মহাবিদ্যা
চোরদের আর একটা নাম নিশিকুটুম্ব। আসলে আগে একটা সময় ছিল যখন তস্করদের সময়জ্ঞান ছিল তারিফ করার মতো।তারা সাধারনত রাতের বেলা কুটুম্ব বা আত্মীয়ের মতো বেড়াতে আসত গৃহস্থের অন্দরমহলে। কেউ আসত সিঁধ কেটে। মাটির বাড়িতে সিঁধেলকাঠি দিয়ে গর্ত খুঁড়ে তারা অনায়াসেই সেঁধিয়ে যেত ভেতরে। সংস্কৃত চৌর শব্দ ভেঙে এই চোরের জন্ম। আগে একটা ধারণা ছিল, চুরি মানে হল না বলে পরের দ্রব্য নেওয়া। সেই যুগ পালটে গেছে। এখন চোরেরা নিজের জিনিসও অনেক সময় চুরি করে। লেখকদের কারও কারও ক্ষেত্রে এই বিশেষ প্রতিভাটি লক্ষ করা যায়। অনেক সময় নিজেরই পূর্বপ্রকাশিত গল্প চুরি করে সেটি অন্য পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। এই রকম উদাহরণের অভাব নেই। আসলে, চুরি একটা দারুণ শিল্প। সেই জন্যই তো প্রবাদটা এখনও মুখে মুখে ফেরে ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ে ধরা'।
যুগের সঙ্গে চুরির ধরণ ধারণ পালটাবে এ তো প্রত্যাশিতই। সবাই যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে চোর কি সেক্ষেত্রে বসে বসে হা পিত্যেশ করবে? করা উচিতও নয়। তাই এই মহাবিদ্যাতেও সমকালীন সময়ে উপলব্ধ ডিজিটাল আশীর্বাদ যুক্ত হয়েছে। ইন্টারনেটের দৌলতে পরদ্রব্য চুরি করা এখন খুবই সহজ ব্যাপার। কোথাও না গিয়ে আপনি সেই জায়গার বিবরণ চুরি করলেন, তারপর এমন ভাবে তার বর্ননা করলেন যেন আপনি হাতের তালুর মতো সেই এলাকাটিকে চেনেন। যিনি অনেক ঘাম ঝরিয়ে পাকদন্ডী পেরিয়ে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা খুব খেটে নেটে শেয়ার করলেন, আপনি এসি ঘরে বসে সেইটিই বেমালুম টুকে দিলেন আপনার আখ্যানে। চুরি নয় ,আপনার সেই কাহিনি যখন প্রকাশ হল শত সহস্র পাঠক সেটি পড়ে সাবাশ সাবাশ বলে হাততালি দিয়ে উঠল। আরে বাবা, এমনিই কি এই বিদ্যাকে মহাবিদ্যা বলে?
অন্য সাধারণ মানুষের মতো চোরদের ক্ষেত্রেও চরিত্রগত শ্রেণীবিন্যাস থাকে। কোনও চোর সাহসী হয় তো কোনও চোর ভিতু। কোনও চোর অতি চালাক হয় তো কোনও চোর আবার নির্বোধ। যেমন সেদিন শুনলাম, একটি নির্বোধ চোরের দল টাকা ভর্তি এটিএম মেশিন চুরি করতে গিয়ে, বহু পরিশ্রমের পর, ভুল করে পাশবই প্রিন্ট করার মেশিন চুরি করে এনেছিল। একেই হয়ত আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘আমও গেল ছালাও গেল‘। মানুষের মধ্যে যেমন মানবিকতা আছে চোরেদের মধ্যেও আমার কিছু কিছু চোরাবিকতা থাকে।
কিছুদিন আগে এক নামজাদা প্যাথলজিকাল ল্যাবে চুরি হল। দামি দামি যন্ত্র, টাকাপয়সা সব চুরি করে নিয়ে গেল চোরের দল। কিন্তু চোরাবিকতার কারণে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান ইউরিন বা স্টুলের কোনও স্যাম্পেলই তারা সঙ্গে নিয়ে যায়নি। এমনকি তাতে হাতও ছুঁইয়ে দেখেনি তারা। এ প্রসঙ্গে বহুদিন আগে শোনা একটা গল্প মনে পড়ছে। সারারাত ধরে চুরিচামারি করার পর ভোরবেলা কোনও এক গুপ্তঘাঁটিতে বসে চোরের দল নিজেদের মধ্যে টাকাপয়সা সোনাদানা ভাগবাঁটোয়ারা করছিল। এই কর্মব্যস্ততার মধ্যে অতি চালাক এক চোর একজোড়া কানের দুল চালান করে দিল তার জামার পকেটে। চোরের দলের যে সর্দার ছিল সে বড়ই অভিজ্ঞ। এই মহাবিদ্যার সাইড এফেক্ট তার অজানা নয়। সর্দার সেই অতি চালাক তথাপি মহাবিদ্যায় অর্ধশিক্ষিত চোরটিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, তোকে না কতদিন বলেছি জীবনে একটু ভাল হবার চেষ্টা কর। এইভাবে চুরিচামারি যদি করিস তো জীবনে উন্নতি করবি কী করে?
চোরেদের আর একটি ক্ষমতা হল সে ধরা পড়ে গেলেও তার আশেপাশের মানুষদের বুদ্ধিকে সাময়িক ভাবে ফ্রিজ করে দিতে পারে। তারা পালিয়ে যাবার পর সেই বুদ্ধি আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসে কখনও কখনও আবার বেড়েও যায়। এই কারণেই ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে' এই আপ্তবাক্যটি আজও সমাদৃত। আমার সহকর্মীর গাঁয়ের বাড়িতে একটা চোর উঠেছিল তাঁর বাগানের সুপুরি গাছে। সুপরিকল্পিত ভাবে সুপুরি লোপাট করে দেওয়াই ছিল তার বাসনা। দু একটা পাকা সুপুরি ওপর থেকে টিনের চালে পড়তেই তিনি জেগে যান। তখন সবে আলো ফুটবে ফুটবে করছে। গাছের ডগায় চোরকে দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠে বলেন– এই তুই কে রে? গাছে উঠেছিস কেন? তাঁকে দেখেই চোরটি তরতর করে গাছ বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ একটা ব্রেক নিয়ে খুব ভালোমানুষের মতো মুখ করে বলে। - আজ্ঞে বাবু, আমি ঘাস কাটতে এয়েছিলেম গো। এ কথার উত্তরে ভদ্রলোক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠেন, আমাকে কি বোকা পেয়েছিস নাকি? সুপুরি গাছের ওপরে কি ঘাস থাকে? এই কথার উত্তরে একটুও না ঘাবড়িয়ে চোরটি বোকার মত মুখ করে বলে। আজ্ঞে বাবু, আমি কি আর ছাই আপনাদের মতো নেকাপড়া জানা মানুষ? ওপরে উঠে দেখলাম ঘাস নেই, তাই তো নেমে আসছিলাম গো। তখনই তো আপনি আমাকেরে ডাক দিলেন! এহেন যুক্তির আকস্মিকতায় ভদ্রলোক চোরটিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন। যদি কখনও খেয়াল করেন যে আপনার বুদ্ধি আগের তুলনায় ঈষৎ বেড়ে গেছে, ধরে নেবেন, আপনারও কিছু খোয়া গেছে তস্করের হাতে। যা আপনি পরে টের পাবেন।
![]() |
চিত্র - শ্রীহরি |
বেশ রম্য গদ্য। পড়ে খুব আনন্দ পেলাম।
ReplyDeleteবেশ মজার l ভালো লাগলো l
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete