গল্প - দেবপ্রিয়া সরকার



দক্ষিণের জানালা

বাগান ঘেরা প্যাগোডা প্যাটার্নের বাড়িটার সামনে এসে থামল একটা ছাই রঙের টাটা সুমো। নেমে এল দুই সওয়ারি। ঋত্বিক আর স্পৃহা। লাগেজগুলো ধপ করে ঘাসের ওপর রেখেই স্পৃহা চেঁচিয়ে উঠল, 

-কোথায় রে মহারানি? শিগগির বাইরে আয়।

স্পৃহার ডাক শুনে প্রায় হুড়মুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আঁখি বলল,

-আরে, এসে পড়েছিস? বাড়ি চিনতে কষ্ট হয়নি তো?


-কষ্ট! কী যে বলিস? ডঃ হালদার যেখানে যাবেন সেখানেই মাস পপুলারিটি পেয়ে যাবেন, এ আর নতুন কী? ডাক্তারবাবুর বাড়ি যাব শুনে লোকজন আগ বাড়িয়ে এসে পথ চিনিয়ে দিল।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল স্পৃহা। 

-যাক! ওকে আজ আবার কার্শিয়াং যেতে হল, সেমিনারে। নাহলে বাড়ির গাড়িটাই পাঠিয়ে দিতাম। আয় আয় ভেতরে আয়। এসো ঋত্বিকদা।

-হুম জানি জানি ডাক্তারবাবু এখন ভীষণ ব্যস্ত। নতুন জায়গা, নতুন হাসপাতাল।

হাসি মুখে বলল ঋত্বিক।  

স্পৃহা আর আঁখির পরিচয় অনেকদিনের। উচ্চমাধ্যমিকের সময় একই কোচিং ক্লাসে পড়ত তারা। তারপর স্পৃহা চলে যায় নার্সিং ট্রেনিংয়ে আর আঁখি বেছে নেয় বায়ো-সায়েন্স। হয়ে যায় ছাড়াছাড়ি। মাঝের পাঁচ- ছ’টা বছর দেখা সাক্ষাৎ প্রায় হয়নি বললেই চলে। কিন্তু নার্সিং শেষ করে স্পৃহা যখন হাসপাতালের চাকরিতে যোগ দিল তখনই একদিন এক অনুষ্ঠানে আচমকা দেখা হয়ে গেল ডঃ স্বর্ণাভ হালদারের স্ত্রী আঁখির সঙ্গে।

ট্রেনিং চলাকালিন দু’একবার ডঃ হালদারকে দেখেছিল স্পৃহা। কিছু ক্রিটিক্যাল অপারেশন সফলভাবে করার ফলে শহরের উঠতি সার্জেনদের মধ্যে বেশ নামডাক হয়েছিল তার। আঁখির সঙ্গে পুনর্মিলনের পর ঘনঘন শুরু হল যাতায়াত। এর মধ্যে স্পৃহাও সাতপাকে বাঁধা পড়েছে ঋত্বিকের সঙ্গে। ফ্রি-ল্যান্স ফটোগ্রাফার ঋত্বিককে ভালবেসে ঘর বেঁধেছে স্পৃহা। কিন্তু ঋত্বিক যেন ঠিক বাঁধা পড়েও, পড়েনি। সুযোগ পেলেই সে উড়ে যায় খাঁচা ছেড়ে। ঘুরে বেড়ায় পাহাড়-জঙ্গল-নদীর পথে পথে, ক্যামেরা আর হরেক কিসিমের লেন্সের সম্ভার নিয়ে। 

প্রথম প্রথম ভাল লাগলেও ঋত্বিকের এই বাউন্ডুলেপনায় অস্থির হয়ে উঠছিল স্পৃহা। অজান্তেই তার মনের ভেতরে তৈরি হয়ে গিয়েছিল একটা আলো আঁধারি চৌখুপি। রাতভোর হাসপাতালে ডিউটির পর বাড়ি ফিরে বেশিরভাগ দিন যখন দেখত ঋত্বিক নেই, টেবিলের ওপর চিরকুটে লেখা, “অ্যানাদার অ্যাডভেঞ্চার ইজ কলিং।’’ তখন একলা ঘরে ভীষণ অসহায় মনে হত নিজেকে। কুঁকড়ে শিটিয়ে যেত ওই চৌখুপিটার ভেতর।  এরকমই এক ছেঁড়া ছেঁড়া দিনে আচমকা তার মুখোমুখি হল আঁখি। ধীরে ধীরে আলো আঁধারের ঘেরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে এল স্পৃহা। একটা রোদ ঝলমলে পরিবেশে পেল শ্বাস নেবার অবসর। 

সারাক্ষণ অসুখ, হাসপাতাল, কিছুদিন পরপর মেডিক্যাল ফিল্ডের লোকেদের নিয়ে পার্টি, ওই একই বোরিং গল্প, একঘেয়ে পি এন পি সি সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল আঁখিও। কিশোরীবেলার সঙ্গী স্পৃহা তার কাছে ছিল এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসের মতো। মিসেস হালদারের তকমা ঝেড়ে ফেলে সিনেমা, শপিং, রেস্তোরাঁয় মেতে থাকত স্পৃহাকে নিয়ে। কিন্তু খুব বেশিদিন এই সুখ সইল না ওদের কপালে। কয়েকমাস পরেই এল ডঃ হালদারের ট্রান্সফার অর্ডার। স্পৃহাকে ছেড়ে কালিম্পং চলে গেল আঁখি। 

ছ’মাস পর দিন সাতেকের ছুটি ম্যানেজ করে আঁখি আর স্বর্ণাভর ডাকে তাদের নতুন সংসার দেখতে এসেছে স্পৃহা, সঙ্গে ঋত্বিকও। 

-উফ কী দারুণ জায়গাটা! এর আগে দার্জিলিং এসেছিলাম বার দুয়েক কিন্তু কালিম্পং এই প্রথম।

কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল স্পৃহা। বড় কাঁচের জানালার বাইরে ক্যামেরার লেন্স তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল ঋত্বিক। ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,

-আচ্ছা আঁখি কোথা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভাল দেখা যায়, বলতে পার? সান রাইজের গোটা কতক ভাল স্ন্যাপ আমার চাইই চাই।   

তার কথা শুনে মুচকি হেসে আঁখি বলল, 

-আরে রোসো রোসো, এত তাড়া কীসের? দু একদিন জিরিয়ে নাও তারপর এমন এমন সব জায়গা দেখাব যে চোখ ফেরাতে পারবে না। গলা ছেড়ে নবকুমারের মতো বলে উঠবে, “আহা! কী দেখিলাম জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না”।  


স্পৃহা আর ঋত্বিককে নিয়ে আঁখি ঘুরে এল ডেলো, লাভা, লোলেগাঁওয়ের মতো বেশ কিছু স্পট। এরপর প্ল্যান করছিল ইচ্ছেগাঁও যাবার। স্পৃহা আর ঋত্বিক চাইছে এবার তাদের সঙ্গে যাক স্বর্ণাভও। কিন্তু স্বর্ণাভর পক্ষে হাসপাতাল-রোগী এসব ফেলে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না ওদের সফরসঙ্গী হওয়া। তবুও বহু কষ্টে ম্যানেজ করল একটা দিন। দুপুর দুপুর পৌঁছে গেল ছবির মতো সুন্দর রিসর্টে। সবুজ পাহাড়ের কোলে পাশাপাশি দুটো কটেজ। একটু দূরে দেখা যাচ্ছে পাইন গাছের জঙ্গল আর অনেকটা ওপরে বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। এমন সুন্দর সাবজেক্ট পেয়ে দারুণ খুশি হয়েছে ঋত্বিক। ঘন ঘন শব্দ হচ্ছে শাটারের। গাঢ় সবুজ লনের ওপর বেতের চেয়ারে বসে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে স্বর্ণাভ। সামনে বসা স্পৃহা নিঃস্পন্দ গলায় বলল,

-আপনি হাসপাতাল থেকে চলে আসার পর সারজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে একটা বড়সড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে।

-হুম সে তো হবারই কথা। এমন একটা পরিস্থিতি  তৈরি হল সেই সময় যে আসতে বাধ্য হলাম। ওই হাসপাতালটাকে বড্ড মিস করি আমিও......

