প্রসঙ্গ অনলাইন পড়াশোনা
অনলাইন পড়া কখনোই অফলাইনের বিকল্প নয়। এটি একটি সাময়িক ব্যাবস্থা মাত্র। এই নিয়ে দু-চারটে কথা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আজ আমি সি বি এস ই স্কুল গুলো নিয়েই মুলত আলোচনা করছি।
প্রথমে বলি, কি ভাবে পড়াশোনাটা হচ্ছে। কিছু অ্যাপ্লিকেশন আছে। যেমন জুম মিট, গুগল মিট ইত্যাদি। এগুলোতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পড়ানো হয় । এই অ্যাপ্লিকেশন গুলোতে অনেক ছাত্র ছাত্রি -কে একসঙ্গে পড়ানো যায়। ক্লাস হয় চল্লিশ মিনিটের এবং কোনো স্কুলে চারটা কোনো স্কুলে পাঁচটা ক্লাস হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাসের মাঝে দশ মিনিটের গ্যাপ। এরপর স্কুনের নিজস্ব অ্যাপ্লিকেশনে পি ডি এফ করে বিভিন্ন নোটস, প্রশ্ন-উত্তর লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ স্কুলেই নাইন টেন ইলেভেন টুয়েলভে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে। সব স্কুলে ক্লাস হচ্ছেও না কিন্তু সে কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আবার কিছু কিছু স্কুল একদম নিচু ক্লাস থেকেই পড়াচ্ছে।
অনলাইন ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে টিচারের কথাবার্তা বা ভাব বিনিময় প্রায় হয়ই না। পড়া ধরা যায় না তেমন, ফলে স্টুডেন্টদের ভয় বা চাপ কিছুই থাকে না। এ যেন বিচ্ছিন্ন দুটি সময়খন্ড- কে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখার চেষ্টা। বিশাল একটা শূন্য কে শিক্ষক শিক্ষিকাদের আপ্রাণ পরিপূরণের চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেরাই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না তবু এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর সময় পড়াশোনা ব্যাবস্থা চালু রাখার এর চেয়ে ভালো ব্যাবস্থা আর কি বা হতে পারত! প্রথম বিশ্বেও এই ব্যাবস্থা চালু হয়েছে। সেখানে যাদের ল্যাপটপ নেই স্কুল থেকে তাদের ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে ল্যাপটপ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
আমাদের মতো দেশে এরকম কোনও ব্যাবস্থা নেওয়া যায়নি ফলে বেশিরভাগ স্টুডেন্ট পড়াশোনা করছে মোবাইলে। মোবাইলে ছোট স্ক্রিন হওয়ায় সেটা দেখার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া মোবাইলে পড়াশোনা করতে গিয়ে অন্য বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। স্টুডেন্টরা পড়াশোনার নামে অন্য সাইটে ঢুকে পড়ছে, গেম খেলছে ভিডিও দেখছে ইত্যাদি। এটা আটকানো খুব কঠিন কাজ। কারণ যেহেতু এক সঙ্গে একাধিক অ্যাপ্লিকেশন খুলে রাখা যায় তাই টিচার বা গার্জিয়ান-এর পক্ষে ধরা খুব মুস্কিল যে স্টুডেন্ট ক্লাসে জয়েন করে অন্য সাইটে ঢুকে গিয়েছে কি না! কারণ ভিডিও কনফারেন্স হলেও ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়ার জন্য সকলকে নিজেদের ভিডিও অফ করে রাখতে বলা হয় এবং শুধু টিচারের ভিডিও অন থাকে। বিশেষ কারণেই শুধু কখনও কখনও স্টুডেন্ট-দের ভিডিও অন করার কথা বলা হয়। এখানে ফাঁকিবাজি রোখার একমাত্র উপায় হচ্ছে মা-বাবাকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। সকলের ভিডিও অন রাখা বাধ্যতামূলক করা যায় কি না সেটাও দেখতে হবে। এখন প্রশ্ন অনলাইন ক্লাস না করলে