বইকথা - রঞ্জন রায়




"নীল নীল স্বপ্ন স্বপ্ন মেঘ মেঘ : স্বপ্ন উড়ানে অভিসার''

কবি: রামকান্ত রায় 
প্রকাশক: ভগীরথ দাস, চারুবাক, কোচবিহার 
প্রকাশকাল: কোচবিহার বইমেলা, ১৯৯৭
বিনিময়: ৮ টাকা।


উত্তরবঙ্গে বসে নয়ের দশকে যাঁরা কবিতা নিয়ে নিজেদের মতো চর্চা করে গেছেন, কবি রামকান্ত রায় (১৯৬৭-২০১৪) ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। কিছু কিছু প্রতিভা ক্ষণজন্মা। পূর্ণ বিকশিত ফুল হয়ে ওঠার আগেই ঝ'রে যায়। কী বিশ্ব সাহিত্যে, কী এদেশের সাহিত্যে এমন অনেক নিদর্শন রয়েছে। ক্ষণজন্মা হলেও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রামকান্ত রায় তাঁর নির্দিষ্ট আয়ুষ্কালের মধ্যেও তাঁর সৃষ্টিগুলি, বিশেষ ক'রে তিনটি কাব্য রেখে গেছেন। 'নীল নীল স্বপ্ন স্বপ্ন মেঘ মেঘ' তাঁর প্রথম কাব্য। অন্য কাব্য দুটি হলো, 'নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে আছো' ( ২০০৮) এবং 'পুড়ে যায় নিরোর বেহালা' (২০১৩)।
১৬ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যটি। লাল মলাটের এই বইটি প্রকাশের সম্পূর্ণ উদ্যোগী ছিলেন কবির বন্ধু তথা বইয়ের প্রকাশক কবি ভগীরথ দাস। সিঁড়ির ধাপের মতো করে কাব্য নামের পথ ধরে গেলে পাঠক যে উত্সর্গ পত্র পায় তাতে লেখা রয়েছে,
                  'মুখ তোল লেবুর গন্ধ 
                  চোখে তোমার সুরমা পরিয়ে দিই ....'
একেবারে বাস্তব জীবন ঘেঁষা ভাবনার উত্তাপ ছড়িয়ে রয়েছে এখানে।কবির ব্যক্তিগত অনুভব, তাঁর সম্পর্কে বাইরের মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে নিয়ত লড়াই, ভগ্ন প্রেমের দাবদাহ, বিজ্ঞান মনস্কতা ও প্রকৃতির সঙ্গে কবির আত্মিক যোগ এবং শেষপর্যন্ত 'নিজের মুদ্রাদোষে একা' হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাময় অভিব্যক্তির এক স্বতন্ত্র কোলাজ হয়ে উঠেছে কাব্যটি। কবির সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রকাশক ভগীরথ দাস তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,
          ''.... গত শতাব্দীর আটের দশক থেকে কবি জীবন পালন করলেও এই শতাব্দীর প্রথম দশকের চিহ্নিত কবি রামকান্ত রায়। প্রকৃত পাঠক, প্রকৃত আলোচক, প্রকৃত ভালোবাসার কাছে সবে পৌঁছেছিল কবি।চারপাশে ইন্টারক্লাসের কবিদের ভীড় থেকে রামকান্ত সবে আলো ফেলছেন -- অসম্ভব ভালো লিখছেন, নিজস্ব গন্ডীর বাইরে পা রাখছেন - ঠিক তখনি নিভে গেল ওঁর জীবন আলো। ওঁর প্রথম বই -এর প্রকাশক, ওঁর যন্ত্রসঙ্গীতের প্রকাশক আমার প্রকাশনা চারুবাক। আমার ঘরেই ওঁর বাদ্যযন্ত্রগুলিকে এক রাত্রির নীরবতা ভেঙে আছড়ে আছড়ে ভেঙেছিল, মনের ভেতরকার বিশাল ক্ষত দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন।''
নয়ের দশকের সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা কবির আরেক বন্ধু কবি অলক সাহার সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথনে জেনেছি। কবি তখন বেকার। টিউশনির মতো অনিশ্চিত পেশাকে সঙ্গী করে কোচবিহার শহরের ছোট্ট গলির জীর্ণ ভাড়া বাড়িতে দিন গুজরান করছিলেন। হৃদয়ের অন্তর্গত যন্ত্রণার ছাপ বাইরে প্রকাশ পেতে দেন নি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সম্পর্কে সাধারণের যে ভ্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছিল সে বিষয়টি কাব্যের প্রথম কবিতাতেই ধরা পড়েছে। এক পাশে কবি, অন্যপাশে পৃথিবী। 'সমস্ত কিছুই ন্যস্তর্থক'। কেউই কবির জন্যে পথ চেয়ে থাকে না, কিম্বা ভাত বেড়ে অপেক্ষা করে না।কবি লিখেছেন--
       'যারা জানে না, তারা বলে 
        আমি নাকি খুব সুখে আছি 
        আমি তো জানি আমি কেমন আছি--
        সমস্ত কিছুর ভেতর 
        শুধু লাল-নীল গোলাপী-কালো-সাদা 
         চ্যাপটা-সরু-গোল-চিকন-কঠিন-তরল 
      'না' শুধু  'না'......'
                                   
