রম্যরচনা - সুনৃতা মাইতি



সং - সার


"বলি...ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত না করলে আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না।"
-বলেই  সুলগ্না পড়ার টেবিলে ঝুঁকে পড়ল। সে সবেধন নীলমণি পুত্ররত্নটিকে পড়াতে বসেছে বটে কিন্তু "ব্যাপারটা" সংশ্লিষ্ট মুদ্দা থেকে নড়ছে না কোনোমতেই। সে গেরস্থালির হাজার চাপেও না; বিদ্যারত্নটির জ্ঞানবর্ধনকালেও না। ডিভানের ওপর বসা সাত্যকির বডিখানি নিউজপেপারের আড়ালে চিরাচরিত উদ্ভিদীয় ভঙ্গিমায় নিথর ছিল। মানে যতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে থাকা যায় আর কি! কিন্তু সম্ভবত আর সেটা সম্ভব নয়। তার ওপর আজ আবার রবিবার।


অতএব সাত্যকি কুশনে হেলান দিয়ে গলাটি কিঞ্চিৎ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করে ...

 "হালদার বাবুর ছোট ছেলের বউটি নাকি পালিয়ে গেছে গো?" 


সুলগ্না ছেলে পড়াতে বসলে ভয়ংকর গম্ভীর হয়ে থাকে। কিন্তু এইরকম একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরে চুপ করে থাকা যায় না। তাই কলম নিযুক্ত পুত্রের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে  এবং স্বীয় গম্ভীরতা বজায় রেখেই সে বলে ওঠে ....

"হুম্! ওই জিম ইনস্ট্রাকটরের  সাথে । "

"হারুদার জিমের ওই চিকনা ইনস্ট্রাকটরটা তো?"

 সাত্যকি আবার শুধোয়। তার গলায় ভয়ানক কৌতুহল ।

সুলগ্না ছেলে পড়ানোয় নিমজ্জমান অবস্থাতেই মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ বাচক ঝাঁকুনি। তা ভালো! সাত্যকি আড়মোড়া ভেঙে এইবেলা পেপার থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তিন চার ঘন্টা অনায়াসে খবরের কাগজের ভেতর থেকে যেতে পারে বটে; কিন্তু কাগজগুলো ভাঁজে ভাঁজে পরিপাটি করে রাখবার প্রচেষ্টা সে কস্মিনকালেও করেনি। অতএব কাগজগুলো "আমার খোকা ভারী ছেলেমানুষ" স্টাইলে  কোনক্রমে জড়ো করে ওপরে একটা অ্যাশ-ট্রে চাপিয়ে সেমোটামুটি কার্যোদ্ধার করে এনেইছিল; এমন সময় সুলগ্নার কাকচিল খেদানো অমাইক গলা তেড়ে ফুঁড়ে উঠল।

"তবে রে বদের ধাড়ি! এটা কি লিখেছিস রে !"

কিছু পরে বোঝা গেল দোষের মধ্যে পুত্র এই মাত্র একখানি সমাসের নিজস্বীকরণ করেছে। আহারে! বাচ্চা বলে কি সে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে পড়াশুনা করতে পারেনা! অবশ্য এই রকম ক্রিয়া সে হামেশাই করে থাকে এবং ফলশ্রুতিতে নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্রের ফলিত প্রয়োগ অনুসারে মায়ের হাতের কিল-চড় ইত্যাদি খায়। এই যেমন দম্পতির  সমাসে সে লিখেছে "পতির দম। ষষ্ঠী তৎপুরুষ। কি আর এমন ভুল লিখেছে! সেই দিনই তো "নানি দা ধাবায়" গিয়ে সবাই মিলে দম আলু আর তন্দুরি রুটি খেয়ে আসা হলো। তা "দম আলু" যদি আলুর দম হয় তাহলে দম্পতি  "পতির দম" নয় কেন! অকাট্য যুক্তি। 

"ইয়ে সমাস টমাস নিয়ে অত কাঁপাকাঁপি করে লাভ আছে কি? বলি, বাংলার কি আর সেই দিন আছে!" 

গলা ঝেড়ে সাত্যকি তার সুচিন্তিত মতামত জানায়। কিন্তু তার বক্তব্য এখানেই শেষ হয়নি বোঝা যাচ্ছে। আবার গলাখাঁকাড়ি দিয়ে সে শুরু করে...

