিল। কিন্তু ঝুমাদি বা রনিতকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নাই। দুজনের চোখই শুকনো খটখটে – চেহারাতেও কোন ভাবান্তর নাই! শুধু মাঝখানে রনিত একবার বলল, “তোমরা কি একটু চা খাবে? ক্যান্টিনে দিচ্ছে – অনেক গার্জেনরা খাচ্ছেন।”

ঝুমাদি রাজী হল না। বলল, “না– তুই খেয়ে আয়।”

ঝুমাদির চোখের জলটা দেখলাম ফেরার পথে ট্যাক্সিতে। সারা রাস্তা একটাও কথা বলল না। মাথাটা সীটে হেলিয়ে চুপ করে বসে রইল। তবে উল্টো দিক দিয়ে আসা গাড়ীর আলোতে ওর চোখদুটোকে জলে ভিজে চিকচিক করে উঠতে দেখছিলাম!


হোটেলে ফিরে ঝুমাদি বলল, “তুই একটু বস – আমি মুখে চোখে একটু জল দিয়ে আসি।“ তারপর হঠাৎই কী ভেবে কথা পালটে বলল, “না থাক – তোর সঙ্গে এখন একটু গল্প করি। তুই যাওয়ার পরেই না হয় ফ্রেস হয়ে একেবারে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ব। কাল আবার অনেক ভোরে ওঠা আছে।


জানিস তো আজ আমার খুব মন খারাপ করছে। আসলে রনিত জন্মানোর পর ওকে ছেড়ে তো কোনদিন থাকিনি। তুই যেদিন কার্শিয়াং-এ গিয়েছিলিস – সেদিন ডাউহীলে ওদের একটা ফাংশান ছিল। বলে গিয়েছিল বেশী রাত হলে ওখানে এক বন্ধুর বাড়ীতে থেকে যাবে। কিন্তু মাঝ রাতে ঠিক ফিরে এসেছিল।


খারাপ রনিতেরও লাগবে – খুবই কষ্ট হবে। তবে ও ঠিক সহ্য করে নেবে। এ দিক দিয়ে ও ওর বাপের মতোই চাপা। হাজার কষ্ট হলেও মুখ ফুটে কিছু বলবে না। এখন মনে হচ্ছে ক্যান্টিনে গিয়ে ওর সঙ্গে চা-টা খেয়ে এলেই হত। ছেলেটা এত বড় মুখ করে বলল – আমার না বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। ওরা যে বড্ড অভিমানী – ওদের অভিমানকে আমি খুব ভয় করি! 


আবার আজ খুব আনন্দও। একজনের ইনজিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন আমার জন্যে মাঝ পথে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই আর একজনকে হাত ধরে ইনজিনিয়ার হওয়ার সিংহ দুয়ারে পৌঁছে দিয়ে গেলাম। শুধু ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থনা – রনিতকে যেন ওর বাবার মতো আশাহত হতে না হয়। তা যে কোন ব্যাপারেই হোক না কেন।

জানিস তো রনিতের বাবার কথা বলতে গেলে এখনো আমার যেন মজা লগে! আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট একটা ছেলে। শ্যামলা শ্যামলা গরণ – এক মাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। বড় বড় দুটো চোখে আবেগ ভরা গলায় বলছে, ‘ঝুমাদি – তুই আমার জন্যে থাকবি তো – দু বছর পরে পাশ করে চাকরি পেয়েই আমি তোকে নিয়ে ঘর বাঁধবো– তোকে বিয়ে করব। আমি তোকে ভালবাসি!’

আমি না প্রথমটা কোন উত্তর দিতে পারিনি। কথাটাও ঠিক মতো বুঝতে পারিনি – কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া কী-ই বা উত্তর দেব। এদিকে ঝুমাদি বলছে – তুই করে ডাকছে, ওদিকে আবার প্রেমও নিবেদন করছে। বদ্ধ পাগল একটা!


এরপর থেকে ওকে দেখলেই আমি ওখান থেকে সরে যেতাম – রাস্তা ঘাটে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেখানেও বুকের ভেতরটা কেমন যেন খচ খচ করে উঠত। দেখতাম খুব শুকনো মুখে ছেলেটা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে!

