গল্প - ব্রততী সেন দাস


ভিজে বাতাস


-মাহি, কাল ও বাড়িতে মনে হয় নতুন ভাড়াটে এসেছে, জানিস। আজ ছাদে জামা কাপড় মেলা দেখলাম,বিশাখা বলল।

- তাই, কারা এসেছে জানো? মাহি স্কুল থেকে ফিরে হাত- মুখ ধুয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল।

- না, এখনও আলাপ হয়নি কিন্তু মনে হয় খুব ছোট পরিবার।

মাহি এবার সামান্য কিছু খেয়ে ছাদে যাবে। একটু হাঁটবে, গল্পের বই পড়বে তারপর সন্ধে হলে নীচে নেমে গান নিয়ে বসবে। এরপর পড়তে বসা।প্রতিদিন এক রুটিন। এ পাড়ায় ওর কোন বন্ধু নেই। কাছেই স্টেশন বলে মা কিছুতেই বিকেলে একা একা বাইরে বেরোতে দেয় না। ছুটির দিন শুধু বাবার সঙ্গে ঘুরতে যায়। গানের ক্লাস, কখনও ছোটমামার বাড়ি, বা পিসিদিদুর বাড়িতে যায়!


আজ ছাদে গিয়ে পাশের বাড়ির দিকে চোখ চলে গেল। সত্যি এক নতুন মানুষকে দেখল। ওরই বয়সী একটি মেয়ে  স্কিপিং করছে। মাহির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। মাহি বলল- তোমরা নতুন এসেছ?

মেয়েটি স্কিপিং থামিয়ে পাঁচিলের দিকে এগিয়ে এসে বলল- হ্যাঁ, আমার নাম টুটুল। তোমার নাম কী?

এই দিন থেকে শুরু। মাহি আর টুটুলের বন্ধুত্বের।


পাশের বাড়িটা অনিমেষ বসুর। আগে ওঁরা নিজেরাই থাকতেন। কিন্তু ওঁদের একমাত্র ছেলে মুম্বাই চলে গেলে বাবা মাকেও সঙ্গে নিয়ে যায়, সেই থেকে বাড়িটা পড়েই ছিল। টুটুলের বাবা অগ্নিভ আর মা সুকন্যা বাড়িটা ভাড়া নেওয়াতে সবচেয়ে খুশি বোধ হয়  বিশাখা হল। সে সারাদিন ঘরেই থাকে। তার ওপর পাশের বাড়িটা এমন ভূতের বাড়ির মত নিঝুম হয়ে থাকলে কেমন যেন লাগে। উপরন্তু  মাহির একজন সমবয়সী বন্ধু পাশের বাড়িতে পাওয়া তো উপরি পাওনা।


মাহি নয়নতারাদেবী উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। টুটুলও ক্লাস নাইন,  কিন্তু ও পড়ে কলকাতার এক মিশনারি কনভেন্ট স্কুলে। সকালে রেডি হয়ে বাবার সঙ্গে বাবার অফিসের গাড়িতে বেরিয়ে যায়। বিকেলে বাড়ির গাড়ি ওকে নিয়ে আসে। টুটুলের মাও কোন এক বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলে চাকরি করে।


বিশাখা যতটা ভেবেছিল সেরকম কিছু হল না।অগ্নিভ আর সুকন্যা অসম্ভব ব্যস্ত আর অন্য জগতের লোক। তাদের গাল- গল্প করার মত যথেষ্ট সময় নেই। নিজেদের মধ্যে কতটুকু দেখা হয় কে জানে। মেয়েটিই তো নিজের মত করে বেড়ে উঠছে। পড়াশোনা, টিউশনি, এক্সারসাইজ করা সব নিজের মত করে সামলে নেয়। বাবা মা এত ব্যস্ত কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর কোন ফাঁকিবাজি নেই। পড়াশোনায় ও তুখোড়, স্কুলেও ও যে কোন ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে  মুখ্য ভূমিকায়। ওকে দেখে বিশাখা মেয়েকে বলতে থাকে - দেখে শেখ।কী দুর্দান্ত মেয়ে! বাবা মা থাকে না অথচ নিজের চেষ্টার কোন খামতি নেই!আর তুই....?

