বইকথা - সুবীর সরকার




বিরানভূমি,দাবার বোর্ড ও নেক্রপলিস



'আজকাল আমাদের গল্প দীর্ঘশ্বাস হয়ে 
ভেসে বেড়ায় নেক্রপলিসে 
হেরে গেছি বারবার বিশ্বাস করে 
ইদানিং সমস্ত দৃশ্য দাঁতমুখ চেপে 
ভালো আছি, দেখাতে পারি ম্যাজিক 
আদতে আমরা জিভহীন জনতা'


উপরের কবিতাটি লিখেছেন কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগী। জন্ম ও যাপন উত্তরাঞ্চল। লিখে চলেছেন বাংলা ভাষায়। নিজস্ব স্বর আয়ত্ত তার। তার হাঁটবার রাস্তায় কান্না ও বিষাদের স্বরলিপি। বাংলা কবিতায় পাপড়ির নিজস্ব পাঠক রয়েছে।পরিচিত নাম সে। নিরন্তর নিরীক্ষায় আর কাটাকুটির ভেতর দিয়েই এই কবির জার্নি। একটা তীব্র ঘোর তাড়া করে বেড়ায় পাপড়ি কে। সে ঘোর জড়ানো টানেল দিয়ে তীক্ষ্ণ এক একাকীত্ব নিয়েই হেঁটে যায়, হেঁটে যেতে থাকে রৌদ্র কিংবা কুয়াশায়। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে খুঁড়তে খুঁড়তে কবি পাপড়ি গুহ নিয়োগী তার জার্নিকে চিরনতুন করে তুলতে থাকেন। শব্দ সচেতন, সময় সচেতন, দেশকাল সচেতন পাপড়ি এক দাবদাহের আর্তি বিছিয়ে দেন পাঠকের চলাচলের পরিসরে। সম্প্রতি সংগ্রহ করি পাপড়ির সদ্য প্রকাশিত এই বইটি।তারপর পাপড়ির অটোগ্রাফ নেই। ছবিও তোলা হয়। ছিলেন তরুণ কবি নীলাদ্রী দেবও। এই বইটি পাপড়ির অন্য বইগুলি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। পলিস বা নগররাষ্ট্রের কালো আগ্রাসনের খাবার নিচে নাগরিকের নিপীড়িত এক  অস্তিত্বসংকট পাপড়িকে উচ্চকিত করে তোলে। আসলে সাম্প্রতিক অস্থিরতা আর মানুষের বিপন্নতায় ভারি হয়ে ওঠা চারপাশ কবিকে ব্যাকুল ও আর্ত করে তুলেছে।পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া এক সময়পর্ব উঠে এসেছে এই 'নেক্রপলিস'-নামক কবিতার বইটিতে। অদ্বয় চৌধুরীর নান্দনিক ও সাংকেতিক প্রচ্ছদের ওপর অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবেন পাঠক।

নিজের ভেতরের দহ ও দাহ লিখতে লিখতে এক না ফুরোন গল্প শোনান কবি-

‘অন্ধকারে কুকুরের ডাক রপ্ত করে ফেলেছি
আপনি ভাঙা ঘরেও ভিক্ষে চাইছেন’

বাঘিনি পরি, বনসাই, ইঁদুরের গলি, সম্পর্কের জ্যামিতি, লুটেরার হাঁ-মুখ, গরম ভাতের জন্য হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ, ইচ্ছের মৃতদেহ, টাইটানিকের মতো ডুবে যাওয়া, রক্তমুখো মেশিনগানের শব্দ, আর সব নৈরাজ্য পেরিয়ে যেতে যেতে পাপড়ি দেখেন-

‘সম্পর্কের গর্তে চিতা জ্বলছে দেশে’

আর পাপড়ি নিজেকেই ছুঁড়ে দেন এক অমোঘ প্রশ্ন-

‘পাখিদের কি এনআরসি হয়


ইতিহাসে প্রমাণিত
জনসংখ্যা চিৎকার করে কাঁদতে পারে না’

আর তাই, নিজের অসহায়তা নিয়েই একজন কবিকে তার যাপনবিন্দুগুলি খুঁড়ে খুঁড়ে এক চূড়ান্ত আশ্রয়হীনতার দিকেই হয়তো চলে যেতে হয়!

কবি তার স্থির ও মগ্ন চোখে উদাসীন হয়ে পড়েন আর বিড়বিড় করে ব্লে ওঠেন-

‘জেনে গেছি
মাথা নীচু করে শাসকের সামনে দাঁড়াতে হয়’

৫১ টি কবিতা দিয়ে নির্মিত এই বইএর চমৎকার এক কথামুখ লিখেছেন স্বপন রঞ্জন হালদার।

পাপড়ি, মুগ্ধতা জানালাম আপনার কবিতার প্রতি।

 

নেক্রপলিসঃ পাপড়ি গুহ নিয়োগী
প্রকাশকঃ বৈভাষিক
মূল্যঃ ১২০ টাকা


Comments