(আত্মকথন-২)
একক যন্ত্রণাময় জীবনে নিজের সঙ্গে শুধু প্রিয়জনের নয়, ধর্মের -বর্ণের দারিদ্র্যের-লিঙ্গের ব্যবধান' ব্যাভিচারী দেওয়াল গড়ে ওঠে প্রতিদিন'। বুকেতে তেত্রিশ কোটি প্রজন্মের করুণ প্রার্থনা 'তাঁর। এই অসহনীয় প্রেক্ষাপটে নিজেকে তাঁর মনে হয় ঈদৃশ আলির মতো বঞ্চিত-
          'অন্ধকার ঝোপের ভেতর থেকে 
           ঈদৃশ আলি শিষ্ পাঠায় এই প্রজন্মের কাছে 
          তার বহু আহ্লাদের এই প্রজন্মের কাছে 
         সে আজ গোপনচারী, অরণ্যচারী 
         ফতেমা বিবির সাথে তার 
         কোনও দিন দেখা হবে না আর--
         নিকা হয়ে গেছে -- 
         বর্গাদার পুলিন বাড়ুইয়ের মত 
         তার সমস্ত সত্তায় শুধু সামগ্রিক একটা 'না'।'
                                   
(যাবে যাও, শুধু বলে যাও....)
নীল স্বপ্ন নিয়ে ভাসমান মেঘের মতো কেটে কেটে যায় জীবনের উদারমুক্ত আসে। ক্ষণিকের জন্যে কবি চেতনায় আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে সেই মেঘ আসতে চায় কবির পরিচিত পৃথিবীতে। 'নিরক্ত সতর্কীকরণ' কবিতায় কবি সেই মেঘকে নিষেধ করে বলেন,
           'মাতাল হাট, লক্ষ্মীকান্তপুর, নরুদ্দিনের মাথার মোড়,
            গুঞ্জবাড়ী, ভোট পাট্টি, দিনহাটা, রেলগুমটি 
            সিপাইটারী, নক্সালবাড়ী, মাকড়াপাড়া 
           এইসব জায়গায় যারা গেছে -- তাদের সবাইকেই 
           তুমি চেন না।
         এখানে এসো না--
         এখানে আগুনেরা জল সাধনা করছে 
         এখানে এলে তুমিও জল হয়ে যাবে--'।
 
