কালচেতনার আত্মবীক্ষণে কবি সমর সেন
সমর সেন এমন এক কবির নাম, যাঁর কবিতার ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে কালচেতনার আত্মবীক্ষণে আর প্রতিমুহূর্তের জীবনসত্য এবং সময়সত্যের অনুসন্ধানে। যেখানে কবি নিজেই একাধারে চিত্রকর এবং প্রেমিক। আবার কখনও এক আহত রাগীমানুষ কিংবা সময়সত্যের অনুভবে এক আত্মমগ্ন অনুসন্ধানী। কালি–কলমের আঁচড়ে কোনো কোনো মানুষের সঠিক ছবিটি আঁকা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কবি সমর সেন সম্পর্কে কিছু লিখতে গেলে একথাই বারবার আমার মনে আসে। তাঁকে নিয়ে বলতে তাই শব্দ অকুলান হয়ে পড়ে বলে মনে হয়।
মানুষ ও জীবনকে ভালোবাসার যে আবেগ কবি সমর সেন তৈরি করেছিলেন পাঠকের মনে আজও তাঁর রেশ লেগে আছে। তাঁর সত্যভাষণ, স্পষ্টবাদিতা, মনুষ্যত্ববোধ, দার্ঢ্য - নিঃসন্দেহে দুর্লভ। চল্লিশের দশকে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি খ্যাতির প্রায় শীর্ষবিন্দুতে ঠিক তখনই কবিতা লেখার পাট চুকিয়ে দিলেন। তারপর অনেক পথ ঘুরে ষাটের দশকে ঢুকে পড়লেন ইংরেজি সাংবাদিকতার জগতে। ‘নাও’ এবং ‘ফ্রন্টিয়ার’ সম্পাদনার সুত্রে তিনি হয়ে উঠলেন এক সৎ, সংবেদী সাংবাদিকতার বিরল কণ্ঠস্বর।
সেই কবি সমর সেন এর কবিতা লিখন নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমার যা মনে হয় তা হলো তাঁর লিখন ভঙ্গি কবিতা সম্পর্কীয় প্রচলিত ভাবনাকে আঘাত করে এক ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছিলো। আর যা ছিলো অনেকটাই সরল সোজা এবং মানুষের অন্তরের কাছাকাছি। সেখানে বাকচাতুর্য ছিলো না। ছিলো উপলব্ধি থেকে উঠে আসা সংহত শক্তির এক অমোঘ উচ্চারণ। যা আমাদের হৃদয়ের ভাষা সংবাদ হয়েও অনেকটাই মন্ত্রের মতো অমোঘ। অন্তর্লোক আলোড়িত করার এক প্রবল শক্তি ছিলো বলেই তাঁর কবিতা কখনো কখনো ভাষা ও ভূগোলের বন্ধনকে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলো। আসলে কবি সমর সেন বাংলা কবিতায় নিজেই একটা যুগের প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর অভিনব গদ্যছন্দে লেখা কবিতার উৎস খুঁজতে গিয়ে আমার সেকথাই মনে হয়েছে।
তিনি কবিতা লেখার সময় নিজেকে জীবনসত্য এবং সময়সত্যের অনুসন্ধানে ফিরে দেখার নেশায় রত থাকতেন। তাঁর লেখায় তিনি সেই প্রয়াস বেশ বলিষ্ঠভাবেই প্রকাশ করেছেন। আমার বিশ্বাস, সেই উচ্চারণ নিঃসন্দেহে উঠে আসতো তাঁর সমস্ত সত্ত্বাকে মথিত করে। এবং যা ছিলো তাঁর জীবন যাপনের নিবিড় এক সামঞ্জস্যের ফল। ফলে সেই লেখায় ফুটে উঠেছে তাঁর ব্যক্তিত্বের সত্য বিন্যাস, আর এই সত্যই হলো তাঁর কবিতার শক্তি। অবচেতনের এই আলো আসে মনুষ্যত্ববোধ থেকে আর তখন তিনি অভ্যাসবশত কবি না হয়ে শোকে–সংকটে পাঠকের প্রয়োজনের কবি হয়ে ওঠেন। প্রাসঙ্গিক ভাবেই তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে –
‘আলো থেকে হঠাৎ বাইরে আসি।
তাজ্জ্বব ব্যাপার।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, পিচের পথে অশরীরী ছায়া, হলুদ ঘোলাটে চোখে মোটর এগোয় হঠাৎ লোকালয়ে আগত ভীত বন্য পশুর মতো;
