গল্প - হিমাশিস ভট্টাচার্য





পাগল

 

রোগীর  ঘরে এত লোক দেখে রীতিমত চেঁচিয়ে ওঠেছিল কাজলদা – আপনারা ভেবেছেন কি রোগী ভালো হয়ে যাবে? এক্ষুনি সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। প্রায় ঠেলেঠুলে সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল কাজলদা। তারপর রোগীর বাবাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেছিল – ঐ টুকুন তো ছেলে। আপনারা সবসময় যদি ওকে ঘিরে বসে থাকেন তাহলে ওর মনের অবস্থাটা কি হতে পারে একবার ভেবে দেখুন। ওষুধ নয় রোগীকে সবচেয়ে আগে মানসিক দাওয়াই দিতে হয়। ওকে বোঝাতে হবে ওর কিছু হয়নি।


অনেকদিন আগের কথা। কাজলদা সে যাত্রায় অসাধ্যসাধন করেছিল। শহরের তাবড় তাবড় ডাক্তাররা যা পারেননি, কাজলদা তাই করেছিল।  কয়েকদিনের মধ্যই ছেলেটি হেঁটে স্কুলে যেতে শুরু করেছিল। ছেলের বাবা একদিন কাজলদার চেম্বার এ এসেছিলেন। আমিও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলাম।কাজলদা তাঁকে বলেছিল – আমি বোধহয় সেদিন আপনার বাড়িতে অভদ্রতা করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কি করব বলুন। আমি যে ওসব একদম সহ্য করতে পারিনা। 

  
কাজলদা আমার চেয়ে বেশ বড়। আমার মেজদার ক্লাস মেট।  কিন্তু কি করে জানি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। শিলচর মেডিকেল কলেজ থেকে এম ডি করেছিল। পাশ করেও কোন চাকুরীতে যেতে চায়নি।  কিন্তু বাড়ির চাপে পরে যেতে হয়েছিল। একজন এম ডি পাশ করা ডাক্তার এদিক ওদিক বিনামুল্যে চিকিৎসা করে বেড়াবে, ওর পরিবার এবং আমাদের এই সমাজ সেটা মানবে কেন? দু দুটো সরকারি বিভাগে চাকরি করেছিল কাজলদা। তারপর আবার ছেড়েও দিয়েছিল। ওর পোষায়নি। কাজলদা বলেছিল – সরকারি লাল ফিতে এমন তুমি আসলে কি করতে এসেছ সেটা ভুলে যাবে। আমি  বুঝতাম। আসলে কাজলদা ছিল মনেপ্রানে ডাক্তার। যে শপথ বাক্য পাঠ করে ওরা ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিল, কাজলদার ক্ষেত্রে ওটা ছিল জন্মগত। ডাক্তার হয়ে আকছার অন্যরা যা ভুলে যেত, কাজলদা এটাকে তার রোগী সেবার সুযোগ মনে করত। কাজের ক্ষেত্রে অত নিয়ম কানুনের ধার ধারত না। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন অসুস্থ মানুষকে মানবিক ভালবেসে মনেপ্রানে কাজে লেগে যেত। কিন্তু সমাজ সংসারের প্রচলিত নিয়ম সেটা বরদাস্ত করবে কেন? কাজলদার মন ছিল ভীষণ নরম। ও যখন তখন, যেখানে সেখানে বিনে পয়সায় রোগী দেখতে চলে যেত। এতে, ও যে হাসপাতালে কাজ করত সেখানকার অন্য ডাক্তাররা তার উপর চটে গেল। ওরা বলত এটা কাজলদার নাটক । সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার নাটক। কাজলদা সব শুনত, কিন্তু পাত্তা দিত না। একমনে নিজের কাজ করে যেত। একসময় সবাই মিলে পরিস্তিতি এমন জটিল করে তুলল, কাজলদা আর পারল না। একদিন চাকরিটা ছেড়েই দিল। কিছুদিন পর  গেল অন্য আরেকটা চাকরিতে এবং কয়েক মাস পরে যথারীতি ওটাও ছাড়ল।


