গল্প - মন্দিরা দে



মন ছুঁয়ে যাই...


এবারও বেজে গেল ফোনটা। মনে মনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো তৃষ্ণা। দুদিন নীল একটাও মেসেজের কোনো রিপ্লাই করছে না। ফোন ধরছে না। তৃষ্ণা কিছুতেই শান্তি পায়না। মনটা বারবার ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এই তিনবছরে এমন কখনো হয়নি। এমনকি আটমাস আগে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে যখন মিসক্যারেজ হয়ে যায় মিশার তখনও সবার আগে তৃষ্ণাকেই ফোন করেছিল নীল‌। সেই দিনগুলো মনে পড়লে আজও বুক কেঁপে ওঠে তৃষ্ণার‌। কিভাবে যে কেটেছিল সেই আটচল্লিশ ঘন্টা আজও ভাবলে শিউরে ওঠে সমস্ত শরীর। কিছুতেই বাঁচানো গেলোনা মিশাকে। অতিরিক্ত রক্তপাতের জন্য নীলকে ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে চলে গেলো মিশা। অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া তৃষ্ণা জানে একা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাটা। দুহাত দিয়ে ওর আগলেছিল নীলকে। মিশা ছিল তামিল ব্রাহ্মণ। নীল বিশুদ্ধ বাঙালি। ওদের ভালোবাসাটা কোনো বাড়িতেই মেনে নেয়নি। তাই সেই যন্ত্রণার দিনগুলোতে শুধু তৃষ্ণা ছিল নীলের পাশে। আর ছিল দু'জনের কিছু অফিস কলিগ। কলেজের বন্ধুরাও কেউ আসতে পারেনি। কিন্তু এসেছিল, মিশার বাড়ির লোকজন, অনেক পরে। পুলিশ নিয়ে। তৃষ্ণা সেদিন লড়েছিল নীলের জন্য। জানপ্রাণ দিয়ে। ওদের অভিযোগ মিথ্যে, প্রমাণ করে দিয়েছিল ও। উকিল, সাক্ষী কোনোকিছুরই অভাব বুঝতে পারেনি নীল। কোর্ট থেকে বেরিয়ে বলেছিল, "কেন বাঁচালে? চলেই যেতাম না হয় মিশার কাছে।"
ধমকে উঠেছিল তৃষ্ণা, "চুপ কর। বাঁচালাম তোমাকে আমার জন্য। তোমার মতো বন্ধু হারাতে পারবো না আমি। বাড়ি চল।"
 তিনদিন তৃষ্ণার ফ্ল্যাটে থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি গিয়েছিল নীল।
 খুব লাইভলি ছিল নীল। অফিসে জয়েন করে প্রথম বন্ধুত্ব হয় ওর তৃষ্ণার সাথে। নীলের দু'মাস আগেই জয়েন করেছিল তৃষ্ণা। ছোট শহরের অনাথ আশ্রম থেকে আসা ভীতু চুপচাপ তৃষ্ণাকে ভালো লেগে যায় নীলের। টুকরো টুকরো কথাবার্তা থেকে একসাথে ক্যান্টিনে চা, খাবার খাওয়া, নানা গল্প, খুনসুটি, একে অপরকে বিরক্ত করা, সবকিছুতেই ওরা একসঙ্গে। বন্ধুত্বটা জমে উঠতে দেরি হয়নি। তারপর সে বন্ধুত্ব কখন এতো আপন হয়ে গেছে ওরা জানতেই পারেনি। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে সারাক্ষণ বকবক চলতো দুজনের। মিশার কথা বলেছিল নীল তৃষ্ণাকে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তারপর মিশার সঙ্গেও বন্ধুত্ব জমে উঠতে দেরি হয়নি। ওদের বিয়ের সময় ওদের পাশে পাশে ছিল তৃষ্ণা। সবকিছুতে। সবসময়। বাড়ি খোঁজা, বিয়ের বাজার করা, রেজিস্টারের ডেট নেওয়া সব তৃষ্ণা একাই করেছে। ওরা দুজনে তখন নিজের নিজের বাড়ির সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু জিততে পারেনি কেউ। ক্লান্ত দুজনে যখন তৃষ্ণার কাছে এসেছিলো, তৃষ্ণা দুহাতে কাছে টেনে নিয়েছে ওদের। দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে। সংসার গুছিয়ে দিয়েছে। নীল মজা করে ওকে বলেছে, "কে বলবে তুমি আমাদের থেকে একবছরের ছোটো! ঠানদি কোথাকার!"
