গল্প - মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

মোহজীবন


আকাশে কালচে মেঘের স্তর জমেছে। ঋজু শরীরের পাইনের দল সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার স্বরলিপির মতো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। অনেক নিচে গহন উপত্যকাকে সাপের মতো জড়িয়ে ধরে ছুটে চলেছে পাহাড়ি নদী। তার পায়ে বাঁধা উপলখন্ডের ঘুঙুর। দূর থেকে কানে ভেসে আসছে জলের ক্ষীণ শব্দ। পাকদন্ডি পথে গাড়ি চালাতে চালাতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ট্রাভেল ম্যাগাজিনগুলো ঠিকই বলে, এ হল পাখিপ্রজাপতির দেশ। এই পাহাড় সত্যিই ফোটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য।


জানলার ওপাশে কালো পাহাড়ের বুকে সাদা ঝরনারেখা। দেখে মনে হয় রেড ইন্ডিয়ান প্রহরী মেঘের পালক গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত সূর্য দেখতে দেখতে ঢাকা পড়ে গেল মেঘের আড়ালে। শিকারি কুকুরের মতো নিকষ কালো অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল উপত্যকা জুড়ে। চারদিক থম ধরে আছে। বাইরে নিস্তব্ধ অরণ্য। কানে আসছে পাইনের শ্বাসপ্রশ্বাস। হঠাৎ বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। সামনের বাঁকটায একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ডেনিম জিনস আর চামড়ার জ্যাকেট পরা এক ভদ্রলোক লিফট চাইছেন। তাঁর পাশে একটি ফুটফুটে মেয়ে।


প্রথমেই একটা আশংকার কাঁটা বুকে বিঁধল। চোরছ্যাঁচোড় নয় তো? একবার ভাবলাম ধুত্তোর অত চাপ নেবার কী  দরকার, না দাঁড়ালেই তো হয়। পাশ কাটিয়ে চলে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মনটা দুলে উঠলো। গতি ঢিমে করলাম। জিজ্ঞাসু মুখে বললাম, ইয়েস?


এই নির্জন পাহাড়ি পথে সন্ধেবেলা একাকী একজন মহিলাকে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ভদ্রলোক সম্ভবত আশা করেননি। হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে ইংরেজিতে বললেন, আপনি কি মহাবালেশ্বর যাচ্ছেন? আমাদের গাড়িটা বিগড়েছে এই জঙ্গুলে পথে। আমাদের একটু লিফট দেবেন প্লিজ?


হেডলাইটের আলো ভদ্রলোক আর তার সঙ্গে মেয়েটির মুখে পড়েছে। সৌম্যদর্শন চেহারা। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। টিকালো নাক। চৌকো চোয়াল। পাতলা ঠোঁট। মানুষের ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞান থাকে চোখে। রিমলেস চশমার আড়ালে শান্ত দুটো চোখ মানুষটার। ডলপুতুলের মত মেয়েটির বয়স বছর পাঁচেক হবে। এক মাথা চুল, কালো চকচকে চোখের মণি, দুধে আলতা গায়ের রং। ফার দেওয়া সাদা জ্যাকেট পরে আছে মেয়েটি। কৌতূহলী চোখে দেখছে আমাকে। আমি দু'সেকেন্ড চুপ করে থেকে ইংরেজিতে বললাম, হ্যাঁ ওই পথেই যাচ্ছি। উঠে আসুন। 

ভদ্রলোক দরজা খুলে মেয়েকে তুলে দিলেন পেছনের সিটে। তারপর উঠে এলেন আমার পাশের সিটে। মৃদুস্বরে ধন্যবাদ দিলেন। মেয়েটি রিনরিনে গলায় বলল, থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি। মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটিকে  হাসিটা ফেরত দিয়ে ইগনিশনে চাবি  ঢোকালাম। গাড়ি চলতে শুরু করল। আর তখনই চান্দেকারজির মুখটা ভেসে উঠলো মনের পুকুরে।


আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করতেন আদর্শ চান্দেকার। অবসর নেওয়ার পর চান্দেকারজি মহাবালেশ্বরেই থাকেন। তুমুল আড্ডাবাজ ও সুরারসিক লোক। এই পাহাড়ি শহরে ওঁর নিজের হোটেল আছে। আমি আর  সায়র হানিমুনে এসেছিলাম এই হিল স্টেশনে। ওঁর হোটেলে উঠেছিলাম। একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছিলাম লাউঞ্জে বসে। সেই আড্ডায় তাঁর মুখেই শুনেছিলাম যে, পঞ্চগনি থেকে মহাবালেশ্বর পর্যন্ত পথ সন্ধের পর থেকে রহস্যময় হয়ে যায়। তিনি নিজেও একবার আনক্যানি ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন। কথাটা নেশাতুর মানুষের গালগল্প ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। বিস্তারিত জানতে চাইনি। আজ ঘোর  সন্ধেবেলা এই পথে অচেনা দুই সওয়ারিকে  গাড়িতে তোলার পর কথাটা মনে পড়ে গেল।