"বলি এইসব পড়ানোর ফাঁকেটাকে একটু ব্যায়াম ট্যায়াম করলেও তো পারো। চাপ কমে আর কি!"

শোনা মাত্র সুলগ্না মাথা তুলে তাকাল।  বিপদ বুঝে সাত্যকি এবার স্বর খানিক মোলায়েম করে ....

"মানে...  কি সুন্দর ফিগার ছিল তোমার ...মানে  ওই জিম টিম করলে যদি আবার ....হে    হে...সেই রকম.."

সুলগ্নার দৃষ্টি কঠোর এবং স্থির। সেদিকে তাকিয়ে  সাত্যকি  অতি মৃদু স্বরে বলে ....

"মানে আমি তো তোমার  ভালোই ...."

কিন্তু সাত্যকির কথা শেষ হতে পারেনা । তার আগেই একটি গর্জনকারী চল্লিশি কন্ঠস্বর তীব্র  হয়ে ওঠে..

"সংসারের জোয়াল ঠেলতে ঠেলতে সবই তো গেছে, তার আবার ফিগার! নাচ ,গান, ছবি আঁকা সওব। শ্বশুরবাড়ী এসে পদে পদে হ্যাটা খেলাম। এখন বাকি আছে ওই  চরিত্তিরধারী হারুর  জিমে ফস্টিনস্টি করতে যাওয়া ..ছিঃ..তা অতই যদি আমার ভালো চাও... সেই ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত হচ্ছে না কেন ??...."

এই হচ্ছে সুলগ্না। যতই এদিক-ওদিক  কথা ঘোরাও না কেন; আসলি মুদদা থেকে সে সরে না। নাঃ এবার এটা নিয়ে কুণালের সাথে কথা বলতেই হবে।


সেই বহুচর্চিত "ব্যাপারটা" অবশ্য খুব একটা সোজা সাপটা নয়। বলতে গেলে ছোটখাটো একটা মহাভারত। সাত্যকি এবং কুণাল, বহুদিনের দুই বন্ধু, প্রচুর খোঁজাখুঁজির পর বাইপাসের কাছাকাছি মাঝারি মাপের একটি আবাসনে ফ্ল্যাট কিনেছে; সেখানেই বসবাস আরম্ভ করেছে; এবং দুই ভালো মানুষের পোয়ের আশা অনুযায়ী তাদের নিজ নিজ স্ত্রীরাও শুরুর দিকে পরস্পর পরস্পরের প্রতি অসীম প্রেম প্রদর্শনপূর্বক একটি অটুট রিস্তা স্থাপনে সদা নিয়োজিত হয়েছে। গন্ডগোলটা বাঁধলো ঠিক দুই বছরের মাথায়। উভয় স্ত্রীর মধ্যকার এই পারস্পারিক সৌহার্দ্য  যাকে "বাটাবাটি" অর্থাৎ "বাটিতে বাটিতে আদানপ্রদান করে যে ঘনিষ্ঠতা" বলা যেতে পারে  তা মাোটের উপর টিকলো না। উপরন্তু প্রতিদিনই প্রায় দুই গৃহকর্ত্রীর মধ্যে কিছু না কিছু মনোমালিন্যের  সৃষ্টি হতেই থাকল। এর ফলে যা হবার তাই হলো।  দুই রানীর মহাযুদ্ধে  অপর দুই উলুখাগড়ার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।


তবে এটা  যেন হবারই ছিল। সাত্যকির স্ত্রী সুলগ্না মানেই বড় লালচে মেরুন টিপ, জাঙ্ক জুয়েলারি এবং হ্যান্ডলুম শাড়ি। এদিকে কুণালের বউ অদিতি কিন্তু  জিম্স, টপ এবং হিরের পেনড্যান্ট।  সুলগ্না পোস্ত, লাবড়া, মাছের ঝোল তো অদিতি চিকেন স্টু স্যালাড এবং ভেটকি ফ্রাই। সুলগ্না বড়বাজার গড়িয়াহাট;  তো অদিতি অনলাইন শপিং। এত বৈপরীত্য নিয়ে দুজনকার এই পিরিত এতদিন টিঁকেছিল কি করে সেটাই সকলের কাছে আশ্চর্যের  লাগতে লাগলো ক্রমশ! তবুও গাড়ি চলছিল। বাদ সাধল একই অফিসে দিবারাত্র একই প্রোডাক্টের সেল এবং টারগেটের ভ্যানতারা কষা সত্বেও দুজনের জীবনচর্যার আমুল ফারাক।


