গল্প - শুভংকর গুহ


মাঠচিহ্ন


এবছর অধিকাংশ কুমড়ো ফুলগুলি ফল হয়ে গেল।    


আবার বেশ কিছু ফুল এখনও ফুল থেকে গেল। এই সব ফুলগুলির ফুল থেকে যাওয়ার পরে শুকিয়ে যাওয়ার এক নিশ্চিত নিয়তি আছে। চাষের মাঠ দেখে অনেকে তাই ভাবে। বেশ কিছু বছর আগে কুমড়ো চাষ এই গ্রামের মাঠে বিশেষ হত না। কিন্তু কয়েক বছর হল, কুমড়ো চাষে বেশ লাভ দিচ্ছে। কুমড়োর চাহিদা এখন তুঙ্গে। ঠাণ্ডা পানীয়র কারখানায় না কি কুমড়োর চাহিদা আগুন। ভাবলে বেশ ম্যাজিকের মতো লাগে, কমলালেবুর ও আমের স্বাদের সঙ্গে কুমড়োর কি সম্পর্ক আছে তা একমাত্র জানে, ঠাণ্ডা পানীয়র কর্পোরেট উদ্যোগপতিরা। 


সব জায়গায় নয়, তবে কিছু কিছু জায়গায় মাটির সঙ্গে বালি মিশে থাকলে কুমড়ো গাছে ফলন বেশ হয়। গত বছর বর্ষাকালে একেবারে ভরা প্লাবনে বাঁকা নদীর জল মাঠে উঠে এল, বালি মাঠে ভরে গেল। সেই বালি মাটিতেই আলু উঠে যাওয়ার পরে বালির স্বাদ রয়ে গেল। আলু যেমন তদারকিতে অনেক সময় নেয় কিন্তু কুমড়ো অনেক যত্ন আদর চায়। এমনিতেই কুমড়ো গাছের লতানো ডগায় পোকা ধরে। বেশ কালো কমলা ডানাওয়ালা পোকা। ফুল ফুটলেই সেই পোকা এসে হাজির হয়। ওষুধ না দিলে মাঠের কুমড়ো মাঠেই পড়ে থাকবে। ফুটো  কুমড়ো কর্পোরেট মহাজনরা নিতে চায় না।


কয়েক বছর হল, আলু চাষের লোকসানকে কুমড়ো পুষিয়ে দিচ্ছে। দিনের আলো যতক্ষণ পাওয়া যায়, ততক্ষণ মাঠের চারদিকে মেরুদণ্ডহীন মাটিতে লতানো ডগা ধরে ধরে দেখতে হয়। খবরদার, নিঃশ্বাস পর্যন্ত যেন না লাগে কুমড়ো ফুলের পাপড়িতে। প্রতিটা ফুলের বেড়ে ওঠা, এই ফুল থেকে সেই ফুলে প্রজাপতির উড়ে যাওয়া আসা যত্নে করে দেখতে হয়। পর্যবেক্ষণ করতে হয় নিপুণ চাষির মতো।


সারাদিন পালু বেশ থাকে। শীত সরে যেতেই একবগ্গা টান আসে হাওয়া বাতাসে। খাল বিলের জল শুকিয়ে আসে। কচি নিম পাতার সাথে কুমড়ো গাছের কচি ডাঁটা এবং ফুলের চাহিদা হাটবাজারে প্রচুর। সকাল থেকেই ফড়ে এসে কুমড়ো, ডাঁটা আর ফুল চাইতে থাকে। পালু সহজে রাজি হয় না। কিন্তু কখনো কখনো ভালো দাম পেলে রাজি হয়ে যায়। মাচার ওপরে বসে মিসকিন, পায়ের পাতায় এক পালি জল ঢেলে দিয়ে বলে,- কচি কচি ফুল আর ডাঁটা দিস না পালু। আর দিস না। লতানো ডগার ফষ্টিনষ্টি নষ্ট করিস না। ডগায় ডগায় ফুলে ফুলে মিলন। পুণ্যির ফল। স্বপ্নদোষে পিচ্ছাব রাতের বিছানা নষ্ট করে দিবি। শরীরে মুতের গন্ধ সারাদিনের কাজকম্ম পানি পানি করে দেবে।