ডাক্তার কোনদিন বেকার হয়না। কাজলদা ঘোরাঘুরি করে মানুষের সেবা করতে লাগল। বাড়ি থেকে চাপ সৃষ্টি করা হল তার উপর একটা চাকরিতে যোগদানের জন্যে। বাড়ির সবাই ভেবেছিলেন একটা চাকরি না থাকলে কাজলদাকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না বাড়ির লোক এদিক ওদিক পাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন। আমরা যারা কাজলদার খুব কাছের লোক ছিলাম, জানতাম কাজলদা কোনদিন বিয়েই করবে না। ভগবান তাকে অই ধাতু দিয়ে গড়েননি । ওর যে বোহেমিয়ান চরিত্র এতে কোন মেয়ে বেশিদিন অ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। সংসারে থাকলে কিছু নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকতে হয়। কাজলদা এসব বুঝত বলেই মনে হত না। এ নিয়ে কথা বললে শুধু হাসত । ভগবান বোধহয় সবাইকে সবকিছু দিয়ে পাঠান না। এমন কাজপাগল লোক খুব কমই দেখা যায় বাড়ির চাপেই কাজলদা একদিন হুট করে আরেকটা  চাকরিতে ঢুকে গেল। আমরা খুব খুশি। একটা চাবাগানের ডাক্তারবাবু হয়ে গেল কাজলদা। কেন জানি মেজদা এতে খুব খুশি হল না। কাজলদাকে বলল – এটা তো তোর সরকারি চাকরি থেকেও  খারাপ। এখানে বাগানের  পরিচালকদের সঙ্গে তোর প্রভু ভৃত্য সম্পর্ক। কাজলদা হেসে উত্তর দিয়েছিল – প্রভুদের চিকিৎসার জন্যে তো আর আমাকে চাকরি দেওয়া হয়নি। প্রভুদের সর্দি কাশি হলে হিল্লি দিল্লির বড় বড় ডাক্তাররা রয়েছেন। আমি দেখব তাদের যাদের আর কেউ দেখার নেই। মেজদার কথাটা কত সত্যি আমি জানতাম। আবার   কাজলদা এই সামান্য সত্যটা জানে না আমি বিশ্বাস করি না। আসলে যে কোন সমস্যার শেষ সমাধান যার জানা সে আর নতুন করে ভাববে কেন। আমি জানতাম কাজলদা কোন চাকরি বেশিদিন করবে না। কেন ওরকম ভাবতাম, আমি নিজেই জানি না। আমার মনে হয়েছিল শুধুমাত্র শ্রমিকদের কথা ভেবেই কাজলদা বাগানের ডাক্তারবাবু বনে গিয়েছিল।
  

চাকরির সুখ কাজলদার এবারও রইল  না। বাগানের শ্রমিক সমাজে কাজলদা কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই খুব পপুলার হয়ে গেল। যখন তখন তাদের ডাকে লেবার লাইন এ চলে যেত। পরিচালকরা কিন্তু এটা মেনে নিতে পারলেন না। ওরা কাজলদাকে বোঝালেন – এসবের একটা সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হবে। আখেরে এতে ক্ষতি হবে পরিচালকদের। আসলে ওরা কাজলদার উপর চটেছিলেন অন্য কারনে। বাগানের শ্রমিক সংখ্যা অনেক হলেও তুলনায় হাসপাতাল ছিল খুব ছোট। যন্ত্রপাতির বালাই ছিল না। ওষুধ পত্র দেওয়া হত একেবারে সাধারণ মানের। নতুন ডাক্তার চাকুরীতে জয়েন করামাত্র তাদের উপর একটা অলিখিত নির্দেশ জারী হয়ে যেত। যা করার এ দিয়েই করতে হবে। বাগানের  এক বড় অংশের শ্রমিক অনেকদিন থেকে টিবি রোগে ভুগছিল। আগের ডাক্তাররা এই রোগের কথা উহ্য রেখে তাদের সাধারণ ওষুধ গেলাতেন। কাজলদা তাদের সবাইকে শহরে মেডিকেল কলেজ এ রেফার করে দিল। মালিক পক্ষের কাছে এটি  একটি বড় আঘাত। কারণ তাহলে সব খরচ বহন করতে হবে মালিককে। তারা বাধা দিলেন। কাজলদা শুনল না। সৃষ্টি হল নতুন সঙ্কট। ফলে কাজলদা আবার চাকরিহীন হয়ে গেল।
  