শহরে ফিরে এলো আদিম অন্ধকার
চাঁদনী চকে শিস দেয় এ আর পি সর্দার।’
এই কবির কবিতা সবসময়ই উজ্জ্বল এবং প্রচলিত সমাজ ধারণাকে অগ্রাহ্য করেছে –
‘আমরা বাঙ্গালী; মীরজাফরী অতীত, মেকলের
বিষবৃক্ষের ফল।’ কিংবা
‘মীরজাফরী বদরক্ত আবার অন্তঃশীলা
পাতি কেরানীর ঘরে,
আনাচে- কানাচে অনেক সংসারে,
বেনিয়ার গদীতে,
অহিংসার পরম আস্তানায়
আমাদের বাগানে বাড়ে ফনিমনসার ঝাড়
সঙ্গোপনে আয়োজন চলে মনসার পূজার।’
তাঁর কবিতা কখনোই সাজানো শব্দসর্বস্ব, ভান- ভণিতায় ভরা নয়। অনুভবের ঋজুতায় সেই লেখা তীব্রভাবে নাড়া দেয় পাঠক হৃদয়কে। কখনোই বুঝতে অসুবিধে হয় না, ঠিক কোথায় তিনি আঘাত করতে চান। কবি যে একই সঙ্গে স্রষ্ঠা এবং সত্যদ্রষ্টা, এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তা ভোলেন নি। তাঁর স্পষ্ট কথায় ছাড় পান নি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। আসলে আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে অদ্ভুত একটা দুরত্ব ও সমীহ মেশানো টানাপোড়েন এর সম্পর্ক তিনি গড়ে তুলেছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে ২২ শে জুন কবিতার অংশবিশেষ –
‘আমি রোমান্টিক কবি নই, আমি মার্কিস্ট।
অনেকে জিজ্ঞেস করে; গুরুদেবের দৃষ্টির সঙ্গে
তোমার তফাৎ টা কী? তফাৎ টা এই;
বেদ উপনিষদের বুলি মুখে তিনি বরাবর,
অক্লান্ত বাউল, একই নৌকায়
একঘেয়ে খেয়া পারাপার করেছেন;’
একসময় কথায় কথায় তিনি তাঁর সঙ্গীদের কাছে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্র প্রসঙ্গ। অথচ বিশ্বকবি সম্পর্কে তাঁর অভিমানের বোধহয় অন্ত ছিলো না। তিনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন মহা সমস্যার বিষয়। হয়তো সেই অনুভব থেকেই ‘ঝড়’ কবিতায় তিনি বলেছেন –
‘রবীন্দ্রনাথ মেঘদূতের যে ব্যাখ্যা করেছেন,
তা অনেকটাই তাঁর নিজস্ব;
প্রত্যেক দুটি মানুষের মধ্যে যে বিপুল, গভীর বিরহ’-
ভঙ্গি – সর্বস্ব মেকি কবিতার চোখ ধাঁধানো হাটে কবি সমর সেন এর কবিতা ছিলো উচ্চারণে সত্যনিষ্ঠ কেবল নয় অমোঘ ও বটে। কবিতার শারীরিক লক্ষণ গুলিকে কবিতা বলে ভুল করেন নি কখনও। তথাকথিত প্রগতিশীলতা রঙ – বেরঙের ছদ্মরূপটিকেও আক্রমণ করতে দ্বিধা করেন নি।
‘অন্ধকারের মতো ভারি তোমার দুঃস্বপ্ন,
তোমার দুঃস্বপ্ন অন্ধকারের মতো ভারি।’
আলোর ভিতরে গোপন অন্ধকারের জটিল বিন্যাসকে আপোষহীন প্রতিবাদে জর্জরিত করেছেন তিনি। শ্লেষ আর বিদ্রুপে অব্যর্থ তাঁর কবিতা। কারন, তাঁর বুকের ভিতরে রোপিত ছিলো এক সজীবতার স্বপ্ন।
সব মিলিয়ে কবি সমর সেন নিজেই ছিলেন একটা মুভমেন্ট – এমন মনে হওয়াটাই মনে হয় স্বাভাবিক। তাঁর কবিতার আলোকে আমরা সময়ের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই। উপলব্ধি করি এই জীবন, মানব সভ্যতা ও সময়ের গভীর সংকটকে। কবি সমর সেন মানেই স্পষ্ট কথার ঝড়, ঋজু হেঁটে চলা।
পড়ে ভালো লাগলো।অনবদ্য কবি-কথা।আরো পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDelete