গল্প - গীর্বাণী চক্রবর্তী

সুগন্ধি ভালোবাসার কিছুক্ষণ 


কালচে লাল  পর্দাটার আড়ালে মধুরিমা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভেতর তন্ময়দা নীলচে শিশিটা থেকে তরলটা অল্প অল্প করে স্প্রে করে কখনও ঘাড়ে লাগাচ্ছে, কখনও হাতে আবার কখনও কনুইয়ের ঠিক নীচে। এই নীল শিশির সুগন্ধিটার নাম জানে না মধুরিমা কিন্তু এর সুগন্ধ সমস্ত চেতনাকে অবশ করে দেয় তার। সুগন্ধিত বাতাসে মধুরিমার চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য বুজে আসে। তারপরেই তীব্র সুগন্ধের ঝাপটায় চমকে তাকায় ষোড়শী মধুরিমা। তন্ময়দা ভীষণ কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাই পাওয়ারের চশমার আড়ালে স্বপ্নময় মায়াবী চোখে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মধুরিমা ধরা পড়ে গেছে। মধুরিমা ওখান থেকে পালাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। এক অদ্ভুত ভালো লাগা পল অনুপলে ছড়িয়ে পড়ছে। 



মধু পাঁচটা বাজে। যাবে না হাঁটতে? মধু কি হল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? স্বামী রীতেশের ডাকে মধুরিমা ধরফর করে উঠে বসে। সত্যি তো প্রত্যেকদিন ভোরে মধুরিমাই তো উঠে রীতেশকে ডাকে। আজকে যে কি হল! মধুরিমা আলুথালু ভাবে বিছানায় বসে থাকে। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো ও। কিন্তু নীল শিশির সেই তরলের সুগন্ধটা তো এখনও বাতাসে স্থির হয়ে আছে ! 


রীতেশ ততক্ষণে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে রেডি হতে থাকে। খাটের উল্টোদিকে বিশাল দেয়াল আলমারির পাশে কারুকার্যময় মেহগনি টেবিলটার ওপর থরে থরে রীতেশের রিটায়ারমেন্টের ফেয়ারওয়েলের উপহারগুলো সাজানো। কালকে রীতেশের অফিসে ওর রিটায়ারমেন্টের ফেয়ারওয়েলের অনুষ্ঠান ছিলো । মধুরিমা টেবিলটার ওপর তাকিয়ে একটু অবাক হয়। তারপর খাট থেকে নেমে এগিয়ে যায়। টেবিলটার ওপর রাখা নীল শিশিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে। গতকাল রীতেশের সব উপহার ওই তো সাজিয়ে রেখেছিল টেবিলের ওপর। কোথায় তখন তো এটা চোখ পড়েনি। সেই চেনা সুগন্ধ বহুদিন পর মধুরিমার নাকে আবার ঝাপটা মারে। 


এই পারফিউমটা তো কালকে দেখেনি। এটা আবার কে দিলো তোমাকে? মধুরিমা শিশিটা হাতে নিয়েই কথাগুলো ছুড়ে দেয় রীতেশের দিকে। 

                       

ওহ্ এটা পিউ দিয়েছে। ও আমাদের অফিসের সবচেয়ে জুনিয়র স্টাফ, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে আছে। কাল বাড়িতে আসার পর ব্যাগ থেকে বের করতে ভুলেই গেছিলাম। রাতে শোয়ার সময় মনে পড়ল তখন ব্যাগ থেকে বের করে টেবিলে রেখে দিই। তুমি খেয়াল করোনি বোধহয়। রীতেশ হেসে বলে। 

                                     

মধুরিমা বোঝে ওকে নীল শিশির তরল সুগন্ধি ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে তুলছে। আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নেয় ও। প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই ঘোরতর সংসারী মধুরিমা কপালের ওপর কাচা পাকা খুচরো চুলগুলো সরিয়ে ইষৎ ভারি হয়ে যাওয়া গালে হাত বুলিয়ে রীতেশের নজর এড়িয়ে ফিক করে হাসে। ওদের একমাত্র ছেলে বছর ত্রিশের অর্ক দু’বছর হল বিদেশে চাকরি করছে। তবু্ও কোনো কোনো মুহূর্ত যেন মনের বয়সটাকে উদাসী কিশোরী বেলায় টেনে নিয়ে গিয়ে আটকে দিতে চায়। রীতেশের দিকে মধুরিমা তাকিয়ে বলে, হাঁটতে আজকে তুমি একাই যাও। আমি আর যাব না। 

                                

কেন মধু? সত্যি করে বলোতো শরীর ঠিক আছে তো? অবাক গলায় রীতেশ বলে। 

                                                           

হ্যাঁ গো হ্যাঁ শরীর ঠিক আছে একদম।ওই মাঝে মাঝে আলসেমি করতে ইচ্ছে করে। তাছাড়া বয়স তো হচ্ছে। হাল্কা সুরে মধুরিমা বলে। 

                                    

 বত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে রীতেশ জানে গোলগাল চেহারার সাদামাটা বউটা তার একটু খেয়ালি। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেসে প্রাতঃভ্রমণের জন্য একাই বেরিয়ে যায় রীতেশ। ভোরের নরম আলোয় মায়াবী ভালো লাগায় মধুরিমা আবার বালিশে মাথা রাখে। মাথার কাছে নীল শিশিটা। তন্ময়দা নাকি নীল শিশির সুগন্ধ জানে না মধুরিমা কোনটা তার অবচেতন মনের গলিতে চিরস্থায়িত্ব পেয়েছে ! শুধু এতটুকু জানে এইমুহূর্তে কিছুক্ষণের জন্য হলেও একলা ঘরে ভীষণভাবে সুগন্ধিত ভালোবাসায় ভিজতে ইচ্ছে করছে ওর। সময়ের ভেলায় ভাসতে ভাসতে স্বপ্নময় দু'চোখের মায়াডোরের সুবাসিত এক পরম আবেশে ডুবতে থাকে মধুরিমা। 

চিত্র - শ্রীহরি

Comments