কেন জানিনা ছোটবেলা থেকেই কাজলদাকে আমার খুব ভাল লাগত। কারণটাও ছিল অন্যরকম। সংসারে এই ধরণের লোকও  আছে কাজলদাকে না দেখলে আমি জানতে পারতাম না। সংসারে থেকেও তারা প্রচলিত কোন নিয়ম কানুনের ধার ধারে না। অথচ মনে হয় তারাই সঠিক। আসলে জীবন সম্পর্কে একটা অন্য রকমের বোধ আমি কাজলদা ছাড়া অন্য কারও মধ্যে দেখিনি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হত কাজলদা বোধহয় জীবনটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দায় দায়িত্বহীন ভাবে কাটিয়ে দিতে চায়। খুব হাল্কাভাবে দেখে। কিন্তু পরে বুঝেছি জীবন সম্পর্কে তার বোধ  ছিল অনেক গভীরে। আমাদের মত সাধারণ মানুষের এত দূর যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। আমি কাজলদাকে ছুঁতে চাইতাম। পারতাম না। কিন্তু একটা অমোঘ শক্তি, একধরণের ভাবালুতা, আমাকে বারবার কাজলদার কাছে টেনে নিয়ে যেত।


সর্ব শক্তি দিয়ে কাজলদাকে ছুঁতে পারতাম না, আবার সরেও আসতে পারতাম না। কিন্তু এভাবে চলে না এটা বেশ বুঝতাম। একটা অজানা আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে থাকতাম। বাগানের চাকরিটা চলে যাবার  পর মনটা আরেক প্রস্ত খারাপ হয়ে গেল। কাজলদার বাড়ির লোক তাকে খুব গালাগালি করছে বলে খবর পেলাম। বেদনা আরও বেড়ে গেল। একটা লোককে তার বাড়ির মানুষও বুঝতে এত ভুল করে? বাইরে থেকে কাজলদাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। তার মধ্যে কোন বিকার বা হতাশা কোনটাই নেই। আমার মনের আশঙ্কাটা তর তর করে আরও বেড়ে গেল। মনের কু ডাক যেন স্পষ্ট কানের মধ্যে শুনতে পেলাম। 
  

মাঝে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ হীন হয়ে গেলাম। মাস্টার্স পড়তে আমি কলকাতা চলে গেলাম। প্রায় দুবছর পর শিলচর ফিরে সবচেয়ে খারাপ খবরটি পেলাম মেজদার কাছে। কাজল ড্রাগ অ্যাডিক্ট হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি কাজলদার ঘরে গেলাম। দু বছরের ব্যবধানে কাজলদাকে দেখে আমার বুক ফেটে কান্না এল। কি চেহারা হয়েছে কাজলদার? হাঁটতে পারছে না। ড্রাগস ইঞ্জেকশন নিতে নিতে কোমরের একটা দিক অসাড় হয়ে গেছে। আমাকে দেখে কাজলদার মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।কাজলদার দিকে তাকিয়ে অভিসম্পাত করতে লাগলেন। বুঝলাম, বাড়িতে কেউ আর কাজলদাকে সহ্য করতে পারছেন না। ওর বোন তো কাজলদার মৃত্যু কামনা করল। বোনের কথায় এক নতুন তথ্য পেলাম। কলেজে কাজলদা নাকি কোন  মেয়েকে ভালোবাসতো। মেয়েটি নাকি পরে সরে যায়। এর ফলেই নাকি কাজলদার এখন এই অবস্থা। আমি এসব কস্মিন কালেও শুনিনি। এখন শুনেও বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলাম না। এমন বাস্তবমুখী জীবন দর্শন যার, তার এমন হতেই পারে না । কাজলদা সত্যি কাউকে ভালবাসলে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তাকে কেউ ছেড়ে যেতে পারবে না । প্রেম ভালবাসার কথা বললে কাজলদা মিটিমিটি হাসত। বলত– একটা সময়ে আমরা সবাই কিন্তু একা। বন্ধুরা কেউ কেউ কাজলদাকে বলত– পেসিমিষ্ট।  আমি সায় দিতে পারতাম না। আমি জানতাম, ওদের থেকে কাজলদার মনের জোর কয়েক লক্ষ গুন বেশি। ওরা কথা বলে বইয়ের ভাষায় । কাজলদা বলে জীবন সম্পর্কে এক গভীর বোধ থেকে। কাজলদার প্রেম ছড়িয়ে রয়ে গিয়েছিল তার অসংখ্য রোগীর মধ্যে।