- কী মা, আমার সাথে শুধু শুধু কেন তুলনা করছো? ভেরি ব্যাড হ্যাবিট!

- কেন করব না বল তো? তোর জন্য তোর বাবা বেচারি কী না করে। সারাদিন অফিস করে। ঘেমে নেয়ে এসে জামা কাপড় ছেড়েই, এক কাপ চা খেয়ে তোকে নিয়ে বসে যায়। আর তোর অবস্থা দেখ, কোন চেষ্টা আছে? কালকের অঙ্কগুলো করা হয়েছে, বাংলা রচনা লিখেছিস?

-  রচনাটা তো লিখব বললাম। অঙ্ক আমার মাথায় না ঢুকলে কী করব? ও মা, মা গো আর একদিন টিফিনে দই বড়া, করে দেবে? আজ যা বানিয়েছ  না ফাটাফাটি! মাহি বিশাখার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে উঠল।

- আচ্ছা, দেব দেব। এখন ছাড় দেখি, বিশাখা হেসে ফেলল।

- আগে আমায় চুমু খাও!

- আহা! ধাড়ি মেয়ের ঢং দেখ।

এই সময় মাহির বাবা সুদেব বাড়ি ফেরে। আজ এক মস্ত বড় লিচুর পোঁটলা  নিয়ে বাড়ি ঢুকল- মাহি, ফেরার পথে শেয়ালদায় ভাল বারুইপুরের লিচু পেলাম। কাল ছুটি আছে, দুই বন্ধুতে মিলে খাস। মা ছাড়িয়ে দেবে।

বিশাখা ঝঙ্কার  দিয়ে বলল- আহা, বুড়ো ধাড়ি মেয়ে লিচু ছাড়িয়ে খেতে পারে না, আহ্লাদ দেখ! আচ্ছা শোন, কাল যদি বাজারে গিয়ে ভাল মাগুরমাছ পাও  নিয়ে এসো তো।

মাহি বলল- মাগুর মাছ! ম্যা গো!আমি খাই না।

বিশাখা বলল- তুই না খেলি। টুটুল খেতে চেয়েছে।আমার হাতের মাগুর মাছের পেঁয়াজ  আদাবাটা, গোলমরিচ, গরম মশলা দিয়ে মাখা মাখা ঝাল ওর খুব প্রিয়। ওর জন্মদিনের দিন বানাবো। পরশু ওর জন্মদিন না?

ছুটির দিন টুটুল পড়াশুনো শেষ করে মাহির বাড়িতে চলে আসে। তারপর সারাদিনই এখানেই প্রায় কাটায়। ওদের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্ব থেকে গড়িয়ে প্রায় আত্মীয়তায় পর্যবসিত  হয়েছে। ওরা যেন দুই সহোদরা। দুই বন্ধু কিন্তু আকৃতি আর প্রকৃতিতে  পুরো  আলাদা। মাহি ফর্সা, এক মাথা কোঁকড়া চুল আর মুখখানা পুতুল পুতুল, আহ্লাদী।নিষ্পাপ সরলতার সঙ্গে একটু ভালমানুষীর ছাপ আছে। আর টুটুল শ্যামলা লম্বা, বেতের মত চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ততা চোখে মুখে। চুল পুরো ছেলেদের মত ছাঁটা আর চোখে চশমা। সুদেব আর বিশাখা টুটুলকে ভারি পছন্দ করেন। বেচারি সারাদিন মা ছাড়াই থাকে, কেউ ওকে দেখার নেই, আহারে! বাড়িতে শুধু বুড়ি ঠাকুমা আর একজন চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক।


মাধ্যমিকের পর উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠে মাহি ঠোক্কর খেল। কোনরকমে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করে কলেজে বাংলা নিয়ে ভর্তি হল। টুটুল বরাবর বিজ্ঞান নিয়েই পড়েছে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর জয়েন্ট দারুণ র‍্যাঙ্ক করে বিরাটি ছেড়ে  কলকাতায় চলে এল পড়তে। এরপর দুই বন্ধুর যোগাযোগ, দেখাশোনা কমতে কমতে শেষে ওদের বন্ধুত্ব অন্তরের নিভৃত কোণে রয়ে গেল এক সুখ স্মৃতি হয়ে।


******


- আমি যদি ভুল না করি তুমি মাহি না? ঘুরে তাকিয়ে মাহি দেখে এক বছর চল্লিশের ছিপছিপে ভদ্রমহিলা ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে। পরনে মহার্ঘ শাড়ি, গ্ল্যামার যেন উপছে পড়ছে। চুলের কাট আর রিমলেস চশমার পেছনে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুখানি দেখে মাহির চিনতে এক মুহূর্ত লাগল না- টুটুল!

- টুটুউউউল! বলে মাহি চিৎকার করে টুটুলকে জড়িয়ে ধরল, জাপ্টে কষে। আশেপাশের লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল দুই মধ্য বয়স্কার উচ্ছ্বসিত আবেগের নির্মল প্রকাশ!অনেকদিন পরে, বহু যুগ পার করে দুজন দুজনকে দেখল। সময় আঁচড় চিহ্ণ ছেড়ে গেছে কম বেশি দুজনের ওপর। মাহির পৃথুলা শরীরে নানা রোগ ভোগের ক্লান্তি। অবিন্যস্ত ভাবে শাড়ি পড়া। চুল এলোমেলো। টুটুল তুলনামূলকভাবে অনেক সুঠাম, বয়সটা ত্রিশের কোঠায় আটকে রেখেছে, একটা সুন্দর তসর আর মাননসই এক্সেসরিজ ওর অভিজাত রুচির প্রকাশ করে। কিন্তু চুলে রূপালি ঝিলিক চোখ এড়ায় না।


ফুডকোর্টে দুজনে দুটো লস্যির গ্লাস নিয়ে বসল।টুটুল চিরকালই মিতবাক, এখনও ওর উজ্জ্বল চোখ দুখানি স্মিত হাসিতে বাঙ্ময়। মাহিকে বলল- কেমন আছিস?মাসিমা মেসোমশাই কোথায় আছেন? তুই কোথায় আছিস?

-দাঁড়া, দাঁড়া তোকে আগে দু চোখ- মন ভরে দেখেনিই। মা প্রায়ই তোর কথা জিজ্ঞেস করে, আমার কাছে শুনলে কী খুশিই না হবে মা, ভাবতেই পারছি না। আচ্ছা টুটুল, তুই কী করে পারলি রে আমাকে ভুলে থাকতে? জানিস ,তোরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর আমি তিন রাত্রি ঘুমোইনি!

টুটুল হেসে বলল- না ঘুমিয়ে বুঝি এই বপুখানা বানিয়েছিস?

- হাসিস না, তোকে না খুন করে ফেলতে হয়, জ্বালানি বুড়ি কোথাকার!

টুটুল আলতো করে মাহির গালটায় আদর করে বলল- তোদের কাছ থেকে যে আদর পেতাম আজ আর কেউ করে না রে!

মাহি থমকে গেল। টুটুলের কোন অন্তর্লীন, গোপন জীবনযন্ত্রণা  আছে মাহির বরাবর মনে হতো। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কখনো টুটুলকে খোঁচায়নি।

- চল, আমার বাড়িতে?

- বিরাটিতে?

- না রে, এইখানে। আমি কাছেই থাকি।

- আর মাসিমা, মেসোমশাই?

- মা, বাবা পুরনো জায়গায় আছে। বাবা রিটায়ার করেছে, এখন সারাক্ষণ বাগান নিয়ে ব্যস্ত, লাউ, কুমড়ো, লঙ্কা, বেগুন - টমেটো ফলিয়ে বাজার খরচ কমাচ্ছে। ভালই আছে।

-তুই কী করছিস? 

- একটা বেসরকারি স্কুলে বাংলা দিদিমণি। আর বাপ মা একটা বুড়ো হাবড়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে তার সংসার আর সন্তান পালন করছি। বাড়িতে প্যারালাইজড শ্বশুর আর এক খিটখিটে শাশুড়ি আছে তাদেরকেও সন্তুষ্ট রাখা আমার এক মহাদায়িত্ব! বলে  মাহি আলগা হাসল, একটু আনমনা হল কি? 