একটি কুমড়ো ফুলে যেই না হাত দিয়েছে পালু অমনি ফুলটি খিল খিল করে হেসে উঠল। চমকে উঠল পালু। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল। না কেউ নেই। তবে ? কয়েকটা ফুল তুলে রাখছিল ঝুড়িতে। আমিনুল আসার কথা আছে ভ্যান রিক্সা নিয়ে। আমিনুলের আসার খবর আগেই দিয়ে রেখেছে মিসকিন। পালুকে আগেই সাবধান করে দিয়েছে, ফুল আর কচি ডাঁটা দিবি না।


পালু ভেবেছিল, ঈশ্বরপুরে চোতের মাঝামাঝি মেলা বসে নানান মনিহারি জিনিসপত্তর নিয়ে, কিন্তু হাতে নগদ খুচরো পয়সা কিছুই নেই। সারাদিন মাঠের কাজের পরে রাতে শরীর এলিয়ে দিতেই কেমন ল্যাদোস ল্যাদোস করে শরীর। শরীর জুড়ে তখন মাটির গন্ধ ম-ম করে, আলের ফালি জলে মাছ ঘুনীতে ফেঁসে গিয়ে চিড়িক চিড়িক শব্দ করে। ইচ্ছাটা জাগলেই গণেশের মা চাঁদ টেনে আনে শরীরে, ম্লান চাঁদের আলোতে কুয়োতলায় শামুক চেটে দেয় শ্যাওলা, গণেশের মা, শীতল মাটির কলসির পাশে সরে গিয়ে, বলে এইদিকে আয় গণেশের বাপ। 

গণেশ কোথায় গেছে রে ?

কুপি নিয়ে গেছে আলের ধারে, দুধ পারসে খুঁজতে।

কার পায়ের শব্দ না ?

ও তোর ভুল। জেগে থাকলে বড় ভুল শব্দ শুনিস। সাথে তোর জোগাড় আছে ?

না উপায় সাথে নাই। কুমড়োর ফুল আর ডগা বিক্কির করলে কিছু খুচরা থাকে। দেখি, আমিনুল আসবে কাল। খবর দিয়ে রেখেছে মিসকিন।


গণেশের মা পালুর বুকে মাথা রেখে ঠোঁট ঘষটায়। বলে,- রবারে সেদিন লজেন্সের গন্ধ ছেল।


সে অনেক দাম। আর যেতে হবে ঈশ্বরপুরে। এখানে এসব পাওয়া যায় না।


পালু ভাবে কুমড়োর ফুল আর কুমড়োর ডগা, আমিনুল এলে যদি নগদ কিছু, কিন্তু মিসকিন ভবিষ্যতের লাভের জন্য পালুকে নিষেধ করতে বলেছে।


আবার সেই ফুলটি হাত দিতে গেল পালু। আশ্চর্য ফুলটি এবারও খিল খিল করে হেসে উঠল। এবারে হাসির শব্দ অন্যরকম শোনালো! অনেকটা যুবতী কন্যার মতো। কে জানে কোথাও লুকিয়ে লুকিয়ে ছলনা করছে কি না ? আবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল পালু। না কেউ কোথাও তো নেই ? তাহলে ? কেউ কোথাও নেই। আবার যেই না হাত বাড়িয়েছে পুনরায় সেই হাসি।

আহা কি মিষ্টি হাসির শব্দ। একেবারে প্রাণবন্ত যুবতী যে।

কে ? কে ? এইখানে কি করছ? কে তুই?

আবার সেই খিল খিল হাসির শব্দ।  

এবার স্বর যতটা উঁচিয়ে পালু চেল্লাল,- এই কে তুই ?