আমি আর সায়র ব্যাচমেট। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরোতে না বেরোতেই আমাদের চাকরি হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে। দুজনের প্রথম পোস্টিং হায়দ্রাবাদে। আমাদের বন্ধুত্ব নিজামের শহরে এসে প্রেমে বদলাতে শুরু করল। মনে হতে থাকে যে, আমরা একে অন্যকে ছাড়া বাঁচব না। তখনই আমরা বিয়ের সিদ্ধান্ত নিই। দু'বাড়ির কারওরই এ বিয়েতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের দাম্পত্য একটা ঝাঁকি খায়। জানতে পারি, সায়র আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির এইচওডি শার্লি ডিক্রুজ নামে এক গোয়ানিজ মহিলার প্রতি আসক্ত। সেই আসক্তি শারীরিক ঘনিষ্ঠতার পর্যায় অবধি চলে গেছে।


শার্লি ডিভোর্সি। বয়সে সায়রের থেকে খানিক বড় হলেও চেহারা দেখে তা বোঝা যায় না। শার্লির  হস্তক্ষেপে সায়র এই চাকরি ছেড়ে জয়েন করে শার্লিদের কোম্পানিতে। এরপর যা হয়, আমাদের দাম্পত্যে তিক্ততা বাড়ে। বস্তির লোকেদের মতো ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়। হাতাহাতি অবধি তা গড়ায়। একসময় আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যায়। কোম্পানির  ওপরমহল সব জানত। আমি চরম অবসাদের দিকে চলে যাবার আগে তারাই আমাকে বদলি করে পুনের অফিসে।


ওশোর আশ্রমের খুব কাছেই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। আমি আর আমার অফিস কোলিগ রেহানা থাকি একসঙ্গে। এখানে এসে গাড়ি চালানো শিখেছি ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুলে। লোন নিয়ে গাড়িও কিনে ফেলেছি সম্প্রতি। আমার প্রিয় রং ষাঁড়ের রক্তের মতো লাল। পোশাক-আশাক থেকে ল্যাপটপ কিংবা ফোন সবকিছুই অক্সব্লাড রঙের। কিন্তু সায়রের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার পর আমার পছন্দ বদলেছে। আজকাল নীলধূসর রংটাই বেশি ভালো লাগে। গাড়িও কিনেছি এই রঙের। মনে হয় এই বিধুর রঙের মধ্যে এক গভীর বিষন্নতা লুকিয়ে আছে।


দেখতে নরমসরম হলেও আমার মন শক্ত। ডাকাবুকো মেয়ে বলেই সকলে আমাকে চেনে। আমার জায়গায় বেশিরভাগ মেয়ে সায়রের সঙ্গে সম্পর্কটাকে হয়তো টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করত। আমি তা করিনি। প্রেম যেখানে নষ্ট হয়ে গেছে সেখানে অহেতুক ফেভিকল লাগিয়ে বাইরের লোকের কাছে নিজেকে সুখী প্রমাণ করার দায় আমার নেই। নিজে ভাল রোজগার করি। আর্থিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর। তাছাড়া আমি বরাবরই একটু ডেয়ারডেভিল গোছের। তা না হলে দু'মাসের ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে কেউ একা একা এই পাহাড়ি পথে গাড়ি ড্রাইভ করে!


আড়চোখে দেখলাম একবার। নাহ ভদ্রলোক আর তাঁর মেয়েকে দেখে আর যা-ই হোক ভূতপ্রেত বলে মনে হচ্ছে না। ভদ্রলোক পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমাটা মুছে নিলেন। এখন তার চোখ উইন্ডস্ক্রিনের ওপাশে। আঁধার গাঢ় হচ্ছে। গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ছে সামনে। সামনের পাইনবনের ওপর দিয়ে উড়ছে সাদা প্রজাপতির ঝাঁক। সেদিকে তাকিয়েই ভদ্রলোক বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বাঙালি?


আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন? 


ভদ্রলোক হাসলেন, আপনার মুখ দেখে মনে হল। মহাবালেশ্বরে হাতে গোনা বাঙালি পরিবার। তারমধ্যে আমরাও আছি। আমার নাম প্রিয়ম চ্যাটার্জী। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। পঞ্চগনি গিয়েছিলাম একটা কাজে। ফেরার পথে গাড়িটার অ্যাক্সেল ভেঙে গেল। যে গ্যারাজে গাড়ির কাজ করাই তাদের ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম। নেটওয়ার্ক নেই।


রিয়ারভিউ মিররে দেখলাম ডলপুতুলের মত মেয়েটিকে। মনোযোগ দিয়ে আমাকেই দেখছে। একটু হেসে বললাম, তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়ো?


মেয়েটির সুরেলা গলায় বলে উঠল, সেন্ট স্টিফেন্স স্কুলে। আমার নাম আর্যমিতা। বাবা যদিও আমাকে উলকি বলে ডাকে।


আমি মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বললাম, উলকি? বাহ খুব সুন্দর নাম তো! মা কী বলে ডাকে তোমাকে?


উল্কি বলল, আমার মা আকাশের তারা হয়ে গেছে!


