গদ্য - মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য




ছাদ



'আকাশ আমার ঘরের ছাউনি' কথাটা বলতেই গায়ের রোম কেমন দাঁড়িয়ে যায়, তাই না? যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর বেদের মত ঘর ভেঙে আকাশের বিপুল বিস্তারে শরীর ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করে রোমান্টিক উৎসাহে। ভাবতে ইচ্ছে করে, আহা সত্যিই যদি এমন হত! খড় নয়, গোলপাতা নয়, টিন নয়, টালি নয়, কাঠ নয়, পিচ নয়, পাথর নয়, ইট-প্লাস্টার-সিমেন্ট নয়, ইস্পাত-কাচ-ফাইবার গ্লাস নয়, লোহা বা অন্য কোনও ধাতু নয়, এমনকি আইসল্যান্ডের এস্কিমোদের (তারা অবশ্য আজকাল নিজেদের ইনুইট বলে) মতো বরফও নয়, শুধু আকাশের নিচে যদি মানুষ বসবাস করতে পারত, তবে কেমন হতো!


করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন চলছে দেশজুড়ে। ছেলের সঙ্গে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর অ্যানিম্যাল  প্ল্যানেট চ্যানেল দেখে সময় কাটাচ্ছি আজকাল। টিভির পর্দায় দেখছি আফ্রিকার সুবিশাল চারণভূমিতে কিভাবে খোসমেজাজে চরে বেড়াচ্ছে  জেব্রা আর জিরাফের পাল, নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করছে দলবদ্ধ হরিণেরা। তাদের নিস্পৃহ ভঙ্গি দেখে মনে হয় আকাশ-ছাউনি নিয়ে বেশ সুখেই আছে তারা।  মাঝেমধ্যে যে বাঘসিংহের পেটে তাদের ঠাঁই হচ্ছে না তা অবশ্য নয়, তবুও তারা নির্বিকার। মানুষ যদি এমন করে খোলা আকাশের নিচে এভাবে চরে বেড়াত তাহলে তারা কার খাদ্য হত? না কি খাদ্য হতে চায়নি বলেই ঘর বানিয়েছে মানুষ?


আসলে মানুষ যখন বনে বাস করত তখনও সে পাহাড়ের গুহা খুঁজে নিত। মানুষের আগে পিঁপড়েরা তাদের ঢিপি তৈরি করেছে বা গাছের পাতা জুড়ে বাসা বেঁধেছে। পাখিরা খুঁজে নিয়েছে গাছের কোটর, না হয় বাসা বেঁধেছে গাছের ডালে। শেয়াল শজারু খরগোশ মাটিতে গর্ত করে সুরঙ্গ বানিয়েছে। বনের কীটপতঙ্গ কতভাবে যে আশ্রয় তৈরি করেছে তার হিসেব নেই। তাদের এই তৎপরতা যতটা না নিজের জন্য তার চাইতেও বেশি তার সুরক্ষাহীন সন্তানের জন্য। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ের নিষ্ঠুর আক্রমণ থেকে যাতে তাকে নিরাপদে রাখা যায়।


গুহা থেকে গৃহতে পৌঁছতে মানুষের বহু হাজার বছর লেগে গেছে। মানুষ পাকাপাকি ছাদের কথা ভাবে নি প্রথমে। খ্রিস্টজন্মের বারো তেরো হাজার বছর আগে অবধি সে ঘুরে বেরিয়েছে। তখন তার মাথার ওপর ছাদ কেউ দেয়নি। পারস্যের বখতিয়ারিরা নাকি এখনও ঘুরে বেড়ায়। পুরনো বাইবেলের গল্পে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইজরায়েল বা ইয়াকব নামে এক গোষ্ঠীপতির সন্তানদের এই মহাদেশ পরিক্রমার কথা, যাদের আমরা ইহুদি বলে জানি। সভ্যতার ইতিহাস খুঁজলে দেখি, তারাও বারবার তাড়া খেয়েছে, শিকারিরা যেমন কুকুরের পাল নিয়ে বনের পশুদের তাড়া করে।


মানুষ থিতু হল এই সেদিন। যখন সে দেখল, একধরনের গাছের বীজ মাটিতে পুঁতলে আবার গাছ গজায়। সেই আবিষ্কারকে সে কাজে লাগিয়ে কৃষির উদ্ভাবন করে, গমের খেত বানিয়ে। তার প্রাচীন নিদর্শন আছে প্যালেস্টাইনের জেরিকো নামে একটা জায়গায়। চাষবাস এইভাবে মানুষকে বেঁধে ফেলল, মাথার ওপর ছাদ তৈরি করে এগিয়ে দিল গ্রাম আর নগরসভ্যতার দিকে। চারটে নড়বড়ে খুঁটির ওপর একটা তেরপল বা প্লাস্টিকের ছাউনি হলেও কাজ চলে যাবে, কিন্তু ছাদ চাইই চাই মাথার ওপর। তথাকথিত ফুটপাতের বাসিন্দা যারা, তারাও রাত্তিরে গাড়িবারান্দার ছাউনি খুঁজে নেয় আশ্রয়ের জন্য।