কুমড়ো গাছের লতানো অন্ধকার থেকে কাঁটা ফুলিয়ে ছুটে গেল ধূসর গঠনের সইজ্জা। একেবারে গর্ভবতী সজারু। মাঠের আশেপাশে কয়েকটা থাকে। তাড়া করলে কাঁটা ফুলিয়ে খাগের বাঁশির মতন শব্দ করে। সেই শব্দ আতঙ্কের । পালু তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ ফুলটির দিকে। চোতের বেলা গড়িয়ে আসছে, রোদ মাথার ওপরে লম্বা দাঁড়িয়ে গেছে। মাঠ ঘিরে অনেক গল্পগাছা ছড়িয়ে আছে সেই আদিকাল থেকে। সে বড় নানারকমের কথা, নানান অপদেবতার কথা। বছর বছর ফি বছর মাঠে কাজ করেছে পালু, বছর বছর মাঠ বানিয়েছে। ধানের সময় একরকম, আলু চাষের সময় তুলো তুলো, লঙ্কার চাষের সময় অন্যরকম। আবার কুমড়ো চাষের সময় গায়ে গতরে না খাটলেও চলে। ফেলে ছড়িয়ে মাঠ বানালেই হল। একটু যত্নের দৃষ্টি দিলেই ফলন নিজের মতন জল আলো বাতাসের সাথে গড়িয়ে যাবে।


পালু কি করবে তাই ভাবছিল। এ তো মহাজ্বালা। দক্ষিণপূর্ব ওইদিকেই নেতাই সামন্ত আর গাজি সাহেবের জমি, তারপরে দাড়িপাল্লাবাজ হড়কা মণ্ডলের খাস চার বিঘে। তারপরে কানাফালির ঝোপঝাড় অতিক্রম। ভারি বৃষ্টি হলে গ্রামের সব মানুষকে আয়তনে খাটো করে দেয়।


আমিনুল মাঠে এলে একবারে শেষে গাজি সাহেবের জমি ছুঁয়ে আসে। সপ্তাহকালীন নুপাইয়ের হাটে যাওয়ার আগে পালুর জমি ছুঁয়ে যাবেই। আমিনুল ফিরে ফিরে দেখছিল। পালুর দুই পা ভারি হয়ে আসছিল।  যুবতী কুমড়ো ফুলের হাসির শব্দ তাকে ক্রমশ বিরক্ত করে যাচ্ছিল। এই মাঠ দুনিয়ায় পালুই একমাত্র চাষি কুমড়ো ফুলের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে।


পালু অনেকক্ষণ আমিনুলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকল। ঠিক সেই ফুলটির পাশে। এ বড়ই বিড়ম্বনা। এক পা এগিয়ে যেতে পারছে না পিছিয়ে যেতেও পারছে না। আবার হাসির শব্দ শুনতে পাবে বলে, ভয়ে ফুলটির দিকে হাত বাড়াতেও পারছে না। 


অনেকক্ষণ পরে পালু বুঝতে পারল বেলা পড়ে আসছে। দৃষ্টি আটকে গেল আলপথ ধরে গণেশের মা আসছে। তার দিকেই। সর্বনাশ যে। ক্রমশ মাটির গভীরে বসে যাওয়া পা দুটিকে তুলে তুলে হাঁটতে থাকল মন্থর। একটু এগিয়ে যাওয়ার পরে গতিকে সাবলীল করতেই পালু শুনতে পেল কুমড়ো ফুলটি যেন বলল,--

চলে যাচ্ছ ......