গাড়ির ভেতর নরম আলো জ্বলছে। রিয়ারভিউ মিররে বাচ্চাটাকে দেখছি। মনে হল ধূসরনীল এক বিষাদ লেগে আছে শিশুটার মুখেচোখে। কী বলব বুঝে পেলাম না। প্রিয়ম মুখটা বাইরের দিকে ঘুরিয়ে বললেন, আপনি ডেস্টিনি মানেন? পুনের সবচাইতে বড় হসপিটালে জন্মেছিল উলকি। তখনই ঘটেছিল মিসহ্যাপটা। ডাক্তারের ভুল বলব, না কি অদৃষ্টকে দোষ দেব, জানি না...। একটা শ্বাস ফেলে প্রিয়ম আর্দ্র গলায় বললেন, ছাড়ুন ওসব কথা।


গাড়ির মৃদু আলোতে আমি ভদ্রলোকের একদিক দেখতে পাচ্ছি। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন দাঁত দিয়ে। ভেতরের আবেগটাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন জোর করে। দু-চারবার বড় বড় শ্বাস নিলেন, ছাড়লেন। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখে নিলেন একবার। গলাটা খাদে নিয়ে গিয়ে বললেন, যাক উলকি ঘুমিয়ে পড়েছে। আপনি লিফট না দিলে আজ যাচ্ছেতাই রকম ঝামেলায় পড়তাম আমরা। থ্যাংক ইউ ওয়ানস আগেন।


আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, ইটস ওকে। আপনার স্ত্রী কি মহাবালেশ্বরেরই মেয়ে?


প্রিয়ম হেসে বললেন, এক মহল্লাতেই বাড়ি। ওরাও বাঙালি। কলেজ থেকেই প্রেম আমার আর  রক্তিমার! 


ভদ্রলোক মিষ্টি করে স্ত্রীর নাম উচ্চারণ করলেন। বুকটা ধক করে উঠল। আমার নামও তো রক্তিমা!


রক্ত জমিয়ে দেওয়া পাহাড়ি হাওয়া ঝাপটা মারছে। গাড়ির জানলা বন্ধ করে দিলাম। নাকে এল আবছা সৌরভ। পুরুষালি সুগন্ধে চারপাশ ভরে উঠতে শুরু করল ক্রমশ। প্রিয়ম বললেন, আমাদের প্রেমটা ছিল ছেলেমানুষের মতো। ফার্স্ট ইয়ারে মাখোমাখো প্রেমের ছানা কেটে গিয়েছিল পরের বছর। কী একটা তুচ্ছ কারণে ব্রেকআপ হয়ে গেল। দুঃখে দেবদাসই  হয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার লিভারে মদ সহ্য হল না। বন্ধুদের পরামর্শে বই, গান, ক্যামেরা ট্রাই করলাম। কিছুতেই কিছু হয় না। মন আর ওসবে বসে না। তখন ওকে ঘেন্না করার জন্য ওর নেগেটিভ দিক গুলো ভাবতে শুরু করলাম। তবু ঘেন্না এল না। এল ডিপ্রেশন। 


শ্বাস নিলাম একবার। অস্থির অস্থির লাগছে। ভদ্রলোক গাড়িতে ওঠার পর থেকেই গন্ধটা আসতে শুরু করেছে। এমন গন্ধ আগে কখনো পাইনি। ব্যাখ্যাতীত একটা গন্ধ। ডিওডোরান্ট বা পারফিউমের ঘ্রাণ এটা নয়। সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শুধু নয়, গোটা শরীরের হাড়রক্তমজ্জা সব যেন অবশ হয়ে যাবে এমন একটা অদ্ভুত সুগন্ধ। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করতে করতে হালকা গলায় বললাম, আবার মিল হল কী করে?



প্রিয়ম বললেন, রক্তিমা মাছভাজা খেতে ভালবাসে।  ওকে মনে করে একদিন মাছভাজা খেতে বসলাম। গলায় বেঁধে গেল কাঁটা। সে আর এক যন্ত্রণা। পাখি পোষার মতো গলায় কাঁটা পুষতে শুরু করলাম। ওর কথা মনে পড়লেই জোরে একটা ঢোক গিলতাম। কাঁটাটা খচ করে উঠত। সেই দুঃখের কথা কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম আমাদের এক কমনফ্রেন্ডকে। সে আবার গিয়ে সবিস্তারে সব জানিয়ে এল রক্তিমাকে। সে তো হেসেই খুন। একদিন ফোন করল আমাকে। আমাদের রিলেশনশিপের মধ্যে যে-কাঁটাটা ছিল তা ভ্যানিশ হয়ে গেল। আবার নতুন করে কেমিস্ট্রি জমে উঠল আমাদের। তারপর আর কী, কলেজ থেকে বেরিয়ে ইউনিভার্সিটি, মাস্টার্স করতে না করতেই বিয়ে।


