প্রবন্ধ - নীহারুল ইসলাম



অমিয়ভূষণ মজুমদার ও তাঁর চারটি চিঠি



১৯৯৫-এ আমি প্রথম অমিয়ভূষণকে পড়ি। নাকি তারও আগে! ‘রাজনগর’ যখন বঙ্কিম, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পায়? সত্যিকথা বলতে ‘রাজনগর’ তখন আমার ভাল লাগেনি। বয়স কম ছিল বলেই হয়ত বা! 


তারপর ১৯৯৫। কলকাতা বইমেলায় ‘রক্তকরবী’র স্টলে অমিয়বাবুর ‘মহিষকুড়ার উপকথা’ উপন্যাসটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়। খুব সাধারণ ছাপা, বাঁধাই। তবু কী জানি কেন- আমি সেটি ক্রয় করি। কম দাম আর আয়তনে ছোট বলেই কি?
জানি না। অথচ উপন্যাসটি পড়ার পর অমিয়ভূষণে আমার যেন নেশা ধরে যায়। তাঁর ‘রাজনগর’ (আবার), ‘চাঁদবেনে’, ‘গড়শ্রীখন্ড’, বেশকিছু ছোটগল্প এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করি অল্প কিছুদিনের ভেতর। কী দারুণ কাহিনী সব! কী আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ! লেখন! সেই থেকে অমিয়ভূষণ মজুমদার আমার অন্যতম প্রিয় লেখক।


১৯৯৬-এ কলকাতা বইমেলায় আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব’ প্রকাশিত হয়। বইটি আমার অন্যতম প্রিয় লেখকের হাতে তুলে দেবার বাসনা জাগে। লোভ হয় আমার গল্প সম্পর্কে তাঁর মতামত জানবার। কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন? কী করেন? আমি কিছুই জানি না। তাই শুরু হয় তাঁর খোঁজ। এবং শেষপর্যন্ত জানতে পারি, তিনি থাকেন সুদূর কুচবিহারে। অতদূর আমি যেতেই পারি। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে আগে তাঁকে চিঠি লিখে জানানো দরকার। সেইমতো দুরুদুরু বুকে চিঠি লিখি। 


আমি তাঁকে চিঠি লিখি ১৯৯৬-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি। এই ভেবে যে, হয়ত তাঁর জবাব পাব না! তাছাড়া অতবড় লেখকের কাছে আমার মতো নগণ্যের চিঠির কী মূল্য থাকতে পারে? কিন্তু না, তিনি আমাকে অবাক করে দেন আমার সেই চিঠির জবাবী পাঠিয়েঃ
                  

৯. ৩. ৯৬
কুচবিহার-৭৩৬১০১

স্নেহাস্পদেষু,
আপনার ২৬/২ তারিখের কার্ড পেয়েছি। আমার লেখা আপনি আগ্রহ করে পড়েছেন, এতে আমি কৃতার্থ।
আমার কাছে আসার কি ব্যবস্থা করা যায়, তা আপনাকেই ভাবতে হবে। আমার বাড়িতে এখন সংস্কারের কাজ চলছে। ছ’মাস সময় লেগে যাবে। পুজোর সময় হয়ত প্রস্তুত হবে, আমিও প্রস্তুত হব অতিথি সম্বর্ধনায়। তার আগে আসতে হলে এখানকার হোটেলে উঠতে হয়।
আমার প্রীতি ও শুভকামনা জানবেন।
                                           অমিয়ভূষণ মজুমদার


শেষপর্যন্ত আমার কুচবিহার যাওয়া হয় না। অগত্যা আমার গল্পগ্রন্থটি তাঁকে ডাক মারফৎ পাঠাই। সেটা পেয়ে তিনি আবার আমায় লিখলেনঃ
                                                                            

কুচবিহার-৭৩৬১০১
২০. ৪. ৯৬
স্নেহাস্পদেষু,
তোমার গল্পগ্রন্থ পেয়েছি, পড়লামও। ভাষা ও গল্প সমন্ধে পরে জানাব। তুমি কলকাত্তাই সাহিত্যের পুচ্ছ গ্রহণ করনি, এটা ভাল লাগছে। গল্পগুলোতে প্রায় সকলেই কালো মানুষ- এটাও ভালো। তুমি কি মহাভারত পড়েছ? বাংলায় লিখতে ওটা পড়তে হবে। বেদব্যাস, অর্জুন, তুমি, আমি সকলেই আসলে নদীর মাটির তৈরী কালো মানুষ। আর্য নই, নর্ডিক নই, চীনা নই, মুঘল নই। কলকাতা বাংলার একটা ক্ষুদ্র অংশ, যেখানে খয়েরি অ্যাংলোরাই বেশী, তাদের রমরমা। যাক সেই ধাঁ ধাঁ। ভাষা আর একটু সতর্ক হওয়া চাই। মনে কর গগনের গল্প। ২য় বাক্যে ঠান্ডা না হয়ে ‘জাড়’ ভাল হয়। ৩য় বাক্যে মুহূর্ত শব্দটি ভারি, ওর বদলে কমায় কাজ সার। ৪য় বাক্যে, চিরাগের কি রোশনাই হয়? হলে গগনের হতাশ আধঅন্ধকার স্তরের ভাবটায় চলে যায়। ৫ বাক্যে তারপর ...না ফুটতে’র বদলে ‘বিহান হতেই’ বললে কেমন হয়? 
নিশ্চয় তোমার মতো লেখার অধিকার তোমার। প্রত্যেকটি শব্দ যেন অনুভূতির তৈরি হয়। পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের কোনটা না কোনটার অনুভূতি।
আশীর্বাদ জানাচ্ছি।
                             অমিয়ভূষণ মজুমদার