তৃষ্ণা গম্ভীর হয়ে বলেছে, "তবে আর কি! আজ ঠানদি বলেই ডেকো।"
তারপর আঠেরোটা মাস কেটেছে স্বপ্নের মতো। প্রতি রবিবার তৃষ্ণা চলে যেতো ওদের বাড়ি। কখনো রান্না করে খাওয়াতো নিজের হাতে। কখনো মিশা দক্ষিণী রান্না করে খাওয়াতো। আবার কখনো ওরা বেরিয়ে পড়তো সারাদিনের জন্য। সিনেমা দেখে বাইরে খেয়ে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে অনেক রাতে তৃষ্ণাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরতো নীল মিশা‌। যখন মিশা আর নীল ঝগড়া করে দুজনেই ওকে শালিসি মানতো… ভীষণ একটা আপন আপন গন্ধ পেতো ও। আর থাকতে পারলোনা তৃষ্ণা। হলোইবা রাত, লকডাউন, এখনই ওকে যেতেই হবে নীলের কাছে। 
বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। বেল বাজায় ও। বারবার। অনেকক্ষণ পরে দরজা খোলে নীল। দরজা ধরে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে বলে, "তুমি? এতো রাতে?"
তৃষ্ণা এগিয়ে এসে হাত ধরে ওর। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে নীলের শরীর। প্রচন্ড পেটব্যথা। দুদিন প্রায় কিছুই খায়নি ও। ধরে ধরে ভেতরে এনে বসায়। আলো জ্বালে। রান্নাঘরে ছুটে যায়, একটু কিছু খাবার বানিয়ে আনার জন্য। কিছু নেই মজুত। শুধু একটু গুঁড়ো দুধ কফি আর বিস্কুট খুঁজে পায় ও। তাই বানিয়ে এনে জোর করে খাওয়ায়। নিজের ব্যাগে রাখা প্যারাসিটামল আর পেটব্যথার ওষুধ বের করে খাওয়ায়। মাথা ধুইয়ে দেয়। শেষ রাতে জ্বর কমলে ঘুমিয়ে পড়ে নীল। পাশে চেয়ারে বসে তৃষ্ণাও। অনেক বেলায় ঘুম ভেঙে নীলের কপাল ছোঁয় ও। জ্বর নেই। নীল চোখ মেলে তাকায়। বলে, "তুমি না এলে হয়তো বাঁচাতাম না।"
তৃষ্ণা হাসে। বলে, "আসতে তো হতোই আমাকে। একটু দেরিই হয়ে গেলো। এবার একটু কফি করে আনছি। খাও। তারপর অনেক কাজ আমার। বাজার, রান্না, ঘরটাকে পরিষ্কার করা, তোমার দেখাশোনা.."
কফিকাপটা তৃষ্ণার হাত থেকে নিয়ে নীল বললো, "কফিটা খেয়ে আগে একটু ফ্রেশ হয়ে এসো। সারারাত একটুও ঘুমাওনি তুমি। জামাকাপড় তো কিছুই আনোনি।  আলমারিতে মিশার অনেক জামাকাপড় আছে। কিছু একটা পড়ো।"
"আমি পারবো না নীল।"
"থাক তবে। মিশা কিন্তু খুব খুশি হতো।"
"তুমি খুশি হবে নীল?"
