প্রবন্ধ - শৌভিক রায়

বক্সা: ফিরে দেখা আর একবার

ডুয়ার্স বলতেই মন নেচে ওঠে আনন্দে। আর সেটা হবে না-ই বা কেন? এত মনোরম ভুখন্ড ভারতের খুব বেশি জায়গায় নেই। শুধু গহন অরণ্য, হিংস্র শ্বাপদ, তরঙ্গায়িত চা-বাগান, খরস্রোতা নদী আর উন্মুক্ত প্রান্তরই এই এলাকাকে সুন্দর করেনি। এখানকার বর্ণময় সাধারণ মানুষ ও অজস্র জনজাতি সেই সৌন্দর্য্যকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। ফলে, পর্যটক তো বটেই, স্থানীয় মানুষেরাও তাদের নিজেদের ডুয়ার্সের নানা স্থানের টানে ছুটে যান বারেবারে এদিক সেদিক। কিন্তু এই সব কিছুর পরেও একটা কথা ভুললে চলবে না যে, ডুয়ার্স এত সুন্দর হত না, যদি না তার ইতিহাসটি সমৃদ্ধ হত!

বক্সা ফোর্ট


'ডুয়ার্স' শব্দটির উৎস কী? ইতিহাস বলছে যে, অতীতে ভুটানের পার্বত্য এলাকা থেকে সমতলে আসবার জন্য মোট ১৮টি গিরিপথ ব্যবহৃত হত। এই গিরিপথ বা দুয়ারকে ইংরেজরা 'ডোর' বলতেই অভ্যস্ত ছিল। বহুবচনে 'ডোর' হল 'ডোরস'। আর 'ডোরস' কালক্রমে লোকমুখে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে 'ডুয়ার্স'-এ পরিণত হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, 'দুয়ার' শব্দটিও কিন্তু 'ডোর' অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই দুয়ার থেকেও ডুয়ার্স কথাটির উদ্ভব- এই মতামতটিও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। 

ফোর্ট অভ্যন্তর


আঠারো দুয়ারের অন্যতম এক ডোর বা দুয়ার, বক্সা ডুয়ার্স ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ জায়গা। বিরাট টাইগার রিজার্ভ, অজস্র নদনদী, আদিম অরণ্য, বনচারী প্রাণী, প্রজাপতির ভূস্বর্গ বক্সাকে ভুটানিরা বলতো 'পাশাখা' অর্থাৎ বনজঙ্গলের জায়গা। ১৭৮৪ সালে আঁকা লেফটেন্যান্ট ডেভিসের ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চল ছিল গা-ছমছমে অরণ্যে ভরা। আজ সেই পরিবেশ অবশ্য অনেকটাই পরিবর্তিত। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল তো অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই একসময়ে যে অরণ্য ভেদ করে মাটিতে সূর্যের আলো পড়ত না, আজ অবশ্য সে অরণ্য অনেকটা হালকা হলেও, বক্সার মেজাজ সেই একই আছে।  

চিঠির প্রতিলিপি


অতীতের পাশাখা আসলে ছিল বিনিময়ের জায়গা। এখানকার গিরিপথ দিয়েই 'টাঙ্গন' নামের তেজি ঘোড়া ভুটান থেকে বিনিময় প্রথায় পাঠানো হতো রংপুরের হাটে। তাই, বক্সা বলতে বিনিময়ের জায়গাকেও বোঝাত। বিনিময়ের হাত ধরেই, এই ঘোড়া পাওয়ার জন্য, কোচবিহার একসময় ফালাকাটাকে ইজারা দিয়েছিল ভুটানের হাতে। রংপুরে এখনো ছটফটে মেয়েদেরকে 'টাঙ্গন' বলার পেছনে অতীতের সেই ঘোড়ার ইতিহাস রয়েছে বলে মনে করা হয়। ভুটানিদের প্রথা ছিল বিক্রির সময় ঘোড়ার লেজের কিছু অংশ কেটে নেওয়া। পরবর্তীতে ভুটানের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তি হলে ইংরেজরা সে প্রথা বন্ধ করে বকশিস দিয়ে। তাই 'বকশিস' থেকে বক্সা কথাটির সৃষ্টি, এ কথাও বলে থাকেন অনেক ঐতিহাসিক। চুক্তি অনুসারে ভুটান কোম্পানিকেই ঘোড়া সরাবরাহ করত। তাই আদিম অরণ্যের পাশাখা বা বক্সা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল বাণিজ্যের অন্যতম স্থান।

