গল্প - অদিতি সরকার

রজনীগন্ধা


কালচে ঝুরঝুরে ভেজা ভেজা মাটি পিয়ালির আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছিল। নখের তলায় মাটির স্তর। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে এখানে এভাবে বসে বসে। কোমরে হালকা টান ভাব টের পাচ্ছিল সে। খোলা ঘাড়ে রোদ লেগে জ্বালা করলেও চারপাশে ছড়ানো টব, চারা, খুরপির এই খেলাঘর ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না তার।


বীজ টিজ লাগানোর ঝামেলায় যায়নি পিয়ালি। যায় না আজকাল। বড় বেশি অপেক্ষা করতে হয়। তাও যদি আদৌ চারা ওঠে। কোন মাটিতে কোন বীজ যে ধরবে সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। তার চেয়ে এই ভালো। সোজা নার্সারি যাও, তৈরি তৈরি গাছের চারা নিয়ে এসে বসিয়ে দাও, ব্যস্। কিংবা প্রায় কলি বেরোতে শুরু করেছে এমন বাল্ব। ম্যাক্সিমাম তিন মাসের মধ্যে ঝলমলে বাগান হাতের মুঠোয়, চোখের সামনে। 

‘পিউ’। দোতলার বারান্দা থেকে একটা গলা ডাক দেয়।

‘উঁ’? মুখ না তুলেই সাড়া দেয় পিয়ালি।

‘এবার কিন্তু মাথা ঘুরবে। টুপি পরতে পারিসনি একটা। ঘাড় তো লাল হয়ে গেছে পুরো।‘

মাটিমাখা ডান হাতের দুটো আঙুল সাবধানে ঘাড়ে ছোঁয়ায় পিয়ালি। ইশ। সত্যিই কেমন জ্বালাজ্বালা করছে চামড়াটা। গরমও হয়ে উঠেছে বেশ। এখানকার রোদটা কীরকম যেন।  অপ্রতিভ মুখ তুলে তাকায় সে। বারান্দার রেলিং ধরে অর্ণব দাঁড়িয়ে। তার বর।

‘ভেতরে আয়। আজ কি খাওয়াদাওয়ার পাট নেই, নাকি?’

‘এমা না। কটা বাজে?’

‘আড়াইটে বেজে গেছে। তোর কি কিছুই খেয়াল থাকে না আজকাল?’

অর্ণবের গলায় হালকা গুরুজনমার্কা তিরস্কারের সুর। যেটা শুনলেই মাথা গরম হয়ে যায় পিয়ালির।

‘আসছি। তুমি খেয়ে নাও না।‘

‘না। তুই আয়। একসঙ্গে খাব।‘

‘এই কটা বাকি মোটে, দেখো। লাগিয়েই আসছি।‘

‘ঠিক আছে। দশ মিনিট। তার এক সেকেন্ডও বেশি নয় কিন্তু।‘

অর্ণব বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে যায়। হালকা গজগজানির শব্দ হাওয়ায় ভেসে কানে ঢোকে পিয়ালির। 

পরিপাটি টেবিল গোছাবে এখন অর্ণব। রান্নাঘরে রাখা খাবারের বাটিগুলো এক এক করে মাইক্রোওয়েভে ঢোকাবে, ঘড়ি ধরে ঠিক এক মিনিট গরম করে বার করে আনবে। চিনেমাটির বাটি, অবশ্যই। প্লাস্টিক কক্ষনো নয়। তারপর ফ্রিজ থেকে কনকনে ঠাণ্ডা হয়ে থাকা স্টিলের বোতল বার করে ঝকঝকে কাচের গেলাসে জল ঢালবে। জল একেবারে হিমঠাণ্ডা না হলে খেতে পারে না পিয়ালি, অর্ণব জানে।

একটা লম্বা শ্বাস পড়ে পিয়ালির। একটুও খেতে ইচ্ছে করছিল না তার। ক্ষিদে যে নেই তা নয়। কিন্তু ওই গরাস তোলা, চিবোনো, গেলা, সবটাই এত অর্থহীন মনে হয় আজকাল। কী হবে? কতটা খেল সে, ঠিক কতটা ভালো, কতটা পুষ্টিকর খাবার খেল, খাবারে সবুজ শাকসবজি কতটা, কতটা আয়রন, কতটা ভিটামিন গেল তার শরীরে, কী হবে আর এসব ছাইপাঁশের হিসেব রেখে?

কোমরে দুহাতের ভর রেখে নিজেকে দাঁড় করায় সে। পা কাঁপছিল তার সামান্য। এতক্ষণ একভাবে বসে থাকার জন্যই হয়তো।

কয়েক মুহূর্তের জন্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায় পিয়ালি। রোদে তাতা ইটের গরমটা তার টাটানো কোমরের ভেতরে আরাম চারিয়ে দিচ্ছিল। চোখ বোজে পিয়ালি। তার কল্পনায় একটা উষ্ণতার হালকা হলুদ লতা ধীরে ধীরে তাকে পেঁচিয়ে ধরে উঠে আসছিল, পা থেকে জানু বেয়ে ক্রমশ ওপরের দিকে। ছোট ছোট আরামের কুঁড়ি ফুটছিল লতার ডালপালায়, মিশে যাচ্ছিল তার ক্লান্ত হতাশ শরীরে।

লতা। 

এক সময় এই নামটা রাখার কথা ভেবেছিল না ওরা। 

‘আর পাঁচ মিনিট!’  

রান্নাঘরের জানালাটা খুলে দিয়েছে অর্ণব। মশলাদার চিকেনের গন্ধ ভাসছিল হাওয়ায়। পিয়ালির ভেতরটা কেমন গুলিয়ে ওঠে।

‘চিকেন খাব না আমি। জানোই তো ওগুলোকে ওই অত অত হরমোন দেয়, ওষুধ বিষুধ, কেমিক্যালস,’ পিয়ালি সামান্য গলা তোলে।‘আমার জন্য গরম কোরো না।’

‘কিচ্ছু হবে না বাবু। হেলথ শপ থেকে এনেছিলাম, মনে নেই? তুই এবার ওগুলো গুটিয়েগাটিয়ে আয় তো। রোজ রোজ খেতে এত বেলা করিস না সোনা।’ অর্ণব খুব নরম করে বলে।

অর্ণবের কথা বলার ধরনেই হোক, কিংবা হয়তো চাপা ঠোঁটে লেগে থাকা আলতো হাসিটার জন্যই, পিয়ালির হঠাৎই ভীষণ কান্না পায় কেন যেন। 

কে জানে, হয়তো অর্ণবের কথাই ঠিক। সত্যিই হয়তো বাড়াবাড়ি করছে পিয়ালি। মারিয়ানা বলেছিল ঠিকঠাক সব ব্যালেন্স হলেই সে আসবে। আসবেই। কিন্তু পিয়ালিকেও তার জন্য তৈরি করে রাখতে হবে নির্ভার নিষ্কণ্টক একটা পথ। বিশ্রাম আর পুষ্টি তো পিয়ালির  অবশ্যই দরকার, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার একদম শান্ত নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্ত একটা মন। 

মারিয়ানার কাছে লুকিয়ে গিয়েছিল পিয়ালি। অর্ণবকে জানালেই আবার অন্য ঝামেলার সম্ভাবনা ছিল। আজকাল আর অত কথা বলতে ভালো লাগে না পিয়ালির। অকল্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লায়েড ম্যাথসের অধ্যাপক অর্ণব অঙ্ক বোঝে, হিসেব বোঝে। মাওরি বুড়ি মারিয়ানা হান্টলের অলটারনেটিভ থেরাপির জগৎকে তার নিছক লোক ঠকানো মাম্বোজাম্বো ছাড়া আর কিছুই মনে হত না। অর্ণবের সেই অবিশ্বাস আর বিদ্রূপ মেশানো হা হা অট্টহাসির সামনে পড়তে চায়নি পিয়ালি।

কিন্তু মুশকিলটা অন্য। পিয়ালির হাতে যে আর কোনো বিকল্পই বাকি নেই। হয়তো অর্ণবের অবিশ্বাসটাই সত্যি, হয়তো ন্যাচারাল থেরাপি প্র্যাকটিশনার মারিয়ানা হান্টলের আঁকিবুকি কাটা মুখ আসলে লোকের দুর্বলতা নিয়ে ব্যবসা ফাঁদা এক শঠ মুখোশ, হয়তো তার সব কটা কথাই ধাপ্পাবাজি। অথচ সেটুকুও ছেড়ে দিলে পিয়ালির হিসেবের ঘরে শুধুই পড়ে থাকে শূন্য।   

টবগুলোকে গোল করে দাঁড় করিয়েছে পিয়ালি। মারিয়ানা বলেছিল বৃত্তেই জীবনের শুরু, বৃত্তেই জীবনের শেষ। এই চক্রের কোথায় আদি কোথায় অন্ত কেউ বলতে পারে না। 

‘কোরু কাকে বলে জানো পিয়ালি’? জিজ্ঞাসা করেছিল মারিয়ানা তাকে।

‘কোরু? না তো।‘

‘নিউজিল্যান্ডে কত বছর আছ তোমরা?’

‘তা প্রায় পাঁচ বছর তো হলই।‘ এ হিসেব পিয়ালির করতে হয় না,  এয়ারপোর্টে পা দেওয়ার দিনটি থেকে প্রতিটা দিনরাত তার গোনা।

‘এখানকার ফার্ন গাছ দেখেছ, নিউজিল্যান্ড ফার্ন?’ 

‘সিলভার ফার্ন? হ্যাঁ, দেখেছি তো। এদেশের সবকিছুতেই তো ওই ফার্নের ছবি।‘ 

‘হ্যাঁ, আমাদের দেশের পরিচয়ই ওই ফার্ন। আমাদের মাওরিদের কাছে শক্তি আর জেদের প্রতীক ওই ফার্ন। তো ওই সিলভার ফার্নের মাথাটা খেয়াল করে দেখেছ কখনও?’

পিয়ালি মনে করার চেষ্টা করেছিল। মস্ত মস্ত পাতার আগাগুলো শামুকের খোলের মতো গোল গোল প্যাঁচ খাওয়া। অনেকটা দেশের ঢেঁকিশাকের ডগার মতোই, তবে আকারে অনেক বড়।

‘না খোলা ফার্নের মাথার ওই গোল নকশাকে আমাদের ভাষায় বলে কোরু। কোরু মানে নতুন কিছুর সূচনা, নতুন প্রাণ, নতুন জীবন। ঠিক যে জায়গায় একটা ফার্নের পুরোনো পাতা শুকোয়, সেখান থেকেই আবার জন্ম নেয় আর একটা নতুন পাতা।‘

মাটিতে কাঠি দিয়ে একটা স্পাইরাল কোরু এঁকেছে পিয়ালি। তার দাগে দাগে একটা একটা করে সাজিয়েছে সাতটা টব। বেজোড় সংখ্যা, সবসময় বেজোড় সংখ্যা হতে হবে। প্রাণ কখনও নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ হতে পারে না। প্রাণ চিরসচল, চিরসজীব।

প্রত্যেকটা টবের জল বেরোবার ফুটোর ওপর কয়েকটা ঝলমলে রঙিন কাচের নুড়ি সাজিয়েছিল সে। ভাঙা খাপরা দিলেই কাজ হত, কিন্তু সে চেয়েছিল নতুন গজানো অঙ্কুরগুলোকে জীবনের শুরুতেই একটু সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।

‘কিন্তু কেউ তো দেখতেই পাবে না ওগুলো,’ অর্ণবের হতবুদ্ধি মাথা নাড়া এখনও পিয়ালির চোখে ভাসে।

‘আমি তো জানব। বীজগুলো, গাছগুলো তো জানবে ওরা ওখানে আছে, সুন্দর করে ঘরবাড়ি সাজিয়ে রেখেছে কেউ ওদের জন্য,’ পিয়ালি তর্ক করেছিল হালকা। 

মুঠো মুঠো মাটি ঢালে টবে পিয়ালি, প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশ ধরে ধরে সারের বড়ি যত্ন করে গুঁজে দেয় চারা থেকে ঠিক তিন ইঞ্চি দূরে। গত চার বছরে নিখুঁত নির্দেশ মানা অভ্যেস হয়ে গেছে পিয়ালির। ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়া, ক্যালেন্ডার ধরে টেম্পারেচার নেওয়া, ডুবতে বসা মরিয়া মানুষের আরো যত কিছু আঁকড়ে ধরা কাঠিকুটি। 

‘হারমনি, ব্যালেন্স,’  খুব সাবধানে নার্সারি থেকে দেওযা থার্মোকলের পাত্র থেকে ছোট্ট চারাগুলোকে তুলে আনতে আনতে ফিসফিসিয়ে মারিয়ানার কথার প্রতিধ্বনি করে পিয়ালি। বেশি জোরে ধরে টান দিলে নরম শেকড়গুলো ছিঁড়ে যাবে, শত চেষ্টাতেও টবের মাটিতে আর ধরানো যাবে না তারপর।

অর্ণবের গতবারের কথাগুলো ঝপ করে মনে পড়ে যায় পিয়ালির। ‘গাছই তো রে বাবা। মরলে আবার নিয়ে আসব, অত চিন্তা করছিস কেন বলতো!’ কষ্ট দেবার জন্য বলেনি, জানে পিয়ালি, বরং উলটোটাই। কিন্তু কেন যেন সেদিন পিয়ালির প্রথম মনে হয়েছিল অর্ণব তাকে বুঝছে না। 

‘পিউ।’ 

পিয়ালি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অর্ণব ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। দু হাত কোমরে, কপালে হালকা দুশ্চিন্তার ভ্রূকুটি। পিয়ালি হঠাৎ আজই খেয়াল করে, অর্ণবের রগের কাছে হালকা সাদার ছোঁয়া। তার স্মার্ট হ্যান্ডসাম বরটা কবে বুড়িয়ে গেল সে লক্ষই করেনি তো। 

‘আর একটা বাকি জাস্ট। চারা নয়, এই কটা বাল্ব। এক্ষুনি হয়ে যাবে, প্লিজ।’

পিয়ালির নিজের কানেই নিজের গলা কেমন কমজোর শোনায়। কে জানে কেন।

‘আমি হেল্প করি?’

বারণ করাটা অত্যন্ত খারাপ দেখাবে, নিষ্ঠুরও। কিন্তু পিয়ালির ভেতর থেকে তীব্র আপত্তি উঠে আসতে চাইছিল। তার নিজের বলতে তো এইটুকুই, এখানে কাউকে আসতে দিতে ইচ্ছে করে না তার। না, অর্ণবকেও না। পিয়ালির কাছে এই ছোট্ট একটুকরো জায়গাটুকু শুধু সবুজে সবুজে ভরা একটা মাটির টুকরোই তো নয়। এখানে কাউকে নিজের উর্বরতার পরীক্ষা দিতে হয় না, এখানে নতুন প্রাণ নিয়ে আসা হরমোন পাউডারে একটা ডালের টুকরো ডুবিয়ে মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার মতোই সহজ। 

‘খাবে না?’

‘বললাম তো একসঙ্গে খাব। তুই সেরে নে যা করছিস।’

পিয়ালি শেষ প্যাকেটটা অর্ণবের হাতে তুলে দেয়। তার আর আপত্তি করার মতো কিছু ছিল না। অর্ণব প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলো পড়ছিল।

‘পলিয়্যান্থেস টিউবারোসা?’   

‘রজনীগন্ধা, ’ ইচ্ছে না থাকলেও অর্ণবের প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে পারে না পিয়ালি।

‘তুই রজনীগন্ধা লাগাচ্ছিস আবার?’ অর্ণব কিছু একটা বলতে গিয়ে হোঁচট খায়। ‘ না মানে, আমি আসলে ভেবেছিলাম সেবারের পরে আর…?’

‘আমি ঠিক আছি।’ অর্ণবের হাতে হাত ছোঁয়ায় পিয়ালি। ‘ ঠিক আছি, বিশ্বাস করো।’     

তিন পেরিয়ে প্রায় চার মাস চলছিল পিয়ালির তখন। বাগান জুড়ে রজনীগন্ধার ঢল নেমেছিল সেবার। সূর্য অস্ত গেলেই তীব্র মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারি। সারা বাড়ির সবকটা ফুলদানিতে স্টিকগুলো গুঁজে গুঁজেও শেষ করা যাচ্ছিল না। কোয়ার্টার্সের ওইটুকু জমিতে এত এত রজনীগন্ধা কারা লাগিয়ে গিয়েছিল কে জানে।

পিয়ালির মর্নিং সিকনেস এমনিতেই তখন ভয়ংকর ছিল, তাতে এই গন্ধ। এককালের অতি প্রিয় গন্ধ অসহ্য হয়ে উঠেছিল তার কাছে। 

ঘরের ভেতরের ফুলশুদ্ধু স্টিকগুলোকে ডাস্টবিনে বিদায় দেওযা হয়েছিল। বাগানে যেগুলো তখনও ফুটছিল সেগুলোকে যদিও পিয়ালি প্রাণে ধরে কাটতে পারেনি। অযৌক্তিক হলেও কেন যেন তার মনে হয়েছিল ওটা করলে ভালো হবে না, বরং কিছু একটা খারাপকেই ডেকে আনা হবে। বাড়ির ভেতর প্রত্যেকটা সারাটা দিন অ্যারোমা ক্যান্ডল জ্বালিয়ে রাখত পিয়ালি, তবু গন্ধ তাকে ছাড়ছিল না।

ঠাকুমা মারা গেলেন যেদিন, রজনীগন্ধার মালার স্তূপে ছোটখাটো শরীরটা প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেই তীব্র গা গোলানো বিষাদগন্ধই যেন পিয়ালিকে ঢেকে ফেলছিল ক্রমশ।

বাথরুমের ধবধবে মার্বেলের মেঝেতে  ঝরে পড়া ছোট্ট কালচে রক্তের ছোট্ট দলাটা যেদিন জলের তোড়ে ধুয়ে চলে গেল, তার পরেও অনেকগুলো দিন বাগানে পা রাখেনি পিয়ালি।  

লম্বা লম্বা ফুলে ভর্তি ডাঁটিগুলো ততদিনে শুকিয়ে খড় হয়ে গেছে। কুশ্রী দেখাচ্ছিল। হাতে একটা খুরপি নেয় পিয়ালি। সর্বশক্তি দিয়ে গাছগুলোকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলতে থাকে। অর্ণব যতক্ষণে ফিরেছিল ততক্ষণে বাগান পরিষ্কার, শুকনো গাছপাতা পেছনে ডাস্টবিনে ফেলে আসা হয়েছে, কোথাও কোনো চিহ্নমাত্র নেই একটাও রজনীগন্ধার ডাঁটির, জীবিত বা মৃত।

এর পর আর যে কটাদিন তারা ওই বাড়িতে ছিল বাচ্চাকাচ্চা হওয়া বা না হওয়া নিয়ে তারা আর কোনো আলোচনা করেনি কোনোদিন। 

তারপরেই তো এই কাজটা পেয়ে গেল অর্ণব। পেয়ে গেল না জোর করে জোগাড় করে নিল? কে জানে। দেশ ছেড়ে একেবারে অচেনা অজানা নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ডের শহরতলিতে এই ছোট্ট সুন্দর বাড়িখানা।

এখন, এই মুহূর্তে অর্ণবের চওড়া শক্ত হাতের তেলোয় ছোট্ট সবজেটে বাদামি কন্দটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসায় গলা পর্যন্ত বুজে আসে পিয়ালির। নিজের ভেতরের এই যুক্তিহীন অন্ধ চাওয়াটাকে কোনোদিনও ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারেনি অর্ণবকে সে। বায়োসজিক্যাল ঘড়ির টিকটিক? না নিজেকে সম্পূর্ণ, নিখুঁত নারী হিসেবে প্রমাণ করতে চাওয়ার । সে নিজেই বোঝে না। শুধু বোঝে যত দিন যাচ্ছে এই এক সর্বগ্রাসী তাড়না তার দিনরাতগুলোকে পুরোপুরি ছেয়ে ফেলছে। 

অর্ণব তাকে দোষ দিতেই পারত। বউ হওয়ার প্রথম শর্তটাই তো পিয়ালি পূরণ করতে পারেনি। 

অথচ প্রত্যেকটা মিসক্যারেজের পর পিয়ালিকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিয়ে বসে থেকেছে অর্ণব। বটগাছের মতো ঢেকে রেখেছে তাকে, যতদিন না পিয়ালির ফ্যাকাশে গালে আবার লালচে ছোঁয়া লাগে। যতদিন না আবার আপাত স্বাভাবিক হয়ে সংসারের হাল ধরে সে।

কিন্তু গতবারের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হল। পিয়ালিকে চমকে দিয়ে অর্ণব আর বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে কোনোরকম আলোচনাই করতে রাজি হল না। খুব অল্প হলেও দূরে সরে যাচ্ছিল অর্ণব, বুঝতে অসুবিধে হয়নি পিয়ালির।  

পিয়ালি খুব হালকা করে টেস্ট টিউব বেবির কথা তুলেছিল একবার। উত্তরে অর্ণবের অশান্ত অধৈর্য চেহারা তাকে সত্যিই চমকে দিয়েছিল। ‘আমি আর পারছি না। বার বার তোর এই কষ্ট আমি আর নিতে পারছি না। নিজেকে এবার মানুষ ভাবতে শেখ পিউ, জাস্ট একটা রিপ্রোডাক্টিভ ইউনিট ভাবিস না! আইভিএফও ফেল করে। তখন কী করবি তুই?’

‘বায়োকেমিস্ট্রির প্যাট্রিককে মনে আছে তোর, পিউ? স্যান্ড্রা, ওর বউ? ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম স্যান্ড্রার জন্মদিনে?’ 

হাতে ধরা রজনীগন্ধার বালবটার দিক থেকে চোখ না তুলেই বলে অর্ণব।

‘ওর বোনের, মানে বিয়ের তেরো বছর পরে বাচ্চা নিয়েছিল ওরা, জানিস তো। ইয়ে, নিয়েছিল মানে, অ্যাডপ্ট করেছিল। প্যাট্রিক বলছিল সেদিন। মানে, আমাদের তো…’, মাঝপথেই তুতলে থেমে যায় অর্ণব।

পিয়ালির যন্ত্রণার বোধটাও চলে গেছে বোধহয় আজকাল।

‘ঠিক আছে অর্ণব, ঠিক আছে। আমিও ঠিক আছি। সব ঠিক আছে।’ নিজেকেই সান্ত্বনা দেয় পিয়ালি ফিসফিস করে।   