তা সেটা সুলগ্নার  চোখে পড়লেই দোষ! এটা কি খুব অস্বাভাবিক! সুলগ্না কি দেখতে পায়না যে  অদিতি সারাদিন শুয়ে-বসে কাটায়। সারাদিন হয় মোবাইলে কেনাকাটা নয় হোয়াটসঅ্যাপে খুনসুটি। রান্না কিংবা ঘরকন্নার কোন কাজেই হাত লাগায়না। ওর রান্নার মহিলাটি পর্যন্ত চূড়ান্ত কেতবাজ। পরমাদি পাঁচ বাড়ী রান্না করেন বটে; কিন্তু সঙ্গে সবসময় থাকে একটি স্লিক স্মার্টফোন। কোনও রেসিপিতে আটকে গেলে তিনি তৎক্ষণাৎ গুগল করে নেন।  তার ওপর  অদিতির মেয়েটা কি বাধ্য! নিজের পড়া নিজেই পড়ে নেয়। কি ভাগ্য অদিতির। এসব দেখলে গা জ্বালা করে কিনা? তা দোষের মধ্যে সুলগ্না একদিন মুখ ফসকে না হয় বলেই ফেলেছিল ....

"কুণালদার মতো মানুষ হয় না রে; বিনা প্রশ্নে হাসিমুখে তোর মতো একটা নিষ্কর্মা সাদা হাতি কে পুষেই চলেছে বেচারা !!" 


এটাই হল গিয়ে অফিসিয়াল ঝামেলার শুরু। খুব কি ভুল বলেছে সে? সত্যি কথার কোন মূল্য নেই বাবা আজকের দিনে। এত সামান্য কথাতেই সেন্টি!  তা অদিতিই  কি চুপচাপ বসে থাকল? মাঝখান থেকে সুলগ্নার বিশ্বাসী কাজের মেয়েটিকে দিল কান ভাঙ্গিয়ে। সে কান পাতলাও দিল কাজ ছেড়ে। এর উপর আবার ফাইভের ডির পরচর্চা প্রিয় মাসিমাকে সুলগ্নার একগাদা  রসালো গুপ্ত খবর দিয়ে এল। আর পাতে পড়তে না পড়তেই আগুনের মতো সেগুলো ছড়িয়ে গেল আবাসনের এ থেকে ডি পর্যন্ত।  বিশ্বাসের মূল্য এই? অনেক হয়েছে। এইবার সবকিছুর হেস্তনেস্ত করা কি উচিত নয়! এই রকম পারিবারিক বন্ধুর দরকার নেই। সাত্যকি এবং কুণালের পিরিতের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতেই  সুলগ্না দম নেবে।


একই আবাসনের অন্য একটি ফ্ল্যাটে এই মহাযুদ্ধের আরেকটি অধ্যায় রচিত হচ্ছিল। রবিবার হলেই কুণাল একটু টিভি দেখে থাকে। জ্যাকলিন তার বড় প্রিয় নায়িকা। তা সেই মেয়ে, সকাল সকালই  টিভির ভেতরে গান গাইতে গাইতে সবেমাত্র ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে ডান্ডা পেঁচিয়ে নিচে নামতে যাবে; অদিতি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে আরম্ভ করলো। সঙ্গে  ভাঙ্গা ভাঙ্গা কিছু কথা। 

"আমি সাদা হাতি! নিষ্কর্মা! আমার মতন বউ যেন না হয় কারোর! ছিঃ! ছিঃ! সারাজীবন আমি যে ফ্যামিলির জন্য এত স্যাক্রিফাইস করেছি; চাকরি, কেরিয়ার সব ছেড়ে দিয়েছি সেটা তো কেউ দেখল না। মুখের ওপর যা নয় তাই বলে দিল! কি আনপলিসড রে বাবা! আর কি লাউড! তার ওপর আবার  হিংসুটে। কারোর ভালো দুচোখে  দেখতে পারে না।"


এইসব দুর্যোগপূর্ণ আবহের মধ্যেও কুনালের চোখ  অত্যল্পবসনা জ্যাকলিন থেকে সরছিলই না। সে দিকে তাকিয়েই  রাগত অদিতি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পৌঁছে কুনালের চৌদ্দগুষ্টির ষষ্ঠী পুজো আরম্ভ করবার একটি অতি সাধু উদ্যোগ নিল।