এর মধ্যে আমার পড়া হয়ে গেছে তাঁর ‘মধুসাধুখাঁ’, আরও কিছু ছোটগল্প। আমি তাঁকে যত পড়ছি, আশ্চর্য হচ্ছি ততই। যেন শেকড় সুদ্দ একটা বটগাছ আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। 


কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি অমিয়ভূষণ বড় বেশী ইতিহাস কপচান। হ্যাঁ, তিনি ইতিহাস কপচান। তবে অপ্রয়োজনে নয়, প্রয়োজনেই। তাই তাঁর লেখা অত গভীর। অনেক লেখা প্রথম পাঠে ঠিকঠিক ঠাওর হয় না। কিন্তু দ্বিতীয় কি তৃতীয় পাঠে, যখন একটু একটু করে বোধগম্য হতে শুরু করে, তখন অমিয়ভূষণ ছাড়া আর কাউকে ভাবা যায় না। যেমন তাঁর ছোট উপন্যাস ‘মধুসাধুখাঁ’, ছোটগল্প ‘সাইমিয়াক্যাসিয়া’। আবার কত সহজ-কত হৃদয়গ্রাহী লেখা উপন্যাস ‘গড় শ্রীখন্ড’, ছোটগল্প ‘তাঁতীবউ’। তাঁর এই ‘তাঁতীবউ’ গল্পটি পড়ে আমি যখন অব্যক্ত পাঠ প্রতিক্রিয়ার ঘোরে আবিষ্ট, তখনই তাঁর একখানা চিঠি এল আচমকাঃ


প্রীতিভাজনেষু,
আমি দীর্ঘদিন কুচবিহারে ছিলাম না, সপরিবারে চাঁদবেনের দেশে কন্যাকুমারী পর্যন্ত গিয়েছিলাম। আশা করি ভাল আছ এবং লিখছ।
                art is long
                আমার কল্যাণ কামনা জেনো। 
                                               ইতি-
                                                   অমিয়ভূষণ মজুমদার


অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘মহিষকুড়ার উপকথা’ আমার সব থেকে বেশীবার পড়া গ্রন্থ। গ্রন্থটি আমি অনেককেই পড়িয়েছি। আজও পড়তে উদবুদ্ধ করি। কেন? সেকথা আলোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমার সেই অব্যক্ত পাঠ প্রতিক্রিয়া আমাকে এমন এক স্তরে নিয়ে যায়, যেখানে মানবজীবনের চরমতম উপলব্ধি বলে কিছু থাকলে সেটাই পাই আমি। 


অমিয়বাবুর আমাকে লেখা শেষ চিঠিটি এরকমঃ
                                                                            
কুচবিহার-৭৩৬১০১
৪. ৫. ৯৭

স্নেহাস্পদেষু,
তোমার নববর্ষের অভিনন্দনবহ কার্ড পেয়েছি। ধন্যবাদ। একটা বড় গল্পকে কায়দা করতে এ কয়েকদিন চিঠিপত্রের দিকে মন দিতে পারিনি। উত্তর দিতে বিলম্ব হয়েছে। কিছু মনে করোনা। তোমার গল্প বা কবিতা এখন পর্যন্ত পড়তে পাই নি। আশা করি এই বৎসরে সে সুযোগ হবে। লুমপেন প্রলেটারিয়াট আর নোমেন ক্লাটুরা বোধহয় জান। এই দুয়ের সংযোগে যে যা হয় তা কি অনুভব করছ? তা কি তত গভীর যা গল্প হয়ে উঠতে চায়?
প্রীতি ও শুভকামনা জেনো। 
                                                ইতি-
                                                     অমিয়ভূষণ মজুমদার


অমিয়বাবুর এই শেষ চিঠির কী উত্তর দিয়েছিলাম, মনে নেই। তবে তাঁর শেষ প্রশ্নটি আমার অন্তরে আজও গেঁথে আছে। প্রতিনিয়ত সেই প্রশ্ন নিজেকে করে চলেছি, আমিও কি তেমনভাবে তাঁর মতো অনুভব করছি? লিখছি? যা গল্প হয়ে উঠতে চাইছে?



Comments