ও এখনও চায় তাহলে। এখনও, আজও চায়।

‘কেমন ফুল হবে রে এগুলোর? সিঙ্গল না ডবল? এই প্যাকেটে যেমন ছবি, সেইরকমই?’ শেষ বালবটা মাটিতে বসাতে বসাতে বলছিল অর্ণব। খুব পাতলা একটা মাটির ঝুরঝুরে স্তর বিছিয়ে দিতে থাকে সে ছোট্ট কন্দটার ওপর। শুধু কচি নরম ফিকে সবুজ মুখটুকু বার হয়ে থাকে। এখান দিয়েই ডাঁটি বেরোবে। ফুল ধরবে সেই ডাঁটিতে।

 ‘পার্ল। মুক্তো। সুন্দর নাম। না?’ অর্ণবের গলা নিচু, ভারি।

ওই গলার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কিছু একটা পিয়ালিকে অর্ণবের দিকে ফিরতে বাধ্য করে। টবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল অর্ণব মুঠো করা দু হাতের ওপর ক্লান্ত মাথা রেখে।

‘আমারও কষ্ট হয় পিউ। আমারও মন আছে একটা,’ প্রায় শোনা না যাওয়া একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে খুব আবছা হয়ে অর্ণবের স্বর ভেসে আসে।

'সরি। মাফ করে দাও।’ পিয়ালি ফিসফিস করে।    

‘তুই সরি বলছিস কেন?’ অর্ণবের গলায় এই প্রথম রাগের আভাস শোনে পিয়ালি।  ‘সমস্যাটা আমাদের দুজনেরই পিউ।’ 

‘কিন্তু অক্ষমতাটা তো আমার। তাই সমস্যার সমাধানের দায়টাও আমার। পারতেই হবে আমায়।’ 

এতদিনে এই প্রথম নিজের সবথেকে বড় ভয়ের কথাটা মুখে আনে পিয়ালি। 

তোকে কোনোদিনও কেউ কিছু বলেছে এই নিয়ে? আমি, আমার মা, আমার দিদি, কেউ কিচ্ছু বলেছে? কেন নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছিস বাবু? তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি, এইটুকু আজও বুঝিস না? কী আসে যায় একটা বাচ্চা হলে আর না হলে? 

না। কেউ বলেনি। কিচ্ছু বলেনি। বলেনি বলেই তো আরো। পিয়ালির শ্বাস আটকে আসছিল। কেন বলোনি তোমরা কিছু অর্ণব, কেন? কেন এত ভালো তোমরা?

যেমন দ্রুত রেগে গিয়েছিল ঠিক তেমনই দ্রুত অর্ণবের মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে আসে। 

‘সেই অ্যাডপশন এজেন্সির নম্বরটা আছে এখনও তোর কাছে?’ 

তখন কী সাংঘাতিক জোর করে বারণ করেছিল যোগাযোগ করতে অর্ণব। তাড়াহুড়ো করছে পিয়ালি, এমনটাই মনে হয়েছিল নাকি অর্ণবের। সময় নিয়ে ভাবতে, মন শান্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিল। কার মন শান্ত হওয়ার কথা বলেছিল কে জানে।

‘আছে।’

আলতো করে পিয়ালির হাতটা নিজের মুঠোয় নেয় অর্ণব, খুব নরম করে লেগে থাকা মাটির গুঁড়ো ঝেড়ে ফেলতে থাকে।  

‘যাবি?’

‘কবে?’

‘কালই চল না। একটা ফোন করে বলে রাখি না হয়।’ একটু ভীত, একটু উৎসুক চোখে তাকায় অর্ণব।

পিয়ালি হঠাৎই খুব জোরে আঁকড়ে ধরে অর্ণবের হাতটা। 

‘এই, খাবে না? আজ না, অনেকদিন পরে, সত্যি সত্যি খুব খিদে পাচ্ছে, জানো।’।

চিত্র - শ্রীহরি

Comments

  1. ছোট্ট গল্প কিন্তু কি সুন্দর মোন ভালো করা , খুব খুব ভালো

    ReplyDelete

Post a Comment