প্রবন্ধ - ডঃ সঞ্চিতা দাস



সাঁওতাল জনজীবনে শিশু জন্ম বিষয়ে কিছু আচার


পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশকে বলা হয় উত্তরবঙ্গ।  পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীর বামতীর থেকে উত্তরের বিস্তৃত ভূখণ্ডই উত্তরবঙ্গ নামে খ্যাত। উত্তরের পাহাড়,অরণ্য-ঘন অঞ্চল,নানা ভাষা, নানা জাতি সব মিলিয়ে উত্তরবঙ্গ সত্যি বৈচিত্রময়। এই বৈচিত্র্যময় উত্তরবঙ্গে সাঁওতাল জনজাতির একটি বিশেষ স্থান রয়েছে; এখানকার প্রতিটি জেলাতেই বিক্ষিপ্তভাবে সাঁওতালদের বাস। "সরেন" "টুডু", "কিস্কু", "বেসরা", "বাস্কে", "মুর্মু", হেমব্রম ইত্যাদি পদবিযুক্ত মানুষরা সাঁওতাল বলে পরিচিত। সাঁওতালদের জীবন চর্যায় তাদের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।    সাঁওতালরা মূলত জড়োপাসক, অনেকেই নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেন। অনেকেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে সরে এসেছেন কিন্তু যারা ধর্মান্তরিত হননি তারা এখনও তাদের প্রাচীন রীতি-সংস্কার নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। আমার এই প্রবন্ধে সাঁওতালদের জন্ম বিষয়ে তাদের কিছু রীতি আচারের উল্লেখ করছি।




সাঁওতালদের যেকোনো উৎসব-অনুষ্ঠান শুধুমাত্র পারিবারিক অনুষ্ঠান থাকে না তা হয়ে ওঠে গ্রামের সকলের বৃহত্তর সামাজিক অনুষ্ঠান। গোষ্ঠীবদ্ধ সাঁওতাল জীবনে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, উৎসব-আনন্দ,  পূজা-পার্বণ সবকিছুতেই সকলের অংশগ্রহণ সমান।  যে কোনো উৎসবে যেমন গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য  প্রান্ত পর্যন্ত সকলে আনন্দে মেতে ওঠে মাদলের তালে তালে তেমনি গ্রামে কোন পরিবারে জন্ম বা মৃত্যু হলে সমস্ত গ্রাম একসঙ্গে অশৌচ পালন করে।
 সাঁওতালদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে যে ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো সেই ঘরের চালে লাঠি দিয়ে বা তেমন শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে বেশ জোড়ে জোড়ে শব্দ করা হয়- ভূমিষ্ঠ হয়েই এই ধরনের আওয়াজ শুনলে বাচ্চারা সাহসী হয় এমনটাই তাদের বিশ্বাস।  বাচ্চা প্রসব হবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত গ্রাম অশুচি বলে মানা হয়। নয়, সাত, এগারো  অথবা সুবিধামতো বেজোড় কোনো একদিনে "নিমদা-মান্ডি" অনুষ্ঠান হয়- এ হলো শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান। সাঁওতাল সমাজে ধাইয়ের ভূমিকার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাচ্চা প্রসবের আগে থেকেই "নিমদা-মান্ডি" অনুষ্ঠান পর্যন্ত বাচ্চার সর্ব রকম দায়িত্ব তার। বাচ্চা প্রসবের পর সেই সংবাদ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তার। "নিমদা-মান্ডি" অনুষ্ঠানের দিন ভোর বেলায় ধাই গ্রামের প্রতি বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসে। সেদিন গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মানুষ নবজাতকের বাড়িতে একত্রিত হয়; সেখানে নাপিত থাকে, পুরুষেরা চুল, দাড়ি, নখ কাটায় তারপর সবশেষে বাচ্চার চুল কাটা হয়। পাড়ার মহিলারা একটি পাতা দিয়ে একটি বাটির মত প্রস্তুত করে। একটু চওড়া ধরনের কোনো পাতা,কাঁঠাল পাতা হলেও চলে। এই পাতার বাটিতে নবজাতকের চুল তুলে নিয়ে দলবদ্ধভাবে গ্রামের সকলে মিলে নদীতে যায় এবং চুলসহ পাতার বাটি নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেয় তারপর সকলেই ডুব দিয়ে স্নান করে অনুষ্ঠান বাড়িতে ফিরে আসে। সবাই স্নান করে ফিরে এলে ধাই সকলের হাতে একটু করে সরষের তেল ঢেলে দেয় সবাই সেটা মাথায়- গায়ে-হাতে- পায়ে মাখে। তেল মাখা হয়ে গেলে সকলকে বাটিতে করে তেতোভাত খেতে দেওয়া হয়।  এটা হল আতপ চালের মাড়ভাত; তাতে নিমের পাতা ভেজে গুঁড়ো করে পরিমাণমতো মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাচ্চার নাম উচ্চারণ করে এই ভাত একে একে সবাইকেই খেতে দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় "নিমদা-মান্ডি" অনুষ্ঠান।এই "নিমদা-মান্ডি" অনুষ্ঠানের দিনে বাচ্চার নামকরণ করা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় তা সকলকে অবগত করানো হয়। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই নতুন শিশুটি অশৌচ মুক্ত হয়ে তার নিজের নাম নিয়ে সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই দিনে নবজাতকের অশৌচ মুক্তির  সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ গ্রাম ও অশৌচ মুক্ত হয়।

নাম রাখার বিষয়েও সাঁওতালরা একটা বিশেষ রীতি মেনে চলে।  তা হল যদি কোন পরিবারের প্রথম সন্তান ছেলে হয় তবে বাচ্চার নাম রাখা হবে তার ঠাকুরদাদার নামটি, যদি প্রথম সন্তান মেয়ে হয় তবে রাখা হবে ঠাকুরমার নাম।  দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হলে নাম রাখা হবে দাদুর নাম অর্থাৎ মায়ের বাবার নাম আর দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলে রাখা হবে তার দিদিমার নাম। এর পরও যদি সন্তান হতে থাকে তবে ক্রমান্বয়ে কাকা,  মামা,  পিসি, মাসি এদের নামে নাম রাখা হয়।একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সাঁওতাল সমাজে একটি পরিবারের একই  রকম নাম গুলো বারবার ঘুরেফিরে আসে  বংশপরম্পরায়।




Comments

Post a Comment