তবু এই অঞ্চলের জন্য সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ইংরেজদের প্রথমে খুব একটা উৎসাহ ছিল না। কেননা বক্সার বিপুল সম্পদের বিষয়টি তাদের কাছে তখনও অজানা ছিল। এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কথাও তারা ভাবে নি। বরং ইংরেজরা অনেক বেশি উৎসাহী ছিল ভুটানের মধ্যে দিয়ে তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনে। আর সেই সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে ভুটানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে, ভুটানের সঙ্গে তারা বৈরিতার সম্পর্কে যেতে চায় নি। কিন্তু ১৭৭৩ সালে কোচবিহার আর কোম্পানির চুক্তি অবস্থার পরিবর্তন আনে। এর প্রায় ষাট বছর আগে অর্থাৎ ১৭১৪ থেকে ভুটান আর কোচবিহারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। কোচবিহারের অবস্থানগত সুবিধের জন্য কোচবিহারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। সেই সুবাদেই ভুটানের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাঁধে। 

পথ


যুদ্ধ শেষে ভুটানিরা পিছিয়ে গেলে, ১৭৭৪ সালে কোম্পানির সঙ্গে ভুটানের চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে কিন্তু কোম্পানিকে ডুয়ার্সের অনেকটা অংশ ছাড়তে হয়। কেননা ভুটানে তিব্বতের প্রতিনিধি তাসি লামার মধ্যস্থতায় ততদিনে ইংরেজরা তিব্বতে বাণিজ্যের জন্য কিছুটা সুযোগ-সুবিধে আদায় করতে পেরেছিল। আর তার পরিবর্তে ছাড়তে হয়েছিল ডুয়ার্সের বিরাট অংশ। এই অবস্থা চলেছিল ১৮৬৪ সাল অবধি। পাশা পালটায় যখন ওই বছরই বাণিজ্যিক বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া অ্যাশলে ইডেনকে ভুটানে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়। মূলত তাঁর বয়ান ও পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করেই শুরু হয় দ্বিতীয় ভুটান যুদ্ধ। 

১৮৬৫ সালে যুদ্ধ শেষে ১১ই নভেম্বর সিনচুলা চুক্তির ফলে ডুয়ার্স ইংরেজদের দখলে আসে। বক্সা পায় মহকুমার মর্যাদা। ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলা গঠিত হলে মহকুমা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ফালাকাটায়। কিন্তু প্রশাসনিক অসুবিধার জন্য মহকুমা আবার ফেরানো হয় বক্সাতে, ১৮৭৪-৭৫ সালে। তবে দু'বছর পরেই ১৮৭৬ সালে আলিপুরদুয়ারকে মহকুমা ঘোষণা করা হলেও বক্সার প্রশাসনিক গুরুত্ব কিন্তু কমে নি। কেননা ইংরেজদের কাছে ভুটান-ভারতের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলটি অন্যদিক দিয়েও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল এবং তা ছিল বক্সার প্রকৃতি। এই প্রসঙ্গে অ্যাশলে ইডেনের কথা বলা যেতে পারে। তাঁর অভিমত ছিল যে, এই অঞ্চল ছিল তুলা ও মূল্যবান কাঠ সংগ্রহের জায়গা, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। পরবর্তীতে সার্জেন রেনিও ডুয়ার্সের জমিকে উর্বর বলে অভিহিত করেছিলেন। 