কবির খুব বেশী প্রত্যাশা ছিল না ভালোবাসার মানুষটির কাছে।
সেই সামান্য ইচ্ছের কথা অকপটে ব্যক্ত করে কবি 'অরণ্যচারণ এবং ...' কবিতায় বলেছেন,
          'তেমন কিছুই নয় 
           খালি একটা খিলি খাওয়াতে চেয়েছিলাম শ্যামলীকে'। কিন্তু সেই ইচ্ছে পূরণ হয় নি। বরং 'এই দোষে কাঁশফুল নীলাকাশেরা' কবিকে অভিশাপ দিয়ে 'অরণ্যচারী' করেছে। এই অরণ্যচারিতা কবিকে আমৃত্যু প্রকৃতি প্রেমিকই শুধু করে নি, করেছে বিজ্ঞানমনস্ক। এই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে কাব্যের 'শূন্যযাপন', 'আবর্তন' ইত্যাদি কবিতায়। 'শূন্যযাপন' কবিতায় কবি লিখেছেন,
            'তুমি তো জান না,
             যে আকাশ করেছি অন্ধকার নিজগুনে 
              যে বাতাস করেছি বিষাক্ত নিজগুনে 
              যে মাটি করেছি নিষ্ফলা নিজগুনে 
               আমাকে একলাটি পেলেই ওরা চেপে ধরে 
               জনে জনে জবাব চায় 
                          অবহেলার ---, অপমানের ---,।'
কিম্বা,  
       'আবর্তন' কবিতায় কবি বলেছেন,
            'এরকম যে যার মত 
             সবাই মেঘ হই, বৃষ্টি হই, নীল হই,
             চাঁদ হই, ঘাস হই, নদী হই, হই সবুজ খবর 
             তারপর -- আরও অন্যকিছু।' 
প্রকৃতির বুকে নিজেকে সঁপে দিয়ে কবি একক যাপনে অভ্যস্ত হয়ে আপন মনোভূমিকে 'গোচারণ ক্ষেত্র' করে সেখানেই ফুলের চাষ করেছেন। হাওয়ায় লেবুর গন্ধে মোহিত হয়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়েছেন। 'হাওয়ায় লেবুর গন্ধ' কবিতায় অকপটে সেকথা জানিয়েছেন কবি,
        '... তবু কেউ না কেউ আসেই 
        মালতী, সেঁজুতি, শেফালী, বকুল আরও কত কে --
        কিম্বা আরও কোনও ভারী ধরনের পদক্ষেপ .......
        সান্ত্বনা! বেঁচে থাকার স্তোকবাক্য কেবল --।'
'অভিমান কল্প' কবিতায় তিনি আর কোনোদিন প্রিয়জনের কাছে যেতে না চাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন। এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছেন,
           'ভালোই তো শিখেছ জ্বলতে ও পুড়তে 
            ভেবেছ আমিই পুড়তে জানি না --
            তবে তুমি দেখে নিও আমিও 
            বিকেল বেলার কামরাঙা ডুরে মেঘ হতে পারি কিনা।'
এই অভিমান যেমন 'আত্মদহনের মানচিত্র' আঁকতে সহায়ক হয়েছে, তেমনি 'বিমূর্ত পত্র' লেখার পটভূমি তৈরি করেছে। 'আত্মদহনের মানচিত্র' কবিতার শেষে কবি লিখেছেন,
        'কে তোমাকে মেঘের জানালা থেকে 
         ছায়াময় হতে ডাকে --
         কে তোমারে উদাসী মাতাল হাওয়ায় 
         নদীর শূন্য মাচানে বিচার চায়, ডেকে নিয়ে বলে 
         এখানে তুই কেউ নোস --
         কী যন্ত্রণা! এইসব আত্মদহনের মধ্যে ---
        দিন কেটে যায় ..... দিন কেটে যায় .....'
    কিম্বা, 'বিমূর্ত পত্র' কবিতায় কবি চিঠি লেখার আর প্রযোজনীয়তা আছে কিনা প্রশ্ন করে শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন--
         'আকাশ যে মেঘ ঘনায় 
           বাতাসে যে সুবাস ছড়ায় ফুল 
           বলো তো এগুলো কার --
           আমি জানি এবং তুমিও জানো 
           ওইগুলো খবর-তোমার আমার।'
এই অনিবার্য বিচ্ছেদের ভেতরেও চলে নিরন্তর অভিসার। অবচেতনে সম্পর্কগুলো তখনও টিকে থাকে নিপাতনে সন্ধির মতো নিয়ম বহির্ভূতভাবে। আর সংবেদনশীল কবির হৃদয় বেহালা পুড়ে যেতে থাকে। এরই কাব্যিক বহিঃপ্রকাশই তো পরবর্তীকালে প্রকাশিত কবির কাব্যদ্বয়- 'নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে আছো' এবং 'পুড়ে যায় নিরোর বেহালা'।
আসলে ক্ষণপ্রভা প্রতিভারা বোধহয় জীবনের সেই স্বল্প পরিসরেই দীর্ঘ জীবনপথ অতিক্রম করে ফেলেন।এবং সেই পরিভ্রমণ কথা লিপিবদ্ধ করে যান তাঁদের সৃষ্টি ক্ষেত্রে।রামকান্ত রায়ের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতয় হয় নি। এবং তিনি তাঁর প্রথম কাব্যেই জীবনের স্বপ্নময় অভিসারটুকু সেরে ফেলেছিলেন।



Comments