একদিন তাই বললাম, ‘তুই কি পাগল হলি অমিত? আমি তোর চেয়ে বয়েসে কত বড়। তাছাড়া জীবনের কতটুকুই বা তুই দেখেছিস? আজ যেটাকে সত্যি বলে ভাবছিস কাল হয়ত সেটাকে মিথ্যা বলে মনে হবে। তখন আক্ষেপের সীমা থাকবে না। সারা জীবন সেই ভুলের মাসুল গুনতে হবে। তাই তুই এ সব কথা ভুলে যা – আমাকে মন থেকে সরিয়ে দে।‘

ও হাসত। নির্মল সে হাসি – যেন নীল আকাশের বুকে এক ঝাঁক সাদা পায়রা। বলত, ‘বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। কেউ পৃথিবীতে কয়েক বছর আগে এসেছে কেউ কয়েক বছর পরে। আমার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ তাই বয়স নিয়ে নয়। তোমার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ চিরকালীন নারী পুরুষের সম্পর্ক – একজন অন্যজনের পরিপূরক। আর জীবনকে কতটা দেখেছি – হ্যাঁ, অল্পই দেখেছি। বাকিটা না হয় তোমার হাত ধরে দেখব – তুমিই জীবনকে চেনাবে।‘


জানিস তো এরপরে আমিও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়তাম। কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে যেতাম। এই চুপ করে থাকাটাই বোধহয় ভুল ছিল। চুম্বকের মতো প্রবল আকর্ষণে ও আমাকে কাছে টানতে লাগল। চূড়ান্ত ঘটনাটা ঘটে গেল সেবার পুজোর বন্ধের পর বাড়ী থেকে ক্যাম্পাসে ফেরার পথে!


সেবার পুজো ছিল সেপ্টেম্বরের শেষে। বর্ষা তখনো বিদায় নেয়নি। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টি আরম্ভ হল – সঙ্গে ঝড়। চারিদিক একেবারে জলমগ্ন হয়ে পড়ল। অধিকাংশ রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। অথচ তারপর দিন আমায় খড়গপুর ফিরতেই হবে। থিসিসের একটা ড্রাফ্‌ট ইউনিভারসিটিতে জমা করতে হবে। খবর পেয়ে অমিত আমার সঙ্গ নিল। বাড়ীতে বলল স্পেশাল ক্লাস আছে। কিন্তু মেচেদার পর ট্রেন আর চলল না– স্টেশনেই দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ পর সন্ধের ঠিক আগে মাইকে ঘোষণা করল ট্রেন আর যাবে না– জলের তোড়ে সামনের লাইন ভেসে গেছে। হাওড়াতেও ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ, কারণ স্টেশনের কাছে একটা কালর্ভাট ভেঙে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমরা ঐ কালভার্ট দিয়েই পার হয়ে এসেছি। 


কী করব বুঝতে না পেরে ঠিক করলাম আশেপাশে কোন একটা হোটেলে রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে যা করার করব। সেই মতো স্টেশনেরই খুব কাছে একটা লজে ঘর ভাড়া করলাম। একটাই মাত্র ঘর। অত্যন্ত নোংরা পরিবেশ, অপরিচ্ছন্ন বাথরুম, তেল চিটচিটে স্যাঁতসেঁতে বিছানা। কিন্তু ও সব কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াল না। আমরা ওরই মধ্যে একে অপরের শরীরে ভালবাসার চিহ্ণ এঁকে দিলাম!

আমার চমক ভাঙলো এর প্রায় মাস খানেক পর। কিছুদিন ধরেই শরীরের মধ্যে একটা কিছু পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎই একদিন অনুভব করলাম আমি মা হতে চলেছি! মুহূর্তেই আমার চারিদিকে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেল। আমার সাধের মিনারগুলো সব যেন ধ্বসে পড়ল। আমি ভয়ে উৎকণ্ঠায় কেমন যেন পাগল হয়ে গেলাম। আমার সব রাগ গিয়ে পড়ল অমিতের ওপর। ভুলে গেলাম যে ঘটনাটার জন্যে আমরা দুজনে সমান ভাবে দায়ী!


পরদিনই অমিতের সঙ্গে দেখা করে ওকে যা নয় তাই বলে অপমান করলাম। বললাম, ‘তুমি আমার জীবনের মুর্তিমান শনি। আমার জীবনটা শেষ করে দিতেই তোমার আসা। তুমি আর কোনদিন আমার সামনে এস না। আমার কেরিয়ার আমি ধ্বংস হতে দেব না – এ সন্তান আমি রাখব না।’

ও এবারে কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে পড়ল। ভাঙা গলায় প্রায় ফিস ফিসিয়ে বলে উঠল, ‘কী বললে – আমি তোমার জীবনের শনি? তোমায় শেষ করে দিতেই আমার আসা – এ সন্তান তুমি রাখবে না? কিন্তু আমরা তো দুজন দুজনকে ভালবাসি। এ তো আমাদের ভালবাসার ফল। একে তুমি শেষ করে দেবে – পৃথিবীর আলো দেখতে দেবে না? কিন্তু কেন? যে কাজটা আমরা দু বছর পরে করতাম সেটা না হয় এখনি করি – চল রেজিস্ট্রি করি।’

আমি রাগে যেন প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলাম। ব্যঙ্গ করে বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ – তাই বৈকি! কিন্তু তারপরে আমায় খাওয়াবে কী? আর আমার রিসার্চ – সেটার কী হবে? ছেলে ট্যাঁকে করে আমি ল্যাবোরেটারী যেতে পারব না। তাছাড়া দু বছর পরেই যে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে তারই বা নিশ্চয়তা কী?’