বক্সার উত্তরে সিনচুলা পাহাড়শ্রেণীর ফিপসু অভয়ারণ্য, পূর্বে অসমের মানস আর দক্ষিণ-পশ্চিমে জলদাপাড়া-চিলাপাতার গভীর অরণ্য। হাতির মুক্তাঞ্চল ছাড়াও বক্সার জঙ্গলে মেলে বাঘ, বুনো শুয়োর, বাইসন, শম্বর, পাইথন, লেপার্ড ইত্যাদির মতো প্রাণী। বনাঞ্চলের ভেতরেই রয়েছে রায়ডাক ও জয়ন্তী নদী। খানিক দূরে ডিমা ও বালা নদী। পূর্বে সংকোশ ও পশ্চিমে তোর্ষা খুব একটা দূরে নয়। আজও বক্সার গহীন অরণ্যে দিনের বেলাতেও ঝুপি ঝুপি অন্ধকার নামে। চলার পথে যে কোনো মুহূর্তে পথ আটকাতে পারে স্বয়ং গজরাজ বা যুথবদ্ধ বাইসন। ১৭৮৪ সালে লেফটেন্যান্ট ডেভিস ও  ১৮৩৮ সালে উইলিয়াম গ্রিফিথ বক্সার দূর্ভেদ্য জঙ্গল ও অপরূপ শোভায় মোহিত হয়ে বক্সার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে,  গ্রিফিথ ১৮৩২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৮৪২-৪৪ সালে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ড হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রকৃতি-প্রেমিক গ্রিফিথের বা ডেভিসের সেদিনের বিবরণ থেকে আজকের বক্সার খুব কিছু অমিল পাওয়া যায় না।

পোস্ট অফিস


আজকের বক্সা বলতেই মনে পড়ে যায় আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া হয়ে অরণ্য সঙ্গী করে এগিয়ে চলা। মাঝে ডানদিকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে পথ জয়ন্তীর দিকে। সোজা আরও কিমি পাঁচেক এগোলে সান্ত্রাবাড়ি বা সানতালাবাড়ি। নিতান্তই ছোট্ট জনপদ। সামান্য কয়েক ঘর মানুষের বসবাস। আছে কিছু দোকানপাট, প্রাথমিক বিদ্যালয় আর আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে 'হোম স্টে'। এখান থেকেই পাহাড়ি চড়াইয়ে দশ কিমি হাঁটলে পৌঁছনো যায় এমন একটি ফোর্টে, যাকে ঘিরে থাকা রহস্য, পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা কুয়াশার মতোই জমাট। 

ব্রিটিশ আমলে আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই ছিল দুর্গম ও দুর্ভেদ্য, বক্সা ফোর্ট, ডুয়ার্সের তো বটেই, উত্তরবঙ্গের গর্ব। হিংস্র শ্বাপদের গা ছমছমে বক্সা জঙ্গলের উত্তরে, সিনচুলা পাহাড়ে, ২৮৪৪ ফিট উচ্চতায়, কে বা  কারা ফোর্টটি নির্মাণ করে সে বিষয়ে স্পষ্ট জানা যায় না। কারো মতে ফোর্টটি তিব্বতিদের তৈরী, কেউ কেউ মনে করেন কামরুপীরা ছিলেন এর নির্মাণের পেছনে। আবার ভুটিয়ারা এই ফোর্টের নির্মাতা এরকমটাও মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। আরও ওপরে ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে রোভারস পয়েন্ট। মাত্র ১১ কিমি দূরে ভুটান। সিনচুলা গিরিপথ পেরোলেই অসামান্য রূপম উপত্যকা। 