স্বর্ণাভর কথার মাঝেই কালো ক্যাপ্রি আর আসমানি রঙের একটা শর্ট কুর্তি পরে তাদের টেবিলের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এল আঁখি। নিয়মিত যোগাসন, সিস্টেমেটিক ডায়েটে এখনও ধরে রেখেছে তার তন্বী রূপ। বলল,

-উফ! ঋত্বিকদার অফুরান এনার্জি! ছবি তুলেই যাচ্ছে একের পর এক।

-ওর কথা ছাড়! হাতে ক্যামেরা পেলে স্থান, কাল, পাত্র সব ভুলে যায়। 

একটা ম্লান হাসি হেসে উত্তর দিল স্পৃহা। 

সূর্য মুখ লুকিয়ে ফেলেছে পাহাড়ের কোলে। একটা ঘোলাটে রঙের ওড়না যেন ক্রমশ ঢেকে ফেলছে মাথার ওপরের আকাশটাকে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে রজতাভ জ্যোৎস্না। রিসর্টের কেয়ারটেকার রিয়াং থাপা প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্যাম্প ফায়ারের। আচমকা বাইরে কিছু লোকের উত্তেজিত গলার স্বর শুনে রিয়াং বেরিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। ফিরে এসে জানাল, কাছেই একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। টুরিস্টের গাড়ি। গুরুতর জখম হয়েছে এক মহিলা আর একটা বাচ্চাও। কথাটা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে উঠে দাঁড়াল স্বর্ণাভ। তারপর আঁখির দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমি একটু দেখে আসছি সিচুয়েশনটা। 

স্পৃহা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,

-আমিও যাব, যদি কোনও হেল্প লাগে। 

-ওকে লেটস মুভ অন। 

আঁখি ফ্যাকাসে মুখে চেয়ে থাকল তাদের দিকে। স্বর্ণাভ আর স্পৃহাকে উত্তেজিতভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে চটক ভাঙল ঋত্বিকের। দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে জনাকয়েক মানুষের জটলা। তাদের পাশ কাটিয়ে দুমড়ে যাওয়া গাড়ির একদম কাছে চলে গেল দু’জনে। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে স্পৃহা বলল, 

-স্যার বাচ্চাটার একটা ইনজুরি রয়েছে মাথার পেছন দিকে।

-হুম বুঝতে পারছি। এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভদ্রমহিলা কোয়াইট স্টেবল। তুমি ওদের দেখো আমি গাড়িটা নিয়ে আসছি।

রক্তমাখা অচৈতন্য মা-ছেলের মুখ জাগিয়ে তুলেছে স্পৃহার ভেতরে থাকা সেবিকার মনকে। তাই তো ইচ্ছেগাঁওয়ের মোহময়ী রাতের হাতছানি ভুলে সেও চেপে বসল গাড়িতে। একটুও সময় নষ্ট করলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো মুশকিল হবে। দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে স্বর্ণাভ পেরিয়ে আসছিল পাহাড়ি রাস্তার একের পর এক হেয়ারপিন বেন্ড। হাসপাতালে পৌঁছে অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে স্বর্ণাভ তার টিম নিয়ে শুরু করল চিকিৎসা। প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টার পর বিপদমুক্ত হল মা এবং ছেলে।


-কিছু শুনতে পাচ্ছ আঁখি?

-কী?

-ওই তো, শোনো মন দিয়ে। নদীর স্রোতের শব্দ ওটা, তাই না?

কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল আঁখি। তারপর হাসি মুখে বলল,

-হুম ঠিকই ধরেছ। 

ফটফটে জ্যোৎস্নায় ভরে আছে চারপাশ। মাঝে মাঝে নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে কোনও রাতপাখির শব্দ। ব্যাকগ্রাউন্ডে অবিরাম বেজে চলেছে স্রোতের কুল কুল ধ্বনি। সম্মোহিতের মতো দক্ষিণের জানালাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঋত্বিক। এই সুন্দর রাতের যাবতীয় প্ল্যান প্রোগ্রাম মাটি হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। এখন কোনও মতে রাতটুকু পার করার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা। পাশাপাশি দুটো কটেজ ভাড়া নেওয়া হলেও নিরাপত্তার খাতিরে একটা কটেজেই রাত কাটাচ্ছে দু’জনে। ডিনার শেষ করে সোফার ওপর অন্যমনস্কভাবে বসেছিল আঁখি। ঋত্বিকের কথায় সম্বিৎ ফিরল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

-তোমার ছবি তোলার পাগলামিটা সেই আগের মতোই আছে দেখছি।

জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ঋত্বিক বলল,

-ধুর, ওটাই তো আমার ধ্যান-জ্ঞান। কীভাবে ছেড়ে দিই বল?

-এখনও অশান্তি হয় স্পৃহার সঙ্গে?

-হ্যাঁ, সে আর বলতে!

হাসি মুখে উত্তর দিল ঋত্বিক। আঁখির মুখটা একটু কঠিন হয়ে গেল,

-ওয়ার্থ লেস! ওরা রোগী, অসুখ, ওষুধ, পথ্য ছাড়া আর কিছু বোঝে নাকি? দেখলে না আজও এমন সুন্দর একটা রাত ফেলে কেমন দৌড়ল!

ঋত্বিক কিছু বলার আগেই আঁখি আবার বলল,

-তোমার তোলা ছবি আমার খুব ভাললাগে, জানো? বিশেষ করে ল্যান্ডস্কেপগুলো। দেখার চোখ আছে, মানতে হবে। 

ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি নিয়ে আড় চোখে তাকাল ঋত্বিক।

-বলছ? সত্যি তোমার ভাললাগে আমার তোলা ছবি?

-হুম, ভীষণ!

খানিক শক্ত হল ঋত্বিকের চোয়াল। চাহনি ধারাল। গলায় ঝাঁঝ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 

-তাহলে সেদিন আপত্তি করেছিলে কেন?

একটু আমতাআমতা করল আঁখি,

-সেদিন, মানে, হঠাৎ ওই রকম একটা প্রস্তাব পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তার ওপর মনে হল স্পৃহা জানলে কীভাবে নেবে বিষয়টা। তাই পিছিয়ে এসেছিলাম।

-উফ, এই ধারণাটাই বদলাতে হবে। ন্যুড ফটোগ্রাফি মানেই শুধু নগ্ন ছবি বা যৌনতার উস্কানি নয়। প্রকৃতির সৃষ্টি করা মানব শরীরের সৌন্দর্যকে লেন্সবন্দি করাটাই এখানে মূল উদ্দেশ্য। প্রবুদ্ধ দাশগুপ্ত, রঘু রাই, বিক্রম বাওয়া, ঈশানী দাস হোক বা জ্যান সাউডেক, অ্যান্টনিও টিজার, স্যান হাসকিন্সের মতো দেশী-বিদেশী ফটোগ্রাফারদের ক্যামেরা এ কথাই প্রমাণ করেছে বারবার। তোমাকে প্রথম দিন দেখেই আমি ভেবে নিয়েছিলাম জীবনে যদি কখনও ন্যুড ফটোগ্রাফি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি তবে তোমার ছবিই তুলব। বিশ্বাস করো তুমি প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবার পর আমি আর ওই বিষয়টা নিয়ে এগোয়নিই।

সোফা থেকে উঠে ধীর পায়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল আঁখি। তারপর ঋত্বিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,

-এত কনফিডেন্স আমার ওপর?

-একদম। গড়পড়তা মেয়েদের থেকে একেবারে আলাদা তোমার শরীর। ইউ হ্যাভ ওয়ান্ডারফুল কার্ভস অ্যান্ড এক্সেপশনাল বডি স্ট্রাকচার। ঠিক যেমনটা আমি চাই। 

তীক্ষ্ণ চোখে ঋত্বিককে জরিপ করতে করতে বাম হাতের আঙুল দিয়ে লাল নাইট গাউনের ফিতে খুলে ফেলল আঁখি। অস্ফুটে বলল,

-তাহলে আজই একবার চেষ্টা করে দেখি।

মুহূর্তে ঝলমল করে উঠল ঋত্বিকের চোখমুখ। উত্তেজিত গলায় বলল,

-তুমি রাজি আছ আঁখি? আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না! আমার এতদিনের ইচ্ছে এভাবে, এখানে......