ও এবারে কেমন যেন শান্ত হয়ে পড়ল। খুব নরম গলায় আমায় বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘এ নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি সব সামলে নেব। কিন্তু কখনোই আজেবাজে কথা চিন্তা করো না। আমাদের থেকে সৃষ্টি হওয়া প্রাণকে হত্যা করো না।’

আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চিৎকার করে উঠলাম, ‘না কিছুতেই না– এ ব্যাপারে আমি তোমার কথা মানব না।’


ও এবারে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে পড়ল। হতাশ গলায় বলে উঠল, ‘ঠিক আছে– তোমার যা ইচ্ছা তাই তুমি করো। তবে ঐ প্রাণকে খুন করার আগে আমার মরা মুখ দেখ।’

আমি উত্তর দিলাম। রাগে অন্ধ হয়ে বলে উঠলাম, ‘হ্যাঁ– দরকার হলে তাই দেখব।’


ও এবারে কেমন যেন হতবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে চলে গেল। ওহঃ! সে কী যন্ত্রণা বিহ্বল ভঙ্গি তা বলে বোঝাতে পারব না! পর দিন সকালেই খবর পেলাম, ও এক পাতা ঘুমের ওষুধ খেয়ে সকলের অলক্ষে নিজেকে চিরতরে ছুটি করে দিয়েছে!


ঝুমাদির কথা শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ কোন কথা বলে উঠতে পারলাম না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু কার্শিয়াং– ওখানে তুমি গেলে কী করে?”

ঝুমাদি উত্তর দিল। খুব ভারি গলায় বলে উঠল, “আসলে ও একটা সুইসাইড নোট লিখে গিয়েছিল। তাই আমাকে তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। নইলে আমাদের সম্পর্কের কথা তো অনেকেরই জানা ছিল। তবু আমাকে একবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। থানার যিনি অফিসার ইনচার্জ ছিলেন তাঁকে দেখেই আমার মনে হল মানুষটা বোধহয় ভাল– এঁকে সব কিছু খুলে বলা যায়।


সব শুনে মানুষটা আমায় বললেন, ভেঙে পড়ো না মা – আর নিজের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া প্রাণটাকে শেষ করে দিও না। উনিই আমার জন্যে ফাদার দিমিত্রিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। ফাদার তখন কার্শিয়াং-এ এই স্কুলটা গড়ে তুলছেন। ব্যস – তারপর থেকে কার্শিয়াং-এই আছি। রনিতও কার্শিয়াং-এ জন্মেছে। রনিতের জন্মের পর ফাদার বলেছিলেন, এখন থেকে আর পশ্চিমের দিকে তাকিও না মাই চাইল্ড – শুধু পুবের দিকে দেখ!

সে ফাদারও আর নাই। দু বছর আগে মারা গেছেন। ওঁর তখন বিরানব্বই বছর বয়স। ফাদার মজা করে বলতেন, ভয় নাই – সেঞ্চুরী না করে আমি আউট হচ্ছি না!


তুই কিন্তু মাঝে মাঝে রনিতের খোঁজ নিতে শিবপুরে যাস। আমার জন্যে নয় – রনিতের জন্যেও নয় – তোর বন্ধুর জন্যে এই কষ্টটা করিস। তোর বন্ধু  যে বড্ড একলা!”


বলতে বলতেই ঝুমাদির গলাটা কেমন যেন ধরে এল। ঝুমাদি এবারে হেসে উঠল– নাকি কেঁদে উঠল? ঠিক বুঝতে পারলাম না! এ যদি হাসি হয় তবে এর মতো করুণ হাসি পৃথিবীতে আর নাই! আর যদি কান্না হয়– তবে তা যেন শুধুই বুক ভরা হাহাকার!


না, শিয়ালদায় নয়– রাতের ট্রেনেও নয় – পরদিন ভোরে যখন কলকাতা স্টেশনে ঝুমাদিকে হলদিবাড়ী এক্সপ্রেসে তুলে দিলাম তখনও ট্রেন ছাড়তে বেশ কিছুটা দেরী। কিন্তু ইতিমধ্যেই কলকাতা শহর পুরানো দিনকে পেছনে ফেলে এক নতুন সকালে পা ফেলেছে। একরাশ সোনা রোদ্দুরে চারিদিকে যেন আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। রাতের ঘন অন্ধকার কেটে গিয়ে ঝুমাদিও সেই রোদ্দুরে আজ ঝলমল করে উঠছে!


ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেল। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে ইঞ্জিনটা ভোঁ দিল। আমি ট্রেনের ধার থেকে সরে দাঁড়ালাম। ঝুমাদি চিকচিকে চোখে হাত নাড়ল – আমিও হাত নাড়লাম। ট্রেন ছেড়ে দিল – যেন এক মুঠো রোদ্দুরকে বুকে করে সে তার আপন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল!

চিত্র - শ্রীহরি

Comments