কি হত। ! না করলে পড়াশোনার সাথে ছাত্র-ছাত্রীদের যোগাযোগ সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। ছাত্র-ছাত্রীরা সারাক্ষণ ভিডিও গেম খেলত। পরবর্তীতে স্কুল খুললে স্কুলে পড়া করতে গিয়ে বিশাল অসুবিধার সম্মুখীন হতে হত। তখন আগের চ্যাপ্টার গুলো পড়লে সময়ে কুলাতে পারবে না, না পড়লে পরের চ্যাপ্টার বুঝতে পারবে না। যদি ধরে নি এই বছর আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না তবে পরের ক্লাসে উঠে আগের ক্লাসের বই পড়া না থাকায় বাচ্চারা কিছুই বুঝতে পারবে না। লকডাউন বা আনলক ওয়ান টু-এ সবার মা বাবা কিন্তু বাড়িতে বসে নেই, সেটা মনে রাখতে হব। সবার মা বাবা ছেলে মেয়েকে পড়াতে পারে না, পারলেও পড়ানোর ধৈর্য, সময় থাকে না। রেগুলার স্কুলে পড়া একটা অভ্যাস। সেই অভ্যাস নষ্ট হয়ে যেত বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের। যাদের মা বাবা পড়ায় তারা অন্য স্বাভাবিক সময়ে যেমন পড়াতে পারে এই অনলাইন ক্লাসের যুগেও পড়াতে পারে। প্রশ্ন ওঠে সময় বা চাপের। সময় বা চাপ দুটোই অন্য সময়ের স্কুলের তুলনায় অনেক কম। একে তো ক্লাস হচ্ছে সাতটার পরিবর্তে চারটা বা পাঁচটা। স্কুলে যাওয়া আসার সময় বাঁচে। এনার্জি বাঁচে আবার এরমধ্যে সিলেবাসও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনলাইনে প্রি-মিডটার্ম পরীক্ষাও নেওয়া হলো। পরীক্ষাও ছিল মাত্র তিরিশ মিনিটের এবং এম সি কিউ। যেহতু খুব অল্প সময়ের তাই চিটিং করার অবকাশ খুব বেশি ছিল না। তবু আমি এই পরীক্ষাকে প্রতীকী পরীক্ষাই বলব। এর ফলে স্টুডেন্টদের মনে পড়া প্রস্তুত করার একটা চাপ তৈরি হয়েছিল না হলে হাতে গোনা কিছু ছেলেমেয়ে বাদে বেশিরভাগই ক্লাসের পর আর প্রয়োজনীয় পড়া করে না। আমরা এখনও সেই ব্যাবস্থায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি যেখানে একজন স্টুডেন্ট শেখার আনন্দে পড়বে। এই ব্যার্থতা অনলাইন অফলাইন সবসময়ের। এবং সেই আলোচনাও সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় যা এই অনলাইন পড়ার প্রাসঙ্গিকতার থেকে একদম ভিন্ন বিষয় এবং আলোচনার প্রেক্ষিতও নয় এটা। তাই "মুখস্থ" ইত্যাদি কথাগুলো আমাদের রোজনামচা থেকে বাদ দিতে পারি না।
আরেকটা প্রশ্ন আসে যে সকলের কাছে মোবাইল ফোন আছে কি না। যারা প্রাইভেট স্কুলে পড়ছে তাদের কাছে মোবাইলও থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সরকারি স্কুল নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করিনি। তবে সরকারি স্কুলে অন্য পদ্ধতিও ব্যাবহার করা হচ্ছে। সরকারি স্কুল নিয়ে অন্য লেখায় আলোচনা করব।
বাচ্চারা বাড়ি থেকে বেরোতে পারছে না, বর্তমান পারিবারিক পরিকাঠামোতে তারা সত্যিই একা হয়ে পড়েছে। এই সময় তারা আঁকড়ে ধরছে তাদের অত্যন্ত প্রিয় খেলা ভিডিও গেম যার প্রভাব মোটেও ভালো নয় সে আমরা সবাই জানি। অথচ ওদের এই পরিস্থিতিতে বাধা দিয়ে অন্যদিকে মনোনিবেশ করানও খুব কঠিন কাজ। চারিদিক থেকে চুম্বকের মতো হাতছানি দিয়ে নানাভাবে আকৃষ্ট করছে নেট দুনিয়ার নানান হাতছানি। ভিডিও গেমের ঘন ঘন বিজ্ঞাপন তো আছেই বিভিন্ন বন্ধুরা আহ্বান জানাচ্ছে খেলার। ওরা ভিডিও গেম-এর ক্ষতিকর প্রভাব বোঝে না। একটু খেলব ভেবে শুরু করে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যদি পড়াশোনার মধ্যে ওদের কিছুটা হলেও ব্যাস্ত রাখা যায় তবে মন্দ কি! তবে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অনেকটা কোনও বিপজ্জনক পাহাড়ি পথে গাড়ি চালানোর মতো। বাঁকে বাঁকে বিপদ। বিপদ কাটিয়ে সাবধানে এগোতে পারলে সামনে অপেক্ষা করছে সুন্দর এক পৃথিবী।