পুরুষালি গন্ধটা জোরালো হচ্ছে ক্রমশ। উলকি ঘুমের মধ্যে কী একটা বলে উঠল। প্রিয়ম সচকিত হয়ে মেয়ের দিকে ফিরে মেয়ের চুলে আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন। উলকি আবার চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে পড়ল গদিতে হেলান দিয়ে। প্রিয়ম বললেন, মা-মরা মেয়েকে মানুষ করা সহজ কাজ নয়। তবুও লড়ে যাচ্ছি কেন জানেন তো? রক্তিমা প্রায়ই ঠাট্টা করে বলত, আমার যদি ভালমন্দ কিছু একটা হয়ে যায় আর তুমি যদি সেই সুযোগে আর একটা বিয়ে করো তাহলে আমি পেত্নি হয়ে তোমার গলা টিপে ধরব। সেই ভয়েই আমি আর....। প্রিয়ম মজা করে কথাটা বললেন। কিন্তু গলাটা শেষদিকে ভেঙে গেল। মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন বাইরের দিকে।


গাড়ি চালাচ্ছিলাম চুপচাপ। পরিবেশটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। সেটা বুঝেই বোধ হয় ভদ্রলোক লঘু গলায় বললেন, আমি নিজের কথাই শুধু বলে গেলাম। আপনার কিছু নেই এমন? মজার ঘটনা? তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, দেখেছেন আমার আক্কেল? সরি আগেন ফর বিয়িং ইনকুইজিটিভ।


আমি হালকা গলায় বললাম, আমি যখন থার্ডইয়ার তখন ফ্রেশার একটা ছেলে বেশ নজর কাড়ত। এমনিতে ভাল দেখতে কিন্তু গলার আওয়াজ বড্ড মেয়েলি। সে আবার কোনও মেয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাত না। বয়সে একটু ছোট বলেই মজা করতে ইচ্ছে হল। একদিন সবাইকে ডেকে বললাম, ওকে আমার দারুণ পছন্দ। কথাটা সেই ছেলের কানেও পৌঁছল। সেই ছেলে ধীরে ধীরে অ্যাটাচড হয়ে পড়ল  আমার দিকে। যে ছেলে কোনও দিন কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলত না, সে নিজে এগিয়ে এসে একদিন আমাকে প্রোপোজ করে ফেলল।


প্রিয়ম মুখ ফেরালেন আমার দিকে। আমি বললাম, আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা বারণ করল এমন মজা না করতে, যেহেতু ছেলেটা সিরিয়াস। কলেজে যেদিন শেষবার গেলাম সেদিন ছেলেটাকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার মধ্যে অনেক নেগেটিভ দিক আছে। আমি বোয়ালমাছের মতো হাই তুলি, পিলে চমকানো ঢেকুর, ফুচকাওয়ালা সঙ্গে কাঁইকাঁই। তাতে কাজ হল। সেসব শুনে সেই ছেলে পিঠটান দিল। সেও বাঁচল, আমিও।


প্রিয়ম হাসতে হাসতে বললেন, তেমন অভিজ্ঞতা আমারও আছে। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়েছিলাম। স্কুলের শেষ পরীক্ষা যেদিন দিলাম সেদিন সন্ধেবেলা আমার প্রেমিকা কাঁদো কাঁদো স্বরে ফোন করে বলল, সে মেডিকেল কলেজের এক স্টুডেন্টের প্রেমে পড়েছে। ফোনের এ-পারে ক্যাবলার মত সব শুনে গেলাম চুপচাপ। পরের দিন তার দেওয়া সমস্ত উপহার আর চিঠি জুতোর বাক্সে ভরে তার ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিলাম।


সেন্স অফ হিউমার আর উইট সায়রের মধ্যে নেই। সে কেজো মানুষ। ঠাট্টা রসিকতার ধার ধারে না। স্টিয়ারিং সামলাতে সামলাতে তাকালাম আড়চোখে। ভদ্রলোক আমার গাড়ি চালানো মন দিয়ে লক্ষ করছেন। প্রিয়ম মুচকি হাসলেন, গাড়ি চালানোর সময় কে কিভাবে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে, কতটা স্মুদলি গিয়ার বদলাচ্ছে, ক্লাচে কেমন করে পা রেখেছে, ব্রেক কষার ধরন কেমন এসব মন দিয়ে লক্ষ করতে আমার ভালো লাগে। আপনি যে বেশিদিন ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন না সেটা বোঝা যায়।


আমি বললাম, দু'মাস হল গাড়ি চালানো শিখেছি। একেবারে কাঁচা ড্রাইভার। আপনি ভয় পাচ্ছেন না তো?


প্রিয়ম বললেন আমি ডেস্টিনিতে বিশ্বাস করি। যার যেটুকু আয়ু লেখা আছে তা আর কমানো বাড়ানো যাবে না। রক্তিমা চলে যাবার পর স্টোয়িক হয়ে গিয়েছি। সার বোঝা বুঝে গিয়েছি যে, নিয়তি কেন বাধ্যতে।



মাইলের পর মাইল পাহাড়ি জঙ্গল। এতক্ষণ কোনও গাড়িঘোড়া দেখিনি, এবার চোখে পড়ল এক বৃদ্ধ একটু ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছেন পথের ধার দিয়ে। এতক্ষণ ফাঁকা রাস্তা দিয়ে আসার পর হঠাৎ এক-আধটা মানুষ দেখলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। হর্ন দিলাম। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ ফেরালেন। ধবধবে ফর্সা এক শ্বেতাঙ্গ। আউলবাউল সোনালি চুল, একমুখ সাদা দাড়ি। তাঁকে ছাড়িয়ে এগোলাম। এই জঙ্গলে শ্বেতাঙ্গ এলেন কী করে? আশেপাশে কি লোকালয় আছে? একটু ইতস্তত করে বললাম, আচ্ছা এই পথে শুনেছি কীসব রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। সত্যি?