- আচ্ছা

- দেখ না, মাথার চুল উঠে গেছে, প্রেসার- সুগার সব নিয়ে ভরা সংসার..... এবার তোর কথা বল, বিয়ে করেছিস? তোকে দেখলে মাইরি হিংসে হয়!

- করেছিলাম, ডিভোর্স হয়ে গেছে।

- সে কি, কবে! ছেলে মেয়ে?

- কেউ নেই।

- আন্টি, আঙ্কেল, দিম্মা কেমন আছেন সব?

- সব ছারখার রে! সব থেকেও কেউ নেই। তোদের ওখান থেকে চলে এলাম যে বছর তার আগেই বাবা তার অফিসের এক কলিগ ভদ্রমহিলার সাথে আলাদা হয়ে গেছিলেন দিম্মাকে আর আমাকে মায়ের কাছে রেখে। কিছুটা বাবার কারণে আমি গুটিয়ে থাকতাম। বাবা দিম্মার একমাত্র ছেলে, দিম্মা এই শোক সহ্য করতে না পেরে দু বছর পরে স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন।

- সেকি! দিম্মা নেই?

- নাহ! দিম্মাকে শেষবারের মত দেখতেও আসেনি সেই লোকটা, আমি যাকে বাবা বলে ডাকতাম।টুটুল মাথা নীচু  করে আঙুলের আংটিটা দেখতে লাগল। দৃষ্টিতে অসহ বেদনা।

- এখন তাহলে তুই আর আন্টি থাকিস?

- পাগল, আমরা দুজনে একসাথে থাকব! মা তার বন্ধু শেখর শঙ্করমের সাথে থাকে সাউথ সিটিতে। আমি আছি আমার মত। চাকরি বদলানোর কথা ভাবছি, হয়ত সামনের বছর সিঙ্গাপুরে সেটল করব!


মাহি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে টুটুলের হাতের ওপর হাত রেখে পরম মমতায় বলল- তোর ডানা দুটো তোকে আকাশে উড়তে দেবে, আমার ডানা নেই আর পা দুটো মাটিতে শিকল দিয়ে বাঁধা। যা উড়ে, তুই জীবন আকাশে পাখনা মেলে যতদূর পারিস  উড়ে যা। মস্ত বড় দুনিয়ায় কোথাও কখনো ডানা মুড়ে বসিস যদি, আমি জানতে না পেলেও শুভ কামনা থাকবে বন্ধু। আর আমি এই খাঁচায় বাঁধা পড়ে পাখা ঝাপটাব খালি..... সাহসও নেই, শক্তিও নেই। পড়াশোনাটা যদি তোর মত মন দিয়ে করতাম.... আসলে আমার ভালই লাগত না রে। তার চাইতে গানটা নিয়ে.....

টুটুল বন্ধুর হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

-ভাঙাচোরা মনে কত হরেক তাপ্পি কেউ কি বাইরে থেকে টের পায় রে। জীবন প্রথম থেকে আমার সাথে জুয়া খেলে যাচ্ছে। গুছিয়ে গুটি চেলেও বারবার আমি অদৃশ্য কারো কাছে হেরে যাচ্ছি রে। চোখে নীচে ভাঁজ আর ডার্ক সারকেল, চুলের ফাঁকে রূপালি রেখা টুটুলের লড়াইয়ের ছবি আঁকে। ছোটবেলায় লোভীর মত মাহির বাড়িতে গিয়ে ওদের পারস্পরিক সম্পর্কের সৌরভ প্রাণভরে গ্রহণ করত ও। মনের মধ্যে ওই জীবনের যে জলছবি আঁকা হয়েছিল পরবর্তী জীবনে কোথায় আর সার্থক রূপ দিতে পারল? শুধু মই বেয়ে উঠে চলেছে, আকাশকে ছুঁতে পারছে কি?

দুই বন্ধু একে ওপরের হাত স্পর্শ করে বসে আছে। অন্তর্বাহী তরঙ্গমালায় নিজেদের না পাওয়ার যন্ত্রণাগুলো আবার ভাগ করে নিচ্ছে ছেলেবেলার মত।



Comments