অনলাইন ক্লাস কিন্তু একদম নতুন কোনো কনসেপ্ট নয়। বহুদিন থেকেই মূল স্রোতের পড়াশোনার পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে নিঃশব্দে স্থান করে নিয়েছে অনলাইন স্টাডি। বহু ছাত্র-ছাত্রী স্কুল করার পাশাপাশি ঝুঁকে পড়েছে সেই সংস্থা গুলোর দিকে। কেউ উচ্চতর শিক্ষা নিচ্ছে কেউ নতুন কোনও কোর্স করে নিচ্ছে। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার চলছে বহুদিন থেকেই অনলাইনে। আনলিমিটেড ডাটার যুগে এসব এখন নতুন প্রজন্মের জলভাত। রক্ষনশীলরা যতই গেল গেল রব তুলুক ইন্টারনেটের হাত ধরে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, নতুন চিন্তা ভাবনা, নতুন মানসিকতা, নতুন সামাজিক গঠন তাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিল এই করোনা মহামারী কালীন পরিস্থিতি। ভালো মন্দ যাই হোক এই পরিবর্তনের স্রোত আটকানোর ক্ষমতা কারও নেই।
অনেকেই এখন একটা সহজ সমাধান দেখতে পান বাচ্চার মানসিক বিকাশ তথা সুস্থতার জন্য মা বাবার সঙ্গ দেওয়ার পাশাপাশি দাদু দিদার ভুমিকার কথা। সেটা সত্যিই খুব ভালো একটি উপায়। কিন্তু এখানেও কিন্তু আছে। সব দিক দিয়েই আমাদের সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। সবার অলক্ষে ঘটে যাচ্ছে জেনারেশনের পরিবর্তন। দাদু দিদাদের জেনারেশন তথা মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে, ঘটছে অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন। মা বলতে রান্না ঘর থেকে আঁচলে হলুদের হাত মুছতে মুছতে বেরোচ্ছে সেই সাবেকি চিত্রের যেমন পরবর্তন ঘটেছে তেমনই নাতি নাতনিকে কাঁথার নিচে শুয়ে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে সেই চিত্রও ঝাপসা হতে শুরু করেছে। আমার চেনা জানা অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন যারা নিজের স্বাধীনতা বা নিজের খোলামেলা বাড়ি বা নিজেদের পুরোনো শহর -গ্রাম ছেড়ে ছেলে মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে চান না। আবার এরকম দাদু - দিদা বা ঠাকুমাও আছেন যারা নাতি নাতনিদের ঝামেলা তথা দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন। অর্থাৎ বলতে চাইছি পরিবর্তন সব স্তরে হচ্ছে। বাচ্চাদের ব্যাস্ত রাখতে তথাকথিত সচেতন বাবা মায়েরা পড়ার চাপ বাড়াচ্ছে নানা কৌশলে। ফলে দারুন রেজাল্টও করছে প্রায় সবাই। সেখানে অনলাইন স্কুলকে আমি বলব নিতান্তই নিরিহ গোবেচারা একটা সিস্টেম যাকে কিছু নেটিজেন কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা করছেন। এত পক্ষে বিপক্ষে কথা বলার পর পরিশেষে যেটা বলব যে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা সত্যিই অনেক সমস্যার সম্মুখীন। সমস্যার শেকড় অনেক গভীর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। শুধু আলোচনা নয় প্রকৃত বিশেষজ্ঞ দের দ্বারা গঠিত কোনও দলের অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পর্যালোচনার মাধ্যমে দিক নির্দেশ করার সময় এসেছে।
Comments
Post a Comment