আবার আবার সেই খিল খিল হাসির শব্দ।


বড় বড় শহর লাগোয়া ছোটো ছোটো কিছু শহর থাকে। বড় শহরের জন্য সেই ছোটো ছোটো শহরগুলি কেমন নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। আর সেই ছোটো শহরের সীমানা পার হলেই গ্রাম চরাচর বেবাক। এমন একটি শহর থেকেই তিনি আসতেন, আমরা গ্রামের মানুষজন যাকে গল্পজাদু বলে জানত। সচরাচর তিনি আসতেন বসন্তকালের বিকেলের দিকে। গ্রামপথের দুই ধারে তখন পর্যাপ্ত খড়ের গন্ধ পাওয়া যায়। যেদিন তিনি আসতেন মাথায় করে কালো মেঘ নিয়ে আসতেন। কালো মেঘের ছায়ার নিচে তাকে আলোকোজ্জ্বল একটি পিণ্ডের মতো দেখাত।


ফাল্গুন চৈত্র থেকে বৈশাখ পার হয়ে বর্ষার গোঁড়ায় যখন ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামত তখন তার ফিরে যাওয়ার পালা। ওই দ্বীপের মতন ছোটো ছোটো  যে কোনো একটি শহরে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কেউ জানত না তিনি কোন শহরে ফিরে যান।


তিনি এলে বড়ই মজা হয়। প্রাচীন একটি গাছতলায় এসে বসতেন। নানা রকম আড্ডা চিকিৎসার কথা ছাড়াও নানান মজার গল্প করতেন।


পালুর বুক গর্বে ফুলে ওঠে। ভাবে, গল্পজাদুর জাদুর থেকেও সে অনেক বড় বিস্ময় আবিস্কার করে ফেলেছে। কিন্তু কিছুতেই কুমড়ো ফুলের হাসির বিষয়টি খোলসা করে গ্রামবাসীদের বলতে পারছে না।


একদিন পালু জানতে পারল, গল্পজাদুকে তিন চারদিন হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ খোঁজাখুঁজি চলতে থাকল। কিন্তু না কিছুতেই গল্পজাদুকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। একটি কাঠের কুঠুরিতে তিনি থাকতেন। সেখানে একটি তক্তোপোষের ওপরে গায়ের খদ্দরের ময়লা চাদরটি একটি পশুর চামড়ার মতো পড়ে আছে। চাদরটি এমন বিমূর্ত, গ্রামের কেউ সাহস পেল না স্পর্শ করে।


পালুর সন্দেহটি অন্যরকম ছিল। সে ভাবল, কুমড়ো ফুলের আশেপাশে বেশ কয়েকটি কচি কুমড়ো ফলের মধ্যে একটি ফল যেন গল্পজাদু। সে আত্মগোপন করে জানতে চাইছে ফুল কন্যার নানান গলি ঘুপচির রহস্য। কুমড়ো ফলটিকে সন্দেহ করে, পালু গভীরভাবে লক্ষ করতে থাকল। সেই ফুলটিই কুমড়ো ফলটির সাথে বাতাসে দুলে দুলে লদকালদকি করছে। পালুর মনে হল গল্পজাদু বেশ মজা পাচ্ছে এবং খোশগল্প করছে। আসলে সন্দেহজনক মনকে নিজের মতো করে পালু সাজিয়ে নিচ্ছিল। আর সেই ফুল কন্যার মিষ্টি কণ্ঠস্বরটি তাকে ভীষণভাবে হিংসায় আহত করছিল।


ঋতু বদলের দেবতা এ বছর কঠিন দয়ামায়াহীন। প্রতি বছরের মতো ঋতুবদলের দেবতা জল বাতাসের সাথে শীতকাল ও চৈত্রের শেষের কুয়াসা নিয়ে হাজির হয় নি। কাজেই ক্ষেত খামার ও মাঠের হাহাকার অনেকটাই উপেক্ষিত কোনো এক জাত লেখকের ব্যর্থ পাণ্ডুলিপির মতো পড়ে আছে। পালু কুমড়ো ফুল ও ফল তুলে ফেলল না দেখে মাঠের প্রতিবেশী চাষি ভাইরা অবাক হয়ে গেল। রহমত ভাইজান এক ভোরে তাকে জিজ্ঞাসা করল,- চাষের কাজে কি আর মন নাই ? পালু কিছু বলে না, সে জানে কি অসামান্য বিভ্রমের শিকার। ফুল কথা বলছে, পিছু ডাকছে। সন্ধ্যা নেমে গেলে পালুকে বলছে,-- যেও না মাঠ ছেড়ে। অথচ সারাদিন নির্লজ্জের মতো গল্পজাদুর সাথে ঢলাঢলি করছে।    


