গল্প - অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য


কমিউনিস্টের বউ   



আজ ফাল্গুন মাসের শিব চতুর্দশী। সত্তর বছরের ননীবালা কৃষ্ণকায় শিবলিঙ্গের মাথায়, দুধ,  ঘি, মধু মিশ্রিত গঙ্গাজল ঢালছেন। শিবলিঙ্গের মাথায় বেলপাতা, ধুত্র ফুল, আকন্দের মালা, ধুত্র গাছের কাঁটা ফল, ছোট একটা বেল। ঠাকুর মশাই যা মন্ত্র পড়ছেন ননীবালার কান পর্যন্ত পৌঁছয় না। উনি শুধু বলেন – ওঁ নম শিবায়, ওঁ নম শিবায়, ওঁ নম শিবায়।
 
ঠাকুরমশাই বিরক্ত হয়ে বলেন – কী হল  মন্ত্র বলছেন না? 
ননীবালার কান পর্যন্ত সেই প্রশ্ন পৌঁছয় না। উল্টে উনি প্রশ্ন করেন – ভাঙের  গুলিটা কোথায় রাখলাম? ঠাকুরমশাই আপনি কী  দেখেছেন?
মিঠাই ফিক করে হেসে বলল – ও থাম্মি ভাং খেলে যে নেশা হবে।  
ননীবালা নাতনীর হাসি দেখেই বুঝি প্রশ্ন অনুমান করেছেন। - দিদিভাই রাতদিন  শ্মশানে পরে থাকে তো। নেশা করে চিতার ছাই মেখে ঘুরে বেড়ায়।কথাগুলো বলে নিজেই ফিকফিক করে হাসলেন।  
মিঠাই মজা করে বলল – থাম্মি  তুমি আমায় যে আশীর্বাদ করে বল  “শিবের মতো বর হোক তোর”! তাহলে অমন বরের  দরকার নেই আমার।  মিঠাই থাম্মির গাল ধরে বলল  – তুমি এজন্মেও শিবের মতো বর পেয়েছ পরের জন্মেও শিবের মতো বর পাবে।  

-ধুর ছেমড়ি ভাগ এখান থেকে। তোর ওই সাইকেলওয়ালা বরই জুটবে। মজা করে অনেক সময় নিজের ফেলে আসা দেশের দুএকটা শব্দ বলে ওঠেন। 

মিঠাই কানে  ফিসফিস করে বলে – সাইকেল নয় মোটরসাইকেল আছে আমার বরের। তবে তোমার বরের মতো চণ্ডাল রাগ তার নেই। 
ননীবালার কানে সবটা কথা যায়নি। হেসে বলেন -  ঠিক  দিদিভাই,  শিবের মতো গুন না থাকলেও,  রাগ তো ষোলোআনাই ছিল। তোরা তো সে রাগের কিছুই দেখিস নি। বয়েস হলে নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়। তখন রাগ দেখাবে আর কাকে?       
মা আপনার পূজা হল? এবার  আমরাও  যে শিবের মাথায় জল ঢালব।

এই বাড়ির লোকদের মনে ভক্তি থাকলেও তা দেখাবার জো ছিল না। বাড়ির গৃহ কর্তা উমাশঙ্কর গড়াই ছিলেন কট্টর  কমিউনিস্ট। তিনি দুবছর হল দেহ রেখেছেন। তার পর থেকে তেত্রিশ কোটি না হোক অন্তত তেত্রিশজন দেবীর আগমন ঘটেছে ঠাকুর ঘরে।
ষাটের পর থেকে তার তেজ কমেছিল।কর্মক্ষেত্রেও যতদিন চাকরি ততদিন গড়াইবাবুর কদর ছিল। কিন্তু অবসরের পরে তেমন কেউ খোঁজ নেয়নি। পাড়াতে সন্ধ্যাবেলার আড্ডায় পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তর পেছেন। চায়ের দোকানে বসে দেশ উদ্ধার করেছেন। সময় আরও গড়িয়েছে  সুগার, প্রেসার কিডনির অসুখে শেষে কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছিলেন। বারান্দার চেয়ারে বসে ফ্যালফ্যাল করে রাস্তার লোক দেখেছেন। ছেলে বৌমারা সব চাকরি করে। তাদের শুধু “কেমন আছেন বাবা” এই কথা ছাড়া দুদণ্ড বসার সময় হয়নি। নাতিনাতনিরাও দাদুর খিচখিচে স্বভাবের জন্য কোনোদিন কাছে ঘেসেনি। তখন ননীবালা ছাড়া জগৎ অন্ধকার। শেষ বয়েসে হলেও বউয়ের কদর যে টের পেয়েছিল, এতেই খুশি ননীবালা। ঠাকুরের একটা ছবিও ঘরের দেওয়ালে ছিল না।সাদা দেওয়ালে রোজ প্রনাম ঠুকে ননীবালা বলতো – মানুষটাকে বিছানায় ফেলে কষ্ট দিও না ঠাকুর। আমি বিধবা হয়ে থাকতে পারবো। আমার স্বামী একা একা সংসারে জড়বস্তু হয়ে থাকতে পারবে না। ঠাকুর কথা শুনেছিল। হঠাৎ করেই উমাশঙ্করের মাঝরাতে হার্ট ফেল হয়।  
        

বাইরের দরজায় কেউ ডাকছে মনে হল। এবার কলিংবেল বেজে উঠল। ননীবালা কানে কম শোনে তাই শুনতে পায়নি। ছোট নাতী  দৌড়ে এসে জানালো - একজন ঠাকুমা আর এক দাদা এসেছে। ওই ঠাকুমা  কাউকে খুঁজছে – “বকুল ফুল”  বলে। নাতীর মুখে বিস্ময়ের ছাপ - আমায় জিজ্ঞেস করল উমাশঙ্কর গড়াইয়ের বাড়ি নাকি এটা! ননীবালা আধা শুনেছে আধা শোনেনি। তাড়াতাড়ি  টেবিলে রাখা কানের মেশিনটা গুঁজে কিছুক্ষন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো।  
এবার ননীবালার চোখে মুখেও  বিস্ময়য়ের ছবি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে – “বকুল ফুল”! তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বসবার ঘরে এসে অবাক হয়ে  বলল – শুক্লা! 

বৃদ্ধার পরনে  লাল পার  গরদের শাড়ি। চোখে জল টলটল করছে – সই পাতিয়েছিলাম যে নামে, সেই নামটা কী ভুলে গিয়েছিস? 
গলা জড়িয়ে ধরল ননীবালা – ভুলতে কী পারি!  আমার “জবাফুল” কতদিন পর দেখলাম তোকে! 
ননীবালার মতো বৃদ্ধার শ্রবণ শক্তি ভোঁতা হয়ে যায়নি। তৎক্ষণাৎ ননীবালার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল – আমি ভাবলাম এতদিনে ভুলে গিয়েছিস।
    

ননীবালা পঁয়ষট্টি সালে বাবার হাত ধরে দেশ ছেড়ে ছিল। চোরা পথে এসে উঠেছিল বনগাঁ শহরের  মনি ঘোষের  বাড়ি। বাবার পুরনো বন্ধু। প্রায় ছমাস ছিল। তখন মনি ঘোষের  মেয়ে শুক্লার  সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। দুজনেই তখন তেরোর কোঠায়। দুজনে সই পাতায় জবাফুল আর বকুলফুল। সেই ছমাস জীবনের সব থেকে আনন্দের দিন ছিল। দুই সই  নয় যেন এক মায়ের পেটের বোন ছিল। এক থালায় খাওয়া। একে অপরের শাড়ি পরা। সারা দুপর আম বাগান, জাম বাগানে ঘুরে বেড়ানো। পুকুরে মাছ ধরা। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলা। ননীবালা আর শুক্লা দুজনেই ছিল মা মরা মেয়ে তাই বাবাদের প্রশ্রয় ছিল একটু বেশি।  
 