এই যেমন দু হাজার পাঁচে কুণালের মা অদিতির কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিল; দু হাজার বারোতে কুণালের দিদি অদিতির পিছনে কোন এঁড়ে গরু লেলিয়ে দিয়েছিল; এবং কুণালের বৌদি প্রায় প্রতিবছরই কখন ও কিভাবে অদিতির বাড়া ভাতে ছাই দেবার চেষ্টা করে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই কুনাল কিভাবে নীরব এবং নিষ্ক্রিয় থাকে। সাথে সাল তারিখ এবং সময়ের নির্ভুল নির্ঘণ্ট। যে কেউ শুনলে অদিতির ইতিহাস বোধের তারিফ না করে পারবে না। যেন হেরোডোটাস এর স্ত্রী লিঙ্গ। 


কিন্তু অদিতি থামবেনা। তার হৃদয়ের মধ্যে ফুটন্ত লাভা সহ একটি ভিসুভিয়াস গর্জাচ্ছে।  কুণালের একটুও ইয়ে নেই! এখনো সাত্যকি সাত্যকি  করে যাচ্ছে! এই যে সুলগ্না তার সামনে পা নাচিয়ে নাচিয়ে এত বড় একটা কথা বলল তাতে সাত্যকি কি একটুও লজ্জা পেয়েছিল?  একটুও না। তা অদিতি অবশ্য দুই একটা খুচরো প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তা সুলগ্নার ওই ভয়ংকর  কথাগুলোর কাছে কিছুই না। সেদিন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও অদিতি  কথাগুলো ভোলেনি। এখন সারাদিন ওগুলো ভাবতে ভাবতেই তার সুগার, প্রেসার এসব বিগড়ে গেলে সাত্যকি সুলগ্নার কিছু যাবে আসবে? কিস্যু না। অমন মুখোশধারী বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। অতএব সে ফতোয়া দেয়..

"তুমি কিন্তু আজ রাতের মধ্যেই এর ফয়সালা করবে । । কাল থেকে সব সম্পর্ক শেষ।"

" ইয়ে....এতদিনের বন্ধুত্ব।" 

টেলিভিশন বন্ধ করে হতোদ্যম  কুনাল মিনমিন করে ওঠে। তারপর কি ভেবে চুপ করে যায়।  নাঃ,কথা তাকে বলতেই হবে। শত হলেও সংসার এবং স্ত্রী সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাই হোক। লাস্ট ডে অফ পম্পেই। বন্ধুত্বের ইতি!


সন্ধ্যা ঢলেছে সবে। তীব্র যৌবনা বর্ষামেঘের আড়ালে লুকোনো ডুন্ডুভ চাঁদের ঢেমনা আলোয় আবছা চরাচর। সেই ম্লান আলোকে সাক্ষী রেখে আবাসনের ছাদে মুখোমুখি দুই বন্ধু। আজ কি তারা দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ? এমন সময় ভ্যাপসা চাদর হটিয়ে কোনও এক ফিচেল বৃষ্টিবাতাস লুকোচুরি খেলতে খেলতে নগর কলকাতার  ইটকাঠের ফাঁক ফোকড় গলে বুঝিবা পথ ভুলে এসে পৌঁছে গেল এই ছাদে।


কিছু পরেই দেখা যায় দুই ছায়ামূর্তি ছাদের মেঝেতে বসে গলা জড়িয়ে প্রাণের আলাপ শুরু করেছে। সামনে কিছু পেটমোটা এবং লম্বাটে আকৃতির বোতল ইতিউতি গড়গড়ায়মান। যুগল ছায়ামূর্তির মধ্যে একজন জড়ানো গলায় বলে ওঠে....

"হেস্তনেস্তটা একটু পরেই করি কেমন? এখন একটু  কথা বলি চ...সুখদুখের; বেচাকেনার আর ওই ফাইভ সির ডবকা বৌদির ...."

অপর ছায়াশরীর খানিক দার্শনিক। বিষয়বস্তুকে তাত্ত্বিক রূপ দেওয়া তার আজন্মের স্বভাব। সেও কিঞ্চিৎ মাখো মাখো গলায় মতামত দেয়....

"একে কি বলে বলত?  ডিভাইডেড বাই ওয়াইফ; ইউনাইটেড বাই ওয়াইন।"



Comments