পালু দেখল মধ্যদুপুরে, ছাতারে পাখির ঝাঁকের মধ্যে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। আর আগুনের লেলিহান শূন্যে সাঁতার কাটছে। পাখিগুলি ওপরে উঠছে আর গোত্তা মেরে মাটি ছুঁয়ে ঠুগরোচ্ছে সমস্বরে চিৎকার করছে। পাখিগুলি যেন অগ্নিস্নান করছে। পালু অবাক হয়ে দেখছিল। কিছুক্ষণ ধরে সে মাঠের ঢিল পাথর আলপথে জমে থাকা সামান্য জলের আয়না দেখে নিজের মধ্যে নিজেকেই এলোমেলো করে, অন্য এক পালুকে খুঁজতে থাকল, আসলে সে যেমন নয় তাকে। খুব কাছে আসতেই নিজের কল্পনায় আকাশে একটি কল্পনা এঁকে হায় হায় করে উঠল। তারপরে নিজের মনেই অজান্তেই বলে উঠল –ভুল...ভুল...ভুল...  


কিছুটা দূরে সে দেখল, মাঠের পাশে আলের ধারে গণেশের মা খড় পুড়িয়ে চায়ের কেটলিতে জল গরম করছে। পালু দৌড়ে গেল তাঁর কাছে। বলে ফেলল,-- ঘরে উনান নাই, মাঠে কেন এই আয়োজন?


গণেশের মা বলতে থাকল,... কানা নদীর মাঝির মেয়ে আমি, কাল দেখলাম আমার বাবা একটি গাছের তলায় বসে ছিল, পাথরের মূর্তির মতো। সেই বেলা না পড়ে যাওয়া পর্যন্ত। তারপরে সজারু হয়ে গেল। আমি মাঠের মধ্যে কেটলিতে জল গরম করতে করতে এক মহাসুখ খুঁজে পাচ্ছি। ভাবনা এমন রে গণেশের বাপ, কখনও শকুন হয়, কাঠবেড়ালি হয়, ঘরের বিছানা লাউ গাছের মাচা হয় আবার কখনও নেউল বা ফেউ। ওই দেখ তোর ভাতের থালা থেকে শিয়াল মাছের পেটি মুখে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোঠার ঘরের দরজা বন্ধ করে দে, ভীষণ কালো মেঘ আসছে, ঝড় আসবে। মৃত্যু এক সাদা আলোয়ানের মতো।


পালু অবাক হয়ে বলল,- আমি তোকে কিছু তো বলি নি। তুই এত সব কেন বলছিস ? খোলা মাঠে তুই দরজা কোথায় দেখছিস?


নে একবার চায়ে চুমুক দে। খড়পোড়া জলের স্বাদ মাঠের মতো সুস্বাদু হয়।


পালু তাকিয়েছিল বিষণ্ণ হয়ে মাঠের ওপারে। বহুদূরে থেকে ভেসে আসছিল ভ্যান রিক্সার ভেঁপু ভেঁপু। বড়ই মায়াবী এই চাষ মাঠের জীবন। এই প্রথম মাঠে কাঠকুটো খড় পুড়িয়ে গণেশের মা কেটলিতে জল গরম করে ,...আহা কী স্বাদ। চায়ের পাতায় সুন্দর স্বাদ বসিয়ে দিয়েছে। পালু কুমড়োর মাঠের দিকে তাকিয়ে সেই কন্যার মতো হেসে ওঠা কুমড়ো ফুলটিকে খুঁজে যেতে থাকল। একটু দূরে মাঠ যেন কুমড়ো গাছের ডগাতে লতানো হয়ে আছে।