পরে বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসে ননীবালা। বাপ মেয়ে ভাড়া বাড়িতে ওঠে। মন্দার বাজারে একটি জুটমিলে চাকরীও জোগাড় করেছিল ননীবালার বাবা। কিন্তু  দুবছর যেতে না যেতে হঠাৎ তিনি বাসের নিচে পরে  মারা যান। একা মেয়েকে কে রাখবে? তাই প্রতিবেশীরা ননীবালাকে  হোমে পাঠায়।
বাবার সংসারে অভাব থাকলেও ননীবালা  রাজকুমারীর মত থাকতো। তার সব আকাঙ্খাই পূর্ণ করার চেষ্টা করত বাবা। হোমে গিয়ে সে হঠাৎ খুব বড় হয়ে গেল। সেখানে পড়াশুনোর সঙ্গে  হাতের কাজ শেখানো হত। সেলাই, আসন বোনা, বেতের কাজ। সেখানেই কষ্ট করে  এইট পাস করে। হাতের কাজেও বেশ দক্ষ হয়ে ওঠে। হোমের থেকেই তখন গন বিবাহের ব্যবস্থা করা হত। সেখানেই উমাশঙ্করের সঙ্গে ননীবালার দেখা হয়। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছিল ননীবালার। হোমের মাসির মুখে শুনেছিল ছেলে পার্টি করে,  কমিউনিস্ট। নামটার ওজন ছিল। ননীবালা এসব সম্মন্ধে কিছুই জানত না। পার্টি কী! খায় না মাথায় দেয়! কমিউনিস্ট বুঝি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের মতই একটা কিছু। বেশ আরামেই কাটবে ভেবেছিল বাকি জীবন।

ষোল বছর বয়েসে বিয়ে  করে যখন উমাশঙ্করের বাড়ি এল। শ্বশুরবাড়িতে বিবাহযোগ্যা দুই ননদ। ছেলেমানুষ দেওর। তারা ননীবালাকে পেয়ে কেমন আঁকড়ে ধরল।  

১৯৭০ সাল। নকশাল পিরিয়ড। আরেকদিকে পুলিশ যখন তখন বাড়িতে চড়াও হয়ে বাড়ির ছেলেদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য পার্টির লোক  উমাশঙ্করকে দেখলেই কেটে ফেলবে। বাড়িতে থাকার জো নেই। এদিকে বাড়িতে বড় বলতে ননীবালা একা। পরিবারের  মুখে কি তুলে দেবে জানে না। উমাশঙ্করের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। পার্টি করে তো আর পেট চলে না। এই কথাটা কে বোঝাবে তাকে? উমাশঙ্কর একেক সময় সামান্য কিছু টাকা  হাতের মধ্যে গুঁজে দিতো। টিউশনির যৎসামান্য টাকায়  মাসের অর্ধেকও যেত না। বেশিরভাগ  সময় ছাত্রের বাড়ি ঠিক  মত যেত না। মিছিলেই তাকে বেশি দেখা যেত। অনেকে তাই ছাড়িয়ে দিতো। আবার অনেকে চেনা শোনার জন্য না করতে পারত না। এভাবেই মাসের প্রথমে উমাশঙ্করের হাতে ছাত্র পড়াবার মাইনে এলে ঘরে চাল, ডাল নিয়ে আসত। কিন্তু শুধু চাল ডালে তো সংসার চলে না। ততদিনে ঘরে আরও দুজন মানুষ বেড়েছে। এতগুলো মানুষ তাদের পড়াশুনো, জামাকাপড় সঙ্গে অসুখ বিসুখ আছে। অভাবের সংসারে চাল বাড়ে না। কিন্তু মানুষ পেট ফুঁড়ে বেড়ে যায়। 

উমাশঙ্কর এসেছিল দেশভাগের পরেপরেই। বাবা মায়ের হাত ধরে। প্রথমে রিফিউজি ক্যাম্প।  তারপর সরকার থেকে জমি পেয়ে একটা টালির বাড়ি করে। এই কলকাতাতেই পড়াশুনো। বাবা  কলেজে পিওনের কাজ করত। পরে সংসারে লোকসংখ্যা বাড়ে। দু বোন  ভাই নিয়ে ঠাসাঠাসি। উমাশঙ্কর তখন শুধুই অক্ষরে শান দিচ্ছে। কিটস, মার্কস, লেনিন পড়ছে। কলেজ শেষ করে দেশ গঠনের বিপ্লবে নাম লিখিয়েছে। এর মধ্যে মা বাবা মারা গেলে উমাশঙ্করের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। অর্থ রোজগারের জন্য বিপ্লবকে ত্যাগ করেনি। ননীবালা বিয়ের প্রথম প্রথম প্রেমের সাগরে ভাসতে ভাসতে জিজ্ঞেসা করেছিল – আমায় বিয়ে করলে কেন? 

উমাশঙ্কর হেসে বলেছিল – অসহায় মেয়েকে উদ্ধার করাও আমাদের বিপ্লবের অঙ্গ। বিপ্লব মানে বোঝ? ট্রাঙ্ক থেকে  কবিতার পাতা মুখের সামনে ছুঁড়ে দিয়েছিল। সেসব কবিতা বোঝেনি ননীবালা। তবে মনে মনে ভক্তি হয়েছিল তার স্বামী কবি।   
বিয়ের সময় হোম থেকে একটা করে মেশিন উপহার পেয়েছিল মেয়েরা। ননীবালাও পেয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে পাকাপাকি ভাবে মেয়েদের জামা সেলাইয়ের কাজ শুরু করল।উমাশঙ্কর প্রথমটায় একটু চোটপাট করলেও। অভাবের সংসারে টাকা এলে একটু সুরাহাই হয়। মেয়েরা মেয়েদের কাছে সাচ্ছন্দ বোধ করে। শরীর ছুঁয়ে মাপ নিতে গেলে অনেকেই পুরুষ দর্জির কাছে যায় না। বড় বাড়ির মেয়েরা এসেও জামা, ব্লাউস সেলাই করতে দিয়ে যেত। ননীবালার লক্ষ্মীর ঘট একটু একটু করে ভরে উঠছিল। কলোনি পেড়িয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এক বড় বাড়িতে তার ডাক পড়লো। গৃহিণীকে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিল। এ যে শুক্লা, তার জবাফুল! ননীবালা বন্ধুকে  জড়িয়ে অনেক কেঁদে ছিল সেদিন। এতদিনের জমা কথা খরচ করে দিয়েছিল। দুঃখ কষ্ট সবাইকে তো বলা যায় না!ননীবালা প্রতিমুহূর্তে যে যুদ্ধ করে চলেছে সে আর কাকে শোনাবে?
       
ননদদের দুজনকেই বিয়ে দিয়েছে। দেওর কারখানার কাজ নিয়ে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। ননীবালার দুই ছেলের  বয়েস ছয়  আরেকজনের দুই। সন্ধ্যে থেকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। চারিদিকে নকশাল আন্দোলন  ছড়িয়ে পড়ছে। মাঠে ঘাটে তাজা  যুবকের দেহ পরে রয়েছে। একেক সময় গুলির আওয়াজ কানে আসে। 
 
এরকমই এক  সন্ধেবেলায় বাড়িতে দশ বারোজন ছেলে ঢুকে শাসিয়ে গেল – আপনার স্বামীকে বলবেন  পালিয়ে বাঁচতে পারবে না বেশিদিন।মরতে তাকে হবেই।
সেদিন ঠাকুরঘরে গিয়েও যে কাঁদবে তার উপায় ছিল না। আসলে শ্বশুরবাড়িতে  দেবতার বিগ্রহ রাখা বারন ছিল। তাও বিয়ের পর ননীবালা মেলা থেকে শিবের মূর্তি নিয়ে এসেছিল। উমাশঙ্কর সেদিন রেগে গিয়ে বলেছিল – মূর্তির মধ্যে কী ঈশ্বর থাকে? সে  তোমায় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবে?   
ননীবালা আঁতকে বলেছিল – মূর্তি কি গো। এ যে দেবতা। 
-আমরা দেবতা মানিনা। আমাদের শুধু একজনই লিডার, লেনিন। মনে রেখো তুমি কমিউনিস্টের বউ। আমাদের একটাই ধর্ম মানবতা। আমরা সাম্যবাদে বিশ্বাসী। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের সুস্থ ভাবে দুবেলা পেট ভরে খাওয়ার অধিকার আছে। সেই খাওয়ার তোমার এই মূর্তি যোগায় না।মানুষকে খেটে উপার্জন করতে হয়।    

তবে সেদিন উমাশঙ্করকে ঈশ্বর না তার ভাগ্য বাঁচিয়েছে! ননীবালা জানে না।

সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া ছিল। দুপুর থেকে বৃষ্টি নামে। সন্ধ্যে ঘোর। দীর্ঘক্ষণ লোড শেডিং। প্রায় দুমাস বাড়ি ছাড়া উমাশঙ্কর। মধ্যে বন্ধু মারফৎ একটা চিঠি এসেছে ‘ ভালো আছি’। 
 

আটটা নাগাদ বৃষ্টির পরিমান বাড়ল। তারমধ্যে দরজায় কে খটখট করল। ননীবালা দরজা খুলতেই, অন্ধকারে ভূতের মত ভিতরে এসে দাঁড়ালো উমাশঙ্কর ।সপসপে ভিজে জামা কাপড় গায়ে। ফিসফিস করে বলল – খিদে পেয়েছে। কিছু খেতে দেবে? ননীবালা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালাল। খাবার বেড়ে সামনে বসলো। 
বাড়ির আশেপাশে কেউ টের না পেলেও। কোথা থেকে সেই ছেলেগুলো খবর পেলো। দরজায় দুমদুম করে আওয়াজ করে বলল – দরজা  খুলেদিন। উমাশঙ্কর এসেছে। আমরা জানি। 
একগ্রাস মুখে তোলার আগেই মৃত্যু এসে কড়া নাড়ছে। ঘরের পিছনের বেড়া কেটে স্বামীকে বের করে দিলো ননীবালা। হাতে দিলো একটা চিঠি। বলল – এই পানা পুকুর পেড়িয়ে আমার সইয়ের বাড়ি। দরজায় লেখা ভোলানাথ সরকার। সেখানে নির্ভয়ে চলে যাও। এই চিঠি খানা দিও সব বুঝতে পারবে।


দরজা ভেঙে যতক্ষণে ছেলেগুলো ঢুকে পড়েছিল ঘরে, ততক্ষনে উমাশঙ্কর পানা পুকুরে ডুব দিয়ে  অনেকটা চলে এসেছে। সোজা গিয়ে ভোলানাথ সরকারের দোতলায় গিয়ে কড়া নাড়ল। শুক্লা এসে দরজা খুলতেই চমকে উঠেছিল। একজন অচেনা মানুষকে এরকম কাদা মাখা অবস্থায় দেখে চিৎকার করতে গিয়েছিল। উমাশঙ্কর বলল – ননীবালা আমায় পাঠিয়েছে। আমি তার স্বামী। খুব বিপদ। এই চিঠিটা নিন। 