কাজলদা আমার জীবনে এক ব্যতিক্রম। আমি কাজলদাকে কখনও ব্যাখ্যা করতে পারতাম না। আমাদের মত সাধারণ মানুষ হলেও কাজলদা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, এক আগাপাশতলা অসাধারণ চরিত্র। মনে হত আসলে মানুষ যেরকম আছে সেরকম নয়, বরং সে ছিল একজন আদর্শ মানুষের প্রতিমূর্তি।আমাদের প্রত্যেকের যেরকম হওয়া উচিত, সে ছিল তাই। সমাজ সংসার কখনও এত বড় ব্যতিক্রম মেনে নেয় না। কাজলদাকেও নেবে না– এই আশংকা আমাকে মানসিক ভাবে কুড়ে কুড়ে ব্যথায় নীল করে দিত। জানতাম, তারা পথ হারিয়ে আচমকা চলে আসা কোন অস্তিত্ব। কোন অবয়ব তাদের সঠিক ভাবে ধারণ করতে পারে না। তারা নিজেরাই তাদের স্থিতি তৈরি করে নেয়। আবার যখন তখন গুটিয়েও নিতে পারে।  এ যেন এক আলাদা পৃথিবী। আমি কাজলদার পৃথিবীতে অনুপ্রবেশের আপ্রান চেষ্টা করতাম। পারতাম না। মনে হত এই সংসারের কেউ, তার পরিবারের মানুষেরা পর্যন্ত  কাজলদাকে বুঝতে পারছে না। কিন্তু এ নিয়েও তার মধ্যে কোন অভিযোগ নেই।

কাজলদা আমাকে দেখল । কিন্তু আগের মত তার চোখে কোন উছ্বাস দেখলাম  না। তবে কি বাড়ির প্রত্যেকের অভিশাপ বয়ে বয়ে কাজলদা নিজেও তার মৃত্যু কামনা করছে? 


বেশ কিছুদিন পর আবার কাজলদাকে দেখতে গেলাম। কাজলদা এখন পুরোপুরি রোগী। ওর বোন ঠায় বসে রইল। আমি একটা সিগারেট দিয়েছিলাম। বোন সেটা ছিনিয়ে নিল। বলল-  গুরুদেবের বারণ। শুনলাম কাজলদার এখন চিকিৎসা করছেন গুরুদেব। তন্ত্র মন্ত্র পদ্ধতিতে। গুরুদেব বলেছেন মেয়েটি নাকি কাজলদার খুব ক্ষতি করে গেছে। প্রতিরোধ করতে  হাতে, গলায়, কোমরে মাদুলি বোঝাই। কাজলদাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেমন আছো? শুকনো ঠোঁটের কোণে একটু হাসির আভাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল  কাজলদা। বিড়বিড় করে বলল– খুব ভাল। বলে বিছানার পাশের জানালাটি হুট করে খুলে দিল। বোন ছুটে গিয়ে জানালাটি বন্ধ করতে করতে শাসাল – দাদা ভাল হবে না বলছি। গুরুদেব বলেছেন দরজা জানালা সবসময় বন্ধ রাখতে হবে। মনে পড়ে গেল এই কাজলদাই একদিন দরজা জানালা বন্ধ রাখার জন্যে রোগী বাড়িতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিল। 


পরিবেশটা মোটেই ভাল লাগল না। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। স্কুটার স্টার্ট দিতে দিতে শুনলাম ভাঙ্গা গলায় কাজলদা চিৎকার করে গান গাইছে– মন জানালা খুলে দে না, বাতাস লাগুক প্রানে। আমার সঙ্গী অভিক বলল– কাজলদা পাগল হয়ে গেছে রে। হাসলাম।  উত্তর দিলাম না। সত্যি, কাজলদা পাগল হয়ে গেল। তাকে পাগল আখ্যা দিতেই তো হবে। নইলে কাজলদার বাড়ির, এই পৃথিবীর আর সবাইকে পাগল বলতে হয়।



Comments