আহারে! চমৎকার বিকেল যেন গোগ্রাসে বিকেলের আলো গিলে যাচ্ছে।


গণেশের মা উঠে হাঁটা দিল, সন্ধ্যে হয়ে এল প্রায়। আলোর বদলে নেমে আসছে ধূসর। গণেশের মা যেন রণপায়ে হেঁটে যাচ্ছে। দ্রুতগতিতে হেঁটে গেল, সেই কুমড়ো ফুলটির কাছে। হাত বাড়িয়ে কুমড়ো ফুলটিকে তুলে নিয়ে পালুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে,-- বেশ ফুল রে গণেশের বাপ। বেসনে চুবিয়ে নিলে তেল চপচপ করে ভেজে নিলে সর্ষের তেলে পাতে খাসা গরস হবে।


পালু অবাক হয়ে তাকিয়ে। বাধা দেওয়ার আগে ঘটে গেল, কল্পনাতীত এক বিভ্রম। নিজের অজান্তেই যন্ত্রণায় গঙ্গিয়ে,-- আহা রে গণেশের মা এটা কি করলি তুই?

কুমড়ো ফুল বেসনে চুবিয়ে জিভে স্বাদ অনেকদিন নিই নাই গণেশের বাপ।

তুই যা। আমি এখন বাসায় যাব না।

কোথায় যাবি ?

মাঠে থাকব।


সেই রাতে পালু আর বাড়িতে ফেরে নাই। সারারাত ধরে প্রহরের পরে প্রহর ধরে শিয়ালের মতো ডেকে চলল। আর মরাকান্না কেঁদে কেঁদে ভোররাত্রে কুয়াসার চাদরে আত্মহনন করল। গণেশের মা পাশ ফিরে এপাশ ওপাশ করতে থাকল। নাকের কাছে কল্পনায় গনগনে উনুনের আঁচে বেসনে চোবানো কুমড়ো ফুলভাজার গন্ধ নিতে নিতে উনানের জিভ মাটি দিয়ে লেপে লেপে তক্তপোষ থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল।



Comments

  1. এমন মহৎ কল্পনা একমাত্র শুভংকর গুহই করতে পারেন।

    ReplyDelete
  2. অদ্ভুত লেখা, অদ্ভুত কল্পনা। দু'এক জায়গায় যতি চিহ্নের সমস্যা মনে হল। "পালু কি করবে তাই ভাবছিল" এখানে 'কী'হবে মনে হয়। "বৈশাখ পার হয়ে বর্ষার গোঁড়ায় যখন ঝমঝম..." এটা গোড়ায় হওয়া উচিত, অবিশ্যি 'গোঁড়া' হলে অন্য অর্থ তৈরি হয়, কিন্তু সেটাই অভিপ্রেত কিনা পরিষ্কার নয়।

    ReplyDelete
  3. অনবদ্য গল্প। এইরকমই তো গল্প হওয়া উচিৎ। পরতে পরতে কল্পস্রোত। অভিভূত হয়ে গেলাম।

    ReplyDelete
  4. কৌশিক জোয়ারদারJuly 16, 2020 at 9:39 AM

    আশ্চর্য গল্প! খুন হয়ে গেলাম।

    ReplyDelete
  5. অসামান্য সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete
  6. অন্য স্বাদের অনবদ্য গল্প। এমন গল্পই কল্পনার ক্ষেত্র বাড়িয়ে দেয়।

    ReplyDelete
  7. বাস্তবের মাটি থেকে কল্পলোকে এক অনবদ্য লাফ।ম
    ধন্যবাদ শুভঙ্কর।

    ReplyDelete
  8. বাস্তবের মাটি থেকে কল্পলোকে এক অনবদ্য লাফ। ধন্যবাদ শুভঙ্কর ।
    -প্রবুদ্ধ মিত্র

    ReplyDelete

Post a Comment