প্রিয়ম অবাক হয়ে বললেন, আপনি কী করে জানলেন? হ্যাঁ এরকম একটা গুজব এই পাহাড়ে চালু আছে বটে। আমি পঞ্চগনি থেকে ড্রাইভ করে এই পথ দিয়ে ফিরেছি বহুবার। দু'একবার অদ্ভুত আলো দেখেছি জঙ্গলের গভীরে। সেসব মানুষ জ্বালিয়েছিল কি না জানি না। তবে আমি দাঁড়াইনি। বেরিয়ে এসেছি সোজা।



জঙ্গল শেষ হয়ে এল। টিপটিপ বিন্দুর মতো আলো ছড়িয়ে আছে চোখের সামনে। পথের ধারে স্ট্রবেরি সাজিয়ে বসে আছে দোকানি। ফ্রুটজুসের দোকানে গিজগিজে ভিড়। বেশির ভাগই টুরিস্ট। হোটেল আর রেস্তোঁরাও খোলা। বাইরে গাড়ি পার্ক করা। ফুটপাথ দিয়ে বাহারি পোশাক পরা টুরিস্ট ঘোরাফেরা করছে। তার মধ্যে দেখি সাদারঙা ঘোড়ার পিঠে চেপে একজন চলেছে রাস্তার ধার দিয়ে। মহাবালেশ্বরে ঢুকে পড়েছি বোঝা যাচ্ছে। প্রিয়ম নড়েচড়ে বসলেন। শিশুকন্যাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে দিয়ে আদুরে স্বরে বললেন, উলকি, চলে এসেছি আমরা। সোনা মা, ওঠো এবার।



উলকি ঘুমচোখে একটা হাই তুলে চোখ খুলল। আড়মোড়া ভাঙল বাইরের দিকে তাকিয়ে। প্রিয়ম জানতে চাইলেন, কোথায় উঠবেন? আমাদের বাড়িতে আপনি স্টে করতে পারেন। দু-দুটো স্পেয়ার ঘর আছে। কোনও অসুবিধা হবে না।



আমি হেসে বললাম, দরকার হবে না। হোটেল বুক করা আছে।



হোটেলের নাম বললাম। প্রিয়ম বললেন, তাহলে সামনের বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে যান। একশো মিটার গেলেই আপনার হোটেল পাবেন।



আমি বললাম, এর আগেও এসে থেকেছি ওখানে। চিনে নিতে অসুবিধা হবে না।



প্রিয়ম হাসলেন, ব্যস এখানেই ড্রপ করে দিন আমাদের। মিনিট পাঁচেকের পথ হেঁটেই চলে যাব বাপেতে মেয়েতে। থ্যাংক ইউ ওয়ানস আগেন।



ভদ্রলোক নেমে গেলেন মেয়েকে নিয়ে। আমি একটু এগিয়ে গাড়িটা দাঁড় করালাম হোটেলের সামনে। রিসেপশনে ডেস্কের ওপারে একজন কর্মী বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে খোসগল্প জুড়ে দিয়েছেন ছোটখাট চেহারার চান্দেকারজি। দু'বছরে বদলাননি একটুও। চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখে নিজের হাতঘড়িটা জরিপ করে বললেন, এত দেরি হল যে! আমি তো টেনশন করছিলাম আপনার জন্য। ফোনে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লাইন পাচ্ছিলাম না।



বললাম সব বৃত্তান্ত। পঞ্চগনি থেকে যে প্রিয়ম চ্যাটার্জি আর তাঁর মেয়েকে এই হিলস্টেশন অবধি লিফট দিয়েছি সেটাও জানালাম। রিসেপশনিস্ট বেল টিপলেন। সাদা পোশাক পরা এক ছোকরা পরিচারক এসে দাঁড়াল আমার সামনে। আমার হাত থেকে লাগেজব্যাগটা নিয়ে হাঁটা দিল হনহন করে। আমি পিছুপিছু যাচ্ছিলাম। দাঁড়ালাম চান্দেকারজির গলা শুনে। প্রবীণ মানুষটি ভুরু তুলে বললেন, কী নাম বললেন?



আমি আর একবার নাম বললাম। চান্দেকারজি বললেন, যান, ফ্রেশ হয়ে আসুন। একটু আড্ডা দিই আপনার সঙ্গে।



আমি পোশাক বদলে এলাম নিচে। এসে দেখি রিসেপশন ডেস্ক থেকে চান্দেকারজি চলে এসেছেন লাউঞ্জে। হেলান দিয়ে বসে আছেন একটা সোফায়। ইংরেজি গান বাজছে মিউজিক সিস্টেমে। মজার ছলে আমার দিকে ষড়যন্ত্রকুটিল মুখ করে বললেন, একটুখানি ড্রিঙ্ক হোক?



