বইকথা - সুবীর সরকার


সময়ের উল্টোস্রোতে সাঁতার শিখিনি

 

‘কুমোরটুলির দেবদেবীর মুখের ছাঁচে মৃতমুখ

এ মুখে ঘাম নেই

ব্রণ নেই

ভাঁজ নেই

আগ্নেয়গিরির উড়ন্ত ছাই ভাসিয়েছে মানবতাকে’


মাননীয় পাঠক, এই কবিতাটি লিখেছেন তরুণ কবি নীলাদ্রি দেব। পুরো কবিতাটির শরীর জুড়ে দানা দানা সময়ের ভাষ্য ছড়িয়ে আছে। সেই ভাষ্যের ভেতর সময়াতীতের এক অনন্ত নিয়ে ঢুকেই পড়তে হয় পাঠককে।


নীলাদ্রি দেবের প্রথম কবিতার বই- ‘ধুলো ঝাড়ছি LIVE’ ২০১৬ তে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি সেই বইয়ের প্রথম কবিতা। ২০২০ তে নুতন করে আবার ‘আলোপৃথিবী’ প্রকাশনা থেকে সেই বইটি আবারও পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। 

শুরুর কবিতাটি পাঠ করেই আমরা বুঝে ফেলি সেই ২০১৬ তেই নীলাদ্রি দেব বুঝিয়ে দিয়েছিল, সে বাংলা কবিতা লিখতেই; বাংলা কবিতাতে থাকতেই এসেছে। আজ নীলাদ্রির পাঠকেরা সেটা নিশ্চিতই বুঝে গেছেন।


১২ টি কবিতায় সাজানো এই বইটির প্রতীকি ও নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন শ্রীহরি দত্ত।


১২ টি কবিতা থেকে ১২ টি মহাসড়ক বেরিয়ে আসে আর পৌঁছতে থাকে জন্ম ও মরণের দিকে। অনন্ত জিজ্ঞাসা আর যাপনের তাড়না কবিকে ধাওয়া করতে থাকে। কবি তার সামগ্রিকতাকে প্রশ্নে প্রশ্নে বিক্ষত করতে থাকেন। কি এক অস্থিরতা তাকে বুঝি ঘোরের ভেতর ডুবিয়ে মারে।

নষ্টালজিক যুক্তিফাটল দিয়ে নীলাদ্রি পাথর ঠুকতে ঠুকতে আদিম হয়ে ওঠেন।আর লিখে ফেলেন-


‘হাজার বছরের কান্নায় নদী

সে নদীর তীরে,শ্মশানে

        আমার অস্তিত্বের ছাই

কপালে লেপে রাখি

জলে ছায়া ফেলে দেখি

          অ-পূর্বপুরুষ’

কেমন হিম হয়ে উঠি।শিউরে উঠি।


এক নুতন ভাষায় কবি কথা বলছেন।এক চিরায়ত বোধের ধরাছোঁয়ার খেলা।

কবি লিখছেন-


‘এ হৃদয় এখন পরিযায়ী’

অথচ-

‘সময় বাঁচাতে পারেনি

বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর

   খুঁজে পায়নি আমাকে জীবিত

এখন লাশ

লাশের ভবিষ্যত টানে পরিবার

যদিও পরিবারও একদিন লাশ

 

সময়ের উল্টোস্রোতে সাঁতার শিখিনি’


প্রথম প্রকাশের সময় নীলাদ্রির বয়স ছিল ১৯ বা ২০। আমি বিষ্মিত হই, কি প্রখর সেই বয়সেই নীলাদ্রির দেখা, অনুভূতি আর গূঢ বাস্তবতা মোড়ানো প্যাশনেট। যাপনকথাকে সংহত করে এনে কথাটুকরোর যাদুতে মুড়ে সে বলে ওঠে-


‘প্রেম তলিয়ে যাচ্ছে ডাস্টবিনে

ডিপ ফ্রিজে শক্ত হচ্ছে স্বপ্ন

কর্মব্যস্ত দিনে আধঘন্টা সময় খাচ্ছে

             ধর্ষণ সংবাদ’


বাস্তবকে তুলে আনা।উপস্থাপিত করা। এও তো কবির দায়। অবশ্য একজন কবির কি আদৌ কোন দায় থাকে!


কবি তো অভিশপ্ত। নির্বাসিত অতিথি মাত্র। কাদা হয়ে শুয়ে থাকতে হয় কবিকে ড্রেনের ধারে। 

যেমন নীলাদ্রি!তিনি অকপটে লিখলেন-

 

‘মৃত্যু পরোয়ানা চাই

ট্যাগ লাগাচ্ছি দেহে’


যে সময়ে তার জীবনযাপন, যে দেশকালের ভুবনে তাকে বেঁচে থাকতে হয়, যে সমস্ত সাদা ও কালোর মধ্যে তাকে পেরোতে হয় প্রতিদিন; সেই অতিক্রমণের পরতে পরতে সংশয়, ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা কবিকে অস্থির করে তোলে, তিনি বিপন্ন হন আর ঘুম কিংবা ঘুমহীনতায় লিখে ফেলতে থাকেন, ঘন হয়ে ওঠা তীব্র এক ডিলিরিয়ামের ভেতর-


১।

‘এটিএম মেশিনের ভেতর আমাদের গ্রে ম্যাটার

সৎকারের জন্য লাইন দিয়েছে দালাল’


২।

‘অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে

    যাবতীয় অস্তিত্ব সংকট

কোনওরকম রঞ্জক দাগ কাটে না আর

তবুও শুধুই উদযাপন’?


৩।

‘রাত হয়ে এল

পরজন্মে জোনাকি হব’


তার শব্দব্যবহার, তার বুননের ম্যাজিক, তার অদ্ভূত মায়াবিন্যাস আর সঠিকভাবে থেমে যাওয়া নীলাদ্রিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। সে তার চলবার রাস্তাটা তার হাঁটবার পথটা ঠিক খুঁজে নিচ্ছেন। 

সুররিয়াল কবির মতন কখনো সে লিখছে-


‘দেহ

মন

দুটোই আমার

ব্যবহার করার ধরণ একান্ত ব্যক্তিগত

কে তুমি, নীতিনির্দেশদাতা’?


বহুরৈখিক যাপনের আলোআন্ধারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কবি নীলাদ্রি এক নুতনের দিকে, ভাষাপুল ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছেন; তার শরীরে পাখির পালক আর জীবন্ত হয়ে থাকা এক নদীর আখ্যান,যা আদতে উপাখ্যানের মতন।


 

ধুলো ঝাড়ছি LIVE

নীলাদ্রি দেব

প্রকাশকঃ আলোপৃথিবী

প্রকাশকালঃ মার্চ-২০২০

প্রচ্ছদঃ শ্রীহরি দত্ত

মূল্যঃ ৩০ টাকা



Comments