বক্সা ফোর্ট কবে তৈরী সে নিয়ে বিতর্কের মাঝে কিছু তথ্য জরুরী। মনে করা হয়, ১৬৬১ সালে প্রাণভয়ে ভীত কোচবিহার-রাজ প্রাণনারায়ণ এই ফোর্টে এক বছর কাটিয়ে ছিলেন। ফোর্টটি তখন 'জং' নামে পরিচিত। পরবর্তীতে 'জং'-এর অধিকার নিয়ে লড়াই বেঁধে থাকতো ভুটান ও কোচবিহারের। প্রথম ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধে, ইংরেজ ক্যাপ্টেন জোনস ১৭৭৩ সালে বক্সা অধিকার করলেও, ১৮৬৫ সালে সিনচুলা চুক্তি অনুসারে ফোর্টটি পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশদের দখলে আসে এবং 'জং` বা দুর্গের দখল নেয় তারা।

বক্সা ফোর্টের দখল নিয়ে ব্রিটিশরা  কিছু সংস্কার করেছিল। ফোর্টটি পাথরের দেওয়ালে মুড়ে ফেলা হয়, টিনের ছাদ দেওয়া হয়। নির্মিত হয় অফিসারদের থাকবার ঘর, পোস্ট অফিস। জলের ব্যবস্থাও করা হয়। বক্সাকে দেওয়া হয় মহকুমার মর্যাদা। ১৮৭৩ সালে সেনা মোতায়েন-সহ তিনটি পিকেট বসানো হয় বক্সায় এবং পরের বছর বক্সাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় মহকুমার মর্যাদা। ১৯০১ সালে রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ চালু হলেও ফোর্টের দুর্গমতা কিন্তু একই থেকে যায়। ১৯১৪ থেকে ১৯২৪ অবধি মিলিটারি পুলিশের ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ফোর্টটি। অবশেষে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে ১৯৩০-এ জেলখানায় বদলে যায় ফোর্ট। দুর্গম এই ফোর্টে বন্দি হয়েও সেদিনের স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা দমে যাননি। তবে এই ফোর্টে নেতাজি সুভাষকে বন্দি রাখা হয়েছিল বলে যে কথা শোনা যায় তা ঠিক নয়। স্বাধীনতা-সংগ্রামী তৈলক্যনাথ চক্রবর্তীকে অন্য বন্দীরা 'নেতাজি' সম্বোধন করতেন। সম্ভবত সেখান থেকেই নেতাজি সংক্রান্ত বিপত্তি। এই ফোর্ট থেকেই ১৯৩১ সালে বন্দিরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁকে অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বকবি প্রত্যুত্তরও দিয়েছিলেন। ফোর্টে প্রবেশের মুখে খোদাই করা দুটো পত্রই দেখা যায় আজও। স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের এখানে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল। সেই বন্দিদের মধ্যে ছিলেন পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ অবধি তিব্বতি রিফিউজি ক্যাম্প ছিল ফোর্টে।১৯৭১-৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদেরও  আশ্রয় দেওয়া হয় এখানে এবং শেষ অবধি ১৯৭৬-৭৭ সালে পরিত্যক্ত হয় ফোর্ট। 

লেপচাখা

 

১৯৮০ সালে জাতীয় স্মারকের ঘোষণা হলেও, আজ কিন্তু বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে আজকের বক্সা ফোর্ট। বক্সাকে নিয়ে প্রবন্ধ-উপন্যাস-গল্প-কবিতায় বহু লেখালিখি হলেও বর্তমান বক্সা ফোর্টের চারদিকে ধ্বংসস্তুপ কেবল! সান্ত্রাবাড়ি থেকে এখনও পাঁচ-ছয় কিমির উঁচু-নীচু পাহাড়ি  হাঁটা পথে যেতে হয় ফোর্টে। অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশে, ফোর্টের বিপরীতে দেখা মেলে নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, ফরেস্ট রেস্ট হাউস, পোস্ট অফিস ও  কিছু বাড়িঘরের। কিন্তু ফোর্টের ভগ্নদশায় মন খারাপ হয়ে যায়। ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদের প্রতি এই অবহেলা সত্যি অকল্পনীয়। কে বিশ্বাস করবে যে, কয়েক দশক আগেও লোহার গেট, পাহারাদার, দেওয়াল, আংটাবেড়ি ইত্যাদি দেখা যেত এই দুর্গে। কাঁটাতারে ঘেরা থাকত এলাকা। কাকপক্ষীও ঢুকবার সাহস পেত না। বক্সা ফোর্ট নিয়ে আলোকপাতের অবকাশ আজও রয়ে গেছে। বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ সত্ত্বেও অজানা কারণে বক্সা ফোর্ট অবহেলিত। জানা নেই কবে ঘুচবে এই অন্ধকার, কবে যোগ্য মর্যাদা পাবে ইতিহাসের বক্সা ফোর্ট। ফোর্ট থেকে আরও অনেকটা ওপরে, চার কিমি হাঁটাপথে চলে যাওয়া যায় লেপচাখায়। চাঁদনি রাতের পাহাড়ি লেপচাখা থেকে বহু নিচের বক্সা টাইগার রিজার্ভের অসামান্য নৈসর্গিক দৃশ্য সত্যিই 'লাইফটাইম এক্সপিরেয়েন্স'। আকর্ষণ করে লেপচাখার বৌদ্ধ মন্দির, চোর্তেন, নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর অতি অবশ্যই হাসিমুখের পাহাড়িয়া মানুষেরা। 