আমি আর সায়র দু'রাত্তির ছিলাম এখানে। সায়র আর চান্দেকারজি এই লাউঞ্জে বসেই মদ্যপান করেছিল একসঙ্গে। আমি রেড ওয়াইন নিয়ে কোম্পানি দিয়েছিলাম। হেসে বললাম, আপনি তো জানেন আমি অ্যালকোহলিক নই। অবশ্য ড্রিঙ্ক নিয়ে তেমন ট্যাবুও নেই। 



বৃদ্ধ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, এতটা পথ ড্রাইভ করে এসেছেন, স্ট্রেন গেছে শরীর আর মনের ওপর দিয়ে। একটুখানি ব্র্যান্ডি মিশিয়ে দিই গরম কফির মধ্যে। দেখুন আরামে ঘুম চলে আসবে। উঠে গিয়ে দুটো কাগুজে পেয়ালা নিয়ে এলেন প্রবীণ মানুষটি। একটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, দেখুন কেমন লাগে।



আমি চুমুক দিয়ে বললাম, অদ্ভুত স্বাদ তো। বেশ অন্যরকম।



কয়েক সিপ নিলাম। বেশ আরাম বোধ হল। চান্দেকারজি একটা শ্বাস ফেলে বললেন, আগেরবার দুটো দিন আনন্দে কেটেছিল। সেসব কথা মনে পড়ছে খুব। আপনাদের বস মিস্টার মোরে আর ওঁর স্ত্রী এর মধ্যে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। ওঁদের কাছ থেকেই জানলাম সব। সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে। আই বিলিভ ইন ডেস্টিনি। বিশ্বাস করি যে, এভরিথিং ইজ প্রি-ডেস্টাইনড। আপনি আমি নিমিত্ত মাত্র।



চুপচাপ চুমুক দিচ্ছি কাগজের কাপে। দৈবে বিশ্বাসের কথাটা একটু আগে প্রিয়ম চ্যাটার্জিও বলেছিলেন। মনে পড়ে গেল ওঁর কথাগুলো। পানীয় শেষ হয়ে গেল একসময়। চান্দেকারজি উঠে গিয়ে দ্বিতীয় কাপ বানিয়ে নিয়ে এলেন। হৃষ্টচিত্তে বললেন, ওই যে ভদ্রলোক, যাঁকে লিফট দিলেন পঞ্চগনি থেকে, তাঁর সঙ্গে কী করে দেখা হল আপনার?



আমি গোটা ঘটনাটাই বিস্তারিত বললাম। প্রিয়ম চ্যাটার্জি যে একজন সজ্জন মানুষ ও তাঁর শিশুকন্যাটিও যে ভারি মিষ্টি তা-ও জানালাম। চান্দেকারজি চোখ বুঁজে সব শুনলেন। মৃদু স্বরে বললেন, আগের বার কথাটা বলেছিলাম মনে আছে?



আমি বললাম, কী কথা?



চান্দেকারজি বললেন, কী জানেন, বাইরের টুরিস্টের কথা ছাড়ুন, এই পাহাড়ের বাসিন্দারাই সকলে জানে না যে, পঞ্চগনি থেকে মহাবালেশ্বর পর্যন্ত সড়কপথ সন্ধের পর রহস্যময় হয়ে যায়। আনক্যানি ঘটনা ঘটে।



আমি নড়েচড়ে বসেছি। ভুরু ধনুক করে বললাম, আনক্যানি বলতে? ভৌতিক কিছু?



চান্দেকারজি মাথা নেড়ে বললেন, ভূতটুতের কারবার নয়। সন্ধেবেলা ওই পথ দিয়ে গেলেই যে সকলের ইরি ফিলিং হবে, সকলেই যে আনন্যাচারাল কিছু এক্সপিরিয়েন্স করবে তা নয়। একটা ইনফরমেশন দিই আপনাকে। মহাবালেশ্বরে হাতে গোনা কিছু বাঙালি পরিবার থাকলেও প্রিয়ম চ্যাটার্জি বলে কেউ এখানে থাকেন না। ইন ফ্যাক্ট ওই সারনেমে কোনও ব্যবসায়ী পরিবার এখানে নেই।



আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, সে আবার কী!



চান্দেকারজি বললেন, যারা জীবনে একা হয়ে গেছে, তাদের অনেকেরই এই পথে রহস্যময় অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রকৃতির কোন দুর্জ্ঞেয় অভিসন্ধি আছে নির্ঘাৎ। তা না হলে সে এমন যত্ন করে কেন ইলিউশন তৈরি করে দেবে সেই নিঃসঙ্গ মানুষটার মধ্যে যার মনের নদী শুকিয়ে গেছে? কেন সেই একা হয়ে যাওয়া মানুষটাকে উপহার দেবে এমন এক অদ্ভুত মায়া? এই পাহাড়ের প্রকৃতির স্বভাব খেয়ালি শিশুর মতো। সে জগতের ওপর ভরসা উঠে যাওয়া একজনকে মনে করিয়ে দেয়, সব মানুষ খারাপ নয়।



আমার একটু টিপসি টিপসি লাগছিল। সেটা কেটে গেল এক ঝটকায়। বললাম, মানে?