উত্তেজনায় কাঁপছিল আঁখিও। কয়েকমাস আগে আচমকাই ঋত্বিক তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল ন্যুড ফটোশুটের। তার মারকাটারি ফিগার দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ঋত্বিক। সেসময় মানা করলেও আজ বুঝতে পারে দিনের পর দিন একজন সফল মানুষের স্ত্রী হয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। ‘ডাক্তারবাবুর বউ’ এর বাইরে যে তার একটা অস্তিত্ব আছে সেটা যেন ভুলতে বসেছে ইদানিং। জাহির করার মতো তেমন কোনও গুণ না থাকলেও আঁখির সব থেকে বড় সম্পদ তার সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা রূপ আর তিলতিল করে গড়ে তোলা শরীর। যার কদর সেভাবে কেউ করে না আজকাল আর। এমন কী স্বর্ণাভও না। এই জড়ভরত দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আঁখি। ঋত্বিকের কথাগুলো শুনে তার বুকের ভেতর ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনটা জেগে উঠল দপ করে। সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল শেষমেশ, প্রকৃত জহুরির চোখের সামনেই সে মেলে ধরবে তার লুকনো ঐশ্বর্য। গড়ে তুলবে স্বতন্ত্র পরিচয়। 

ক্যামেরা হাতে নিয়ে তৈরি হল ঋত্বিক। ছবির পর ছবি তুলেও যেন মন ভরছে না তার। আঁখির নির্মেদ শরীরী বিভঙ্গের নেশায় ক্রমশ খেই হারাচ্ছে ঋত্বিকের শিল্পী মন। জমাট কুয়াশার আলিঙ্গনে একটু একটু করে আত্মসমর্পণ করছে নিঝুম চাঁদনী রাত। নির্বাক সাক্ষী হয়ে জেগে আছে শুধু দক্ষিণের জানালাটা।         


ফ্রিজ থেকে বের করা কিছু আনাজ দিয়ে রান্নাটা ঝটপট সেড়ে ফেলল স্পৃহা। গড়ে ফেলল গোটা কয়েক হাত রুটিও। সামনে বসে থেকে স্বর্ণাভকে খাওয়ালো মন ভরে। বরাবর দূর থেকে দেখা মানুষটার এত কাছে আসতে পেরে বড্ড আনন্দ হচ্ছিল স্পৃহার। তরকারি মাখানো একটা রুটির টুকরো মুখে চালান করে স্বর্ণাভ বলল,

-দেখ তো কী মুশকিলে ফেললাম তোমাদের। খামোখা ঘোরাটা মাটি হল আমার জন্যে।

-না না স্যার এটা আমাদের ডিউটি। আমি কিছুই মনে করেনি। আঁখির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। ওরা ফেরার চেষ্টা করেছিল কিন্তু গাড়ি পায়নি।

-হ্যাঁ, পাবার কথাও নয় এসময়। কাল সকালের আগে আসতে পারবে না।

স্পৃহার শোবার ব্যবস্থা গেস্টরুমে। একটা ঘর পরেই আছে স্বর্ণাভ। ট্রেনিংয়ের সময় থেকেই ডঃ হালদারের জন্যে একটা বিশেষ ভাললাগা জন্ম নিয়েছিল স্পৃহার মনে। তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা, নিজের বিষয় সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আর সহানুভূতিশীল মন সবসময় টানত স্পৃহাকে। আজ ইচ্ছেগাঁওয়ের রাস্তা থেকে তুলে এনে যেভাবে স্বর্ণাভ মা-ছেলের প্রাণ বাঁচাল, তা দেখে ওর প্রতি স্পৃহার শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা আরও বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। খাটের ওপর স্তব্ধ হয়ে বসে আছে স্পৃহা। তার মন জুড়ে এখন শুধুই ছ’ফুট উচ্চতার এক ব্যক্তিত্বময় পুরুষ। 

হঠাৎই হিমেল হাওয়ার স্পর্শে চমকে উঠল স্পৃহা। ভেঙে গেল ঘোর। বাতাসের ধাক্কায় কখন যেন খুলে গিয়েছে দক্ষিণের জানালার পাল্লাটা। চোখে পড়ছে ধোঁয়াটে কুয়াশা আর সফেদ জ্যোৎস্নার এক মহাজাগতিক মিলন দৃশ্য।









Comments