এমনিতে বক্সা অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ড্রুকপা ও নেপালি। দারিদ্র তাদের নিত্যসঙ্গী। আধুনিক সমস্ত রকম সুযোগসুবিধা বিচ্ছিন্ন কোন এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা তারা। অতীতে যখন পাম্প ঘর, বনবিভাগের অফিস, পি ডব্লু ডি অফিস ইত্যাদি ছিল, তখন তবু এখানকার বাসিন্দাদের রুটিরুজি ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে আজ সবকিছুই অতীত। সেই সান্ত্রাবাড়ি বা জিরো পয়েন্ট থেকে মাথায় করে গ্যাস সিলিন্ডার বা পিঠে চাপিয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ওপরে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট কবে বন্ধ হবে কেউ জানে না। রাস্তা তৈরির কোনও পরিকল্পনা আজ অবধি শোনা যায় নি। এমনিতেই ১৯৯৩ সালের বন্যা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে অনেকই পাল্টে দিয়েছে। নতুন করে তাই কবে কী হবে সবই অজানা। কষ্ট তাই এখানকার মানুষদের গা সওয়া। তবু এত কষ্টের মধ্যেও মুখে লেগে থাকে সরল হাসি। সদরবাজার, লাল বাংলো ও দাঁড়াগাঁওয়ের বক্সাদুয়ারে আজকাল সমবায় প্রথায় পর্যটনের দিকে নজর রেখে গাইডের কাজ করেন বহু মানুষ। অবশ্য প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই সামান্য। তবু কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে তাদের হাসিমুখ আর বক্সাকে চেনাবার অদম্য ইচ্ছে পর্যটকদের খুশি করে বৈকি!    

ড্রুকপা গ্রাম


উত্তরবঙ্গের অন্যতম আকর্ষণ বক্সা অনন্য। তবে দুর্ভাগ্য এটাই যে, আমরা অধিকাংশই বক্সার সমৃদ্ধ ইতিহাস জানি না। আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে কোনও কিছুতেই এই বিষয়ে কিছু জানানোও হয় না। ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে, একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইতিহাস ও কৃষ্টি শুধুমাত্র অজ্ঞতার জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে। বক্সা ফোর্টে প্রত্যেক বছর স্বাধীনতা দিবসে যে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হয় তা টেক্কা দিতে পারে অনেক নামী উদযাপনকে। কিন্তু ক'জন তার খোঁজ রাখি? বক্সার পরিচয় যেন আজ টাইগার রিজার্ভ, কিছু হোম স্টে আর ট্রেকিঙের একটি পথের মধ্যেই সীমাবদ্ধ! কিন্তু বক্সার সঙ্গে ভারতের গর্বের যে ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তা যদি আমরা ভুলি, তবে সময় আমাদের ক্ষমা করবে না। 

বি - শৌভিক রায়

Comments