চান্দেকারজির মুখে প্রজ্ঞার হিজিবিজি। গলায় কুয়াশা মিশিয়ে বললেন, আমরা কেউই আমাদের মনের হদিশ জানি না। আপনার বিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন পুরুষজাতির ওপর থেকে। কিন্তু আপনার মন তলে তলে খুঁজে বেড়াচ্ছে একজন পারফেক্ট লাইফ পার্টনার, যে আপনাকে কমপ্লিমেন্ট করবে সবসময়। যাকে আপনি ভালবাসবেন। যে আপনাকে ছেড়ে যাবে না কখনও। যে আপনাকে উপহার দেবে ফুলের মত ফুটফুটে শিশু।



ব্র্যান্ডি মেশানো কফির তলানিটুকু শেষ করলাম চোঁ চোঁ করে। বললাম, বুঝতে পারলাম না।



চান্দেকারজি গাঢ় স্বরে বললেন, বুঝিয়ে বলছি। আমার জীবনে একটা তেতো ঘটনা আছে, খুব কাছের বন্ধুরাই সেটা জানে। আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই। সম্বন্ধ করেই বিয়ে হয়েছিল আমার। শুভলক্ষ্মী এক ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে। দেখতে শুনতে ভাল। কথাবার্তা নম্র। স্বভাবেও মিষ্টি। বাড়ির সকলের সঙ্গে মিশে গেল বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্তু সে যে তলে তলে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র করছে সেটা আমরা কেউ আন্দাজ করিনি। বিয়ের দু'মাসের মাথায় শুভলক্ষ্মী বাপের বাড়ি যাবার নাম করে উধাও হয়ে গেল। তার যে বিয়ের আগে থেকেই অন্য একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আছে সেটা জানলাম আমার চরম ক্ষতি হয়ে যাবার পর।



আমি হতভম্ব হয়ে দেখছি বৃদ্ধ মানুষটিকে। বললাম, শুভলক্ষ্মীর খোঁজ পাননি আর?



চান্দেকারজি বললেন, আমরা প্রাচীনপন্থী মারাঠি পরিবার। যে সময়ের কথা বলছি তখন এমন কিছু কল্পনাই করা যেত না। সেই ঘটনার পর আমাদের পরিবারের মুখে চুনকালি লাগল। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। লম্বা ছুটি নিয়ে বসে থাকতাম বাড়িতে। মনখারাপ ছিল নিত্যসঙ্গী। ভাবতাম পৃথিবীর সব লোক আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করছে। আমাকে নপুংসক ভাবছে। শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কের স্মৃতি কুরে কুরে খেত আমাকে। একদিন একজন খবর দিল শুভলক্ষ্মীকে পঞ্চগনিতে নাকি দেখা গেছে। সেখানে সে হাঁটুর বয়সি এক ছেলের সঙ্গে সংসার পেতেছে। আমি যে পোশাকে ছিলাম সেভাবেই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে।



আমি বললাম, তার পর?



চান্দেকারজি বললেন, তখন এই রুটে গাড়িঘোড়া কম ছিল। টুরিস্টের ভিড়ও এতটা ছিল না। বর্ষাকাল ছিল সেটা। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ছাতা হাতে উঠলাম বাসে। হাতে গোনা সওয়ারি। মহাবালেশ্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ছাড়ার সময় বছর পঁচিশের একটি মেয়ে উঠে এসে বসল আমার পাশে। চোখ জুড়িয়ে যায় এমন শ্রীলক্ষ্মী তার রূপ। এক কথা দু'কথা থেকে আলাপ হয়ে গেল মেয়েটির সঙ্গে। জানতে পারলাম যে, পঞ্চগনিতে ওদের বাড়ি। বাবার নাম সুদর্শন পাটিল। সম্পন্ন কৃষক। স্ট্রবেরিখেত আছে বিশাল এলাকা জুড়ে। পঞ্চগনিতে যে কেউ পাটিল পরিবারকে চেনে। মেয়েটি লেখাপড়া জানা। বাড়ি থেকে তার জন্য সম্বন্ধ দেখছে। এদিকে সে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায়। এখনই বিয়ে করতে রাজি নয় সে। সে নিয়েই বাড়িতে অশান্তি।


একটুক্ষণ চুপ করে থেকে চান্দেকারজি বললেন, সারাটা রাস্তা গল্প করতে করতে গেলাম আমরা। কখন যে পথ ফুরিয়ে গেল জানি না। মেয়েটির শরীর থেকে ভেসে আসছিল এক আশ্চর্য সুগন্ধ। যতক্ষণ মেয়েটি আমার পাশে ছিল ততক্ষণ শুধুই সে আমার মন জুড়ে ছিল। এই সময়টুকুর মধ্যে শুভলক্ষ্মীর কথা মনেই পড়ল না। একসময় বাস পঞ্চগনিতে এসে থামল। মেয়েটি নেমে গেল। আমার মন তখন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পঞ্চগনিতে পৌঁছে প্রথমে শুভলক্ষ্মীর খোঁজ করলাম। কেউ কিছু বলতে পারল না। কী আশ্চর্য মানুষের মন, যে বিশ্বাসহন্তাকে পাগলের মত খুঁজছি তাকে না পেয়েও আমার কোনও খেদ নেই। এবার সুদর্শন পাটিলের কথা জিজ্ঞেস করলাম একে ওকে। জানতে পারলাম, পঞ্চগানিতে সুদর্শন পাটিল নামে কেউ নেই। ছিল না কোনওদিন।



আমি বিস্ফারিত চোখে বললাম, সে কী!