ছাদ নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গল্প শোনাই। তাঁর একবার শখ হয়েছিল সক্কাল সক্কাল উঠে একটু ধ্যান করার। তাই ভোরবেলায় ছাদে গিয়ে পূব দিকে মুখ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকছিলেন। একদিন তাঁর মনে হল, কেউ যেন তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলছে, ওরে বোকা, চোখ খোল, তোর সাধনা চোখ বুঝে নয়। তিনি চোখ খুললেন। দেখলেন, লালচে সোনালি আগুন জ্বালিয়ে পূবের আকাশে সূর্য উঠছে। অবনীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন তাঁর সাধনা ছাদে একাকী দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে নয়, বরং চোখ খুলে, রং আর আলোর পৃথিবীতে।


ছাদের তুমি ছাদের আমি ছাদ দিয়ে যায় চেনা। ছাদই ঠিক করে দেয় স্টেটাস সিম্বল। জাপানে বাড়ির ছাদগুলো নিচু নিচু হয়। যত গরিব ঘর, তত নিচু ছাদ। আসলে বাসগৃহের ছাদ একরকম হয় না কখনও। চিন-জাপান-কোরিয়ার মতো দূরপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ছাদ মূলত রঙিন টালির তৈরি। ফলে ছাদে ওঠা সম্ভব নয়। আজকের ছিমছাম ছোট ফ্ল্যাটবাড়িতে সে-ছাদ মসৃণ, নিখুঁত-নিভাঁজ। ভ্যাটিক্যান সিটির সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের সিলিঙে অমোঘ সব শিল্পকীর্তি রেখে গিয়েছেন মিকেলেঞ্জেলো। আবার আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির ঝুপড়িতে কালো প্লাস্টিকে ঢাকা ছাদ, কারও বর্ষায় ফুটো হয়ে জল পড়া খড়ের চালা, কারও মাটিতে শেকড় গেড়ে বসা বাড়ির ছাদে কড়িবরগার জ্যামিতি, কারও আবার ঝাড়লন্ঠন দোলানো ছাদ, কোথাও আবার দেবতার আসনের সোনা-রুপোর ছাদ, ওদিকে বহুতল বাড়ির মাথার ওপর সুইমিং পুল, তার ওপর ছাদ এমনও কম নেই এই ধরাতে।


আমরা এখন থাকি কংক্রিটের জঙ্গলে। আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্যাপার। চল্লিশ তলার ওপর স্কাইওয়াক। কিন্তু সেই স্কাইওয়াকে দৌড়ে দৌড়ে কে আর ঘুড়ি ওড়াবে? ছাদে গিয়ে কে শুকোতে দেবে বড়ি কিংবা কুলের আচার? ছোটবেলায় আমাদের মফসসল শহরে দেখতাম বিকেলে গা ধুয়ে চুল আঁচড়ে ছাদের আলসেতে দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির গিন্নিরা, অফিস-ফেরত কর্তার অপেক্ষায়। তাঁরা সব হারিয়ে গেছেন সময়ের ঘূর্ণিতে পড়ে। তাছাড়া পাঁচতলার কোন বৃদ্ধ ভোরবেলা উঠে চল্লিশতলার ছাদে যাবেন পায়চারি করতে? গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় কে আর ছাদে উঠে শীতলপাটি আর বালিশ নিয়ে গড়াতে যাবে দু'দন্ড? শীতের পেলব দুপুরে ছাদে আয়েশ করে বসে লুডো খেলতে খেলতে কে আর খোসা ছাড়াবে কমলালেবুর?


এর থেকে কিঞ্চিৎ বড় প্রশ্নটায় আসি এবার। আমাদের মাথার ওপরকার ছাদটাই যদি কেউ কখনও ছিনিয়ে নেয়? আমাদের ঘরগেরস্থালি, খাটবিছানা, রান্নাঘর, বৈঠকখানাতে যদি আকাশ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সমস্ত নিষ্ঠুরতা নিয়ে? যদি শেকড়সুদ্ধু আমাদের উপড়ে ফেলে কেউ? মানুষের ইতিহাসে তো এই জিনিস হয়েছে বারবার। আসলে যুদ্ধ আমাদের থিতু হতে দেয় না কখনও। ধর্মীয় হিংসা আমাদের যুগ যুগ ধরে উৎখাত করেছে সুখী গৃহকোণ থেকে। আমাদের দেওয়াল গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এনে দিয়েছে মাটির সমতলে। ঘর আর বাহির এক হয়ে গেছে। দেশে দেশে তৈরি হয়েছে উদ্বাস্তু বাহিনী। এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে ওল্ড টেস্টামেন্টের সময় থেকে।


আমরা বইতে পড়েছি, কীভাবে হাজার বছর ধরে ভেতরে-বাইরে রক্তাক্ত মানুষ বারবার উৎখাত হয়েছে, ছাদহীন হয়েছে নতুন করে। আমরা কি নিশ্চিত যে, আমাদের ভিটেছাড়া হতে হবে না কখনো? আমাদের চিহ্নিত করা হবে না উদ্বাস্তু বলে? ধূর্ত হাসি হেসে কেউ আমাদের বলবে না, 'এই লিখে দিনু বিশ্বনিখিল দু'-বিঘার পরিবর্তে'? তা-ই  যদি হয় কখনও তখন  কী  করব দীর্ঘদিন ধরে জমিতে-ঘরে শেকড় গজানো আমরা? রাস্তায় যখন আত্মজনেরা, আচমকা এতটা আকাশ আক্রমণ করেছে বলে যখন নিজের পরিবারের শিশু ভয়ে  কাঁদছে, এমন দশায় কী করবে মানুষ? তখন, হ্যাঁ ঠিক তখন, আমরা প্রকৃতপ্রস্তাবে বুঝতে পারব ছাদের মর্ম ঠিক কী!



Comments