শুক্লা আগেই সইয়ের কাছে শুনেছিল সব। আজ এই পরিস্থিতির কথা বুঝতে অসুবিধা হল না।মাথায় ঘোমটা টেনে বলল – আপনি  কুওতলায় স্নান করে আসুন। আমি কাপড় পাঠাচ্ছি।  
শুক্লার স্বামী সজ্জন মানুষ। সব শুনে কিছুক্ষন ভেবে বলল -  ওরা এখানেও আসতে পারে। নিশ্চই এতক্ষনে বুঝেছে উনি বেড়া কেটে পালিয়েছেন। আর এই পানাপুকুরের এপারে শুধু আমাদেরই বাড়ি। এক কাজ করো শুক্লা তুমি আমায় মায়ের সাদা থান দাও। আমি ওনাকে এটা পরে আসতে বলি। তুমি ঠাকুরঘরটা খুলে দাও। 
সারা পাড়া নিঝুম  অন্ধকারে ঢাকা। দরজাটা মনে হচ্ছে ভেঙেই ফেলবে ওরা। দরজা খুলুন বলছি। নইলে ভেঙ্গে ফেলব। শুক্লার স্বামী গিয়ে দরজা খুলল – কী হল? এরকম করার মানে কী? 
একজন হাতে পিস্তল নিয়ে বলল – মানেটা একটু পরেই বুঝতে পারবেন। উমাশঙ্করকে লুকিয়ে রেখেছেন! তুলেদিন আমাদের হাতে। শুক্লা পিছন থেকে বলল – আমরা ওরকম কাউকে চিনি না। 
একজন শান্ত গলায় বলল – আমরা ঘর সার্চ করবো।
সব ঘর সার্চ করে কিছু না পেয়ে ঠাকুর ঘরের দিকে হাত দেখিয়ে বলল – ওটা  কীসের ঘর? ভিতরে কে আছে? কে প্রদীপ জ্বালিয়েছে?  
শুক্লা এগিয়ে গিয়ে বলল – ঠাকুর ঘর। আমার শাশুড়ি পুজো করছেন। বাইরে থেকে ওরা দেখল থান পরা একজন বৃদ্ধাকে। যে একমনে পুজো করছে।
ওদের মধ্যে থেকেই একজন বলল – মুখটা দেখতে পেলাম না। 
আরেকজন হুঙ্কার দিয়ে উঠল – হিন্দু বাড়ির ঠাকুর ঘরে যখন তখন ঢোকা যায় না। উমাশঙ্কর কমিউনিস্ট। আর যাই হোক ঠাকুর ঘর মাড়াবে না। তোরা সবাই চলে আয় ।
বোঝা গেল লোকটা এই দলের লিডার। পাড়ার কেউ জানত না। শুক্লার শাশুড়ি বৃন্দাবন গিয়েছে। সেদিন ঠাকুর ঘরে যে বৃদ্ধা ভগবানের আরতি করছিলেন তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী উমাশঙ্কর। নিজের কাদামাখা জামাকাপড় কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন।তারবদলে গায়ে জড়িয়ে ছিলেন সাদা থান।


এতক্ষন দুই বন্ধুতে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করছিল। শুক্লার হাত ধরে ননীবালা বলল – জবাফুল তার একমাস পর তো তোরা উত্তর প্রদেশ চলে গেলি। 
শুক্লা মুখে পান পুরে বলল – শুধু কি উত্তর প্রদেশ! কত যে জায়গায় ঘুরেছি। বদলির চাকরী হলে যা হয়। শাশুড়ি দেওরের কাছে চলে যান। বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় দেওর। কলকাতার পাট চুকে গিয়েছিল। ছেলে দিল্লীতে থাকে, আমি এখন তার কাছেই থাকি। নাতনীর কলকাতায় বিয়ে হয়েছে। সেখানেই এসেছি। ভাবলাম একবার ঘুরে যাই। ননীবালা দেওয়ালে টাঙ্গানো ছবির দিকে তাকিয়ে বলল – তোরা না থাকলে সেদিনই আমি বিধবা হতাম। 
শুক্লা হাত চেপে ধরে ননীবালার – ঠাকুর রক্ষা করেছিলেন সেদিন।  
ননীবালার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠেছে, চোখে জল চিকচিক করছে -  স্মৃতির অলিতে গলিতে কত যে ঘটনা, বলতে গেলে আর শেষ হয় না।




Comments