"হবো। তুমি আর মিশা ছাড়া আর যে আমার কেউ নেই। কিন্তু এভাবে যে চলে এলে, আমার যে ভীষণ জ্বর! যদি…"
"বোকাবোকা কথা বলোনা। শুধু জ্বর হলেই কিছু হয় না।"
"তুমি বুঝতে পারছো না।"
"খুব পারছি‌। তোমার অতো ভাবতে হবে না।"
মিশার আলমারিটা খুলে কেঁদে ফেললো তৃষ্ণা। সুন্দর করে গোছানো সব। যেন এক্ষুনি এসে মিশা দাঁড়াবে পাশে। আগের মতোই বলবে, "দেখো, এই শাড়িটা ওনামের দিন পড়বো। ভালো হবে না?" 
চেনা ডাক্তারকে ফোন করে তৃষ্ণা। তিনি সমস্তকিছু খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করেন। নীলের সঙ্গে কথা বলেন, জিজ্ঞাসা করেন বাইরে কিছু খেয়েছে কিনা। নীল জানায়, দিন পাঁচেক বাড়ির যে কাজ করে দেয় সে না আসায় দুবেলাই হোটেলই চলছে।  তিনি ওষুধ বলে দিলেন। দিনে চার থেকে ছ'বার জ্বর মেপে লিখে রেখে ওনাকে জানাতে বলেন। ওষুধ কিনে বাজার করে রান্না করে ঘর পরিষ্কার করে নীলকে স্নান করিয়ে খেতে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিল তৃষ্ণা। বাসনগুলো কোনোরকমে ধুয়ে নীলের জ্বরটা একবার দেখে নিয়ে পাশেই শুয়ে পড়েছিল ও। সারারাত ঘুম হয়নি, সারাদিনের পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত শরীরে যখন তৃষ্ণার ঘুম ভাঙলো তখন রাত হয়ে গেছে। ঘুম ভেঙে প্রথমেই অনুভব করলো, নীলের হাতটা ওর পেটের ওপর। মোবাইলের আলোটা জ্বেলে সময় দেখলো তৃষ্ণা। নীলের দিকে ফিরে দেখলো, পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ও। ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল তৃষ্ণার। নিশ্চিন্তও হলো জ্বরটা নেই বুঝতে পেরে। চা করে এনে ডাকলো ওকে। জ্বরটা দেখে লিখে রাখলো। দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করে স্যুপ-ব্রেড খেয়ে ওরা যখন ঘুমাতে গেল, তখনও জ্বর নেই। জ্বরটা এলো মাঝরাতে। বেশ জ্বর। তৃষ্ণা ওষুধ দিয়ে মাথা ধুইয়ে দিয়ে জ্বর কমায় প্রায় ভোরে। সকাল হতেই ডাক্তারকে ফোন করে। তিনি বলেন, পেটের ভেতর বেশ ভালো রকমই ইনফেকশন হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। ওষুধ দেন। এন্টিবায়োটিকও। তাতেও না কমলে হসপিটাল ছাড়া গতি নেই। এই অবস্থায় ভয় পায় তৃষ্ণা। তবু মনের জোর হারায়না। তিনদিন পর নীল কিছুটা সুস্থ হতে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় তৃষ্ণা। ঘরের কাজ সামলানোর মহিলাটি ফিরে আসাতে তৃষ্ণা বাড়ি ফেরার কথা ভাবে। নীল বলে, "থেকে যাও তৃষ্ণা।"
তৃষ্ণা বলে, "এখন তো ভালো আছো নীল। অনেক দিন হয়ে গেল। এবার ফিরি। অফিসের কাজও তো সব পড়ে আছে।"
"তবে সব নিয়ে এখানেই চলে এসো।"
"বেশ। আজ যাই। কাল কয়েকদিনের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে আসবো।"
"কয়েকদিন নয়। বরাবরের জন্য চলে আসতে পারো না তৃষ্ণা?"
"বরাবরের জন্য! কি পরিচয়ে?"
"শুধু বন্ধুত্বের জোরেই কি আমার কাছে থাকতে পারো না তৃষ্ণা?"
বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রথমদিনটার কথা মনে পড়ে যায় তৃষ্ণার। নীলের চোখদুটো বড় মায়াময়… বন্ধুকে ভালোবেসে বন্ধু হয়ে সারাজীবন পাশে থাকা যায় কি! হয়তো এর উত্তর ভবিষ্যতই বলে দেবে…..



Comments