চান্দেকারজি ধীর স্বরে বললেন, আমার মতো অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তাদের কথা শুনে বুঝেছি যে, এই পথ সন্ধের পর থেকে অপেক্ষা করতে থাকে চুপটি করে। মনের মত পথিকের খোঁজ পেলে সে তার জন্য তৈরি করে মোহজীবন। আজ আপনার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, একদিন আমার সঙ্গেও তেমনটাই হয়েছিল। সেই ঘটনার পর শুভলক্ষ্মীকে খোঁজা ছেড়ে দিই। পরের বছর বিয়ে করি। এখন আমার সুখের সংসার। শুভলক্ষ্মীর কথা আর মনেও পড়ে না। কিন্তু সেদিনের সেই মেয়েটির মুখ আমার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। স্বপ্নের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে এখনও।

সামান্য আহার করে শুয়ে পড়েছিলাম বিছানায়। ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ করে। সন্ধেবেলার     সেই গন্ধটা আবার আসছে না নাকে? সায়রের সঙ্গে আগেরবার এই হোটেলে ছিলাম। তুমুল শরীরী আশ্লেষে কেটেছিল দুটো রাত। কিন্তু সেসব স্মৃতি নয়, সন্ধের পর থেকে যা যা ঘটেছে সেসব সেই অলীক দৃশ্যগুলো ভাসছিল চোখে। পুনে ফিরে রেহানার সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন ওকে এই অভিজ্ঞতার কথা বললে ওর রিয়্যাকশন কী হবে ভাবছি। ও চোখ বড় বড় করে বলবে, গাঁজাভাঙ খাসনি যখন বলছিস তখন নিশ্চয়ই ভূত দেখেছিস! 


কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতাকে নিছক ভুতুড়ে বলে দাগিয়ে দিতে আমি রাজি হব না। কেননা প্রিয়ম চ্যাটার্জী নামে মহাবালেশ্বরে কেউ থাকে না জেনেও আমার তো ভয় লাগছে না একটুও। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না। আমি বরং রেহানাকে বলব, আমি আমার মতো করে ভেদ করেছি দুর্জ্ঞেয় রহস্য। বুঝে নিতে পেরেছি প্রকৃতির ইশারা। জীবনে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া কোনও পথিক এই পথে এলে প্রকৃতি তার জাদুর ঝাঁপি খোলে। মায়াবি বিভ্রম তৈরি করে চোখে। পরিয়ে দেয় মায়াকাজল। অতি যত্নে তৈরি করে অলৌকিক মায়া। কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যায় এক মোহজীবনে।


রেহানা নির্ঘাৎ জানতে চাইবে, এই মোহজীবন তৈরি করার পেছনে প্রকৃতির কী উদ্দেশ্য? আমি বলব, তার উদ্দেশ্য হল, সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি, যে একবার আঘাত পেয়েছিল প্রিয়জনের কাছ থেকে, তার যাতে মানুষের উপর বিশ্বাস ফিরে আসে। চান্দেকারজি সেই ঘটনার পর শুভলক্ষ্মীকে খোঁজা ছেড়ে বিয়ে করেছিলেন আবার। সুখে সংসার করছেন এখনও। তার মানে কি প্রকৃতি আমাকে ইশারায় এই কথাই বলছে? সহমর্মী, নির্ভরযোগ্য একজন স্বামী কি তবে আসতে চলেছে আমার জীবনে? ফুটফুটে কোন দেবশিশুও কি অপেক্ষা করছে আমার কোল আলো করে আসার জন্য? 


নাক টানলাম একবার। সেই সুগন্ধ ভেসে আসছে না নাকে? নাকি এ আমার মনের ভুল? সন্ধের অলৌকিক মুহূর্তগুলিতে ফিরে যেতে চাইছি বলেই কি এই সুঘ্রাণ কল্পনা করে নিচ্ছে আমার অবচেতন মন? ধুত্তোর অত ভেবে কাজ নেই। মহাবালেশ্বরের আবহাওয়া এখন মনোরম। কফি মেশানো ব্র্যান্ডির  প্রভাবে একটু ঘুমঘুম ভাব এসেছিল। সেটা কেটে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। গরম ব্ল্যাংকেটটা নাক অবধি টেনে চোখ বুঁজলাম। টেনে ঘুমোতে হবে এবার। যতক্ষণ ঘুম না আসছে ততক্ষণ বরং প্রিয়ম চ্যাটার্জী আর উলকির সঙ্গে মনে মনে একটু কথা বলে নিই।

চিত্র - শ্রীহরি

Comments

Post a Comment