গল্প - মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

অলীক পৃথিবী


(১) 

ছাতুবাবু লেনে খোকন দস্তিদারের বাড়িতে একটা ঘর নিয়ে থাকি। সঙ্গে ঘুপচি বাথরুম আর ল্যাট্রিন। একটা তক্তপোষে শুই। মান্ধাতার আমলের ফ্যান চলে। সেই হাওয়ায় গায়ের জ্বালা জুড়োয় না। রানিং ওয়াটার নেই। সামনের টাইমকল থেকে বালতি করে জল এনে স্নান আর শৌচকার্য সারতে হয়।


একটা প্রাইভেট ইন্সুরেন্স অফিসে কাজ করি। দশটা-ছ’টার অফিস। তার বাইরেও কাজ আছে। টার্গেট ফিক্স করা থাকে। মাসে বারোটা পলিসি দিতে হবে কোম্পানিকে। ফলে ছুটির পরও রেহাই মেলে না। রাতে আস্তানায় ফিরে আসার পর শরীরে আর কষ থাকে না। প্রাইভেট কোম্পানি হলে যা হয়, মাইনে যৎসামান্য। তুলে আনা পলিসির প্রিমিয়ামের থেকে সামান্য কমিশন পাওয়া যায়। নিজের খরচ বাঁচিয়ে বাড়িতে খুব বেশি পাঠাতে পারি না।



বাড়ি বলতে মফস্বল শহরে একটা দু’কামরার পলেস্তরা খসা ঘর। বাবা ছিল বাস কনডাক্টর। মারা গেছে। তবে একটা কাজের কাজ করে গেছে। লোন-টোন করে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই করে রেখেছে আমাদের জন্য। সেখানে বিধবা মা আর স্কুলে পড়া ছোটভাই থাকে। সবুজ গাছগাছালি আর বিশাল নীল দিগন্ত ছেড়ে এই ঘিঞ্জি জায়গাটায় এসে আগে দম বন্ধ হয়ে আসত। এখন নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।


আমার কোলিগ সৈকত আমার মত গ্র্যাজুয়েট নয়, ইংরেজিতে মাস্টার্স করা। ফালাকাটায় ওদের কাটা কাপড়ের দোকান আছে। সৈকত একটা স্মার্টফোন কিনেছে এর মধ্যে। অবসর সময়ে আগে আড্ডা দিতাম। ইদানিং সৈকত ফোনের ওপর ঝুঁকে থাকে সর্বক্ষণ। আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, কী করিস ফোন নিয়ে?


সৈকত হেসে বলেছিল, ফেসবুক। আমার অজ্ঞতা দেখে বুঝিয়ে বলেছিল, এটা একটা ভারচুয়াল শহর। অচেনা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব বানাবার সাইট। তুই আমার পুরনো ফোনটা নিয়ে নে। আরে ভয় পাস না, টাকা দিতে হবে না। শুধু নেটপ্যাক ভরতে হবে। আমিই তোর একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছি ফেসবুকে।


আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, থাক রে ভাই। আমার এই মাইনেতে ওসব উটকো শখ পোষাবে না। এ হল বড়লোকের ঘোড়ারোগ।


আমার কাঁধে চাপড় মেরে সৈকত বলেছিল, চাপ নিস না। দু’কাপ চা আর দুটো সিগারেট দিনে কম খেলেই এই খরচটা অ্যাফর্ড করতে পারবি। তাছাড়া শুধু ফেসবুক নয়, গান শুনতে পারবি, ইউ টিউবে ঝক্কাস ঝক্কাস সিনেমাও দেখতে পারবি খুশিমতো।


(২)

সৈকতই একদিন খুলে দিল অ্যাকাউন্ট। হাতে ধরে শিখিয়ে দিল কী করে কী করতে হয়। আমার প্রথম আলাপ হল বেদদ্যুতির সঙ্গে। কবিতা লেখে, কবিতা পড়তে ভালবাসে সে। সদ্য পড়া একটা কবিতার পঙতি পাঠাল আমাকে। কবিতাটির নাম ‘আবাহন’।

‘শব্দে শব্দে গালিচা পেতেছি

গালিচার নিচে লুকোনো হৃদয়

পা রাখতে পারো তবু নির্ভয়।

হৃদয়ে হৃদয়ে সেতুর প্রয়াস

ঝড়ের হাওয়ায় সেতু দোল খায়

পা রাখতে পারো তবু নির্ভয়।

দোলায় দোলায় স্বপ্নের আলো

তারপর কাল – গাঢ় অসময়

পা রাখতে পারো তবু নির্ভয়।‘


কবিতার কিছুই বুঝি না। কিন্তু এই পঙতিগুলির খোলস সরিয়ে খুঁজতে লাগলাম, আমার জন্য বেদদ্যুতি কোন গূঢ় বার্তা পাঠিয়েছে কিনা।


নীলাঞ্জনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম। কলকাতার মেয়ে, কর্মসূত্রে জব্বলপুরে থাকে। একটু একটু করে নীলাঞ্জনার সঙ্গেও সখ্য জমে গেল। অবসর সময়ে গান শোনার খুব শখ নীলাঞ্জনার। একটা পুরনো গানের দু লাইন আমাকে একদিন পাঠাল।

‘Suzanne takes you down to her place near the river

You can hear the boats go by

You can spend the night beside her

And you know that she’s half crazy

But that’s why you want to be there'


গানের লিরিক পড়তে গিয়ে বুকের মধ্যেটা হু হু করে উঠল। হঠাৎ এই গান আমাকে শোনাতে গেল কেন? আমাকে কি তবে ওর কাছের মানুষদের একজন বলে মনে করে নীলাঞ্জনা ?


আত্রেয়ীকে দেখতে পেলাম নীলাঞ্জনার বন্ধুতালিকায়। আত্রেয়ীকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম দুরুদুরু বুকে। দু’দিন বাদে সেটা অ্যাকসেপ্টেড হয়ে গেল। রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। রাক্ষসের প্রাণভোমরা সুরক্ষিত থাকত কৌটোর ভেতর কৌটো, তার ভেতর আর একটা কৌটোর মধ্যে। ফেসবুকেও এক বন্ধুত্বের সুতো ধরে পৌঁছে যাওয়া যায় আর এক বন্ধুত্বের ভেতর। আত্রেয়ী সেদিন জানিয়েছে ওর এক আত্মীয় ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন সাদা রঙের হাজারবুটি নীল শাড়ি। সুদর্শনা আত্রেয়ীকে সেই হাজারবুটি শাড়িতে কেমন দেখাবে ভেবে ভেবে নির্ঘুম রাত কাটালাম আমি।


সপ্তপর্ণীর কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট যেদিন পেলাম, সেদিন অবাক হয়েছিলাম। বালিগঞ্জের সপ্তপর্ণী ভরতনাট্যম আর ওড়িশি শেখে নামী এক গুরুর কাছে। নাচ ওর প্যাশন। নাচ নিয়ে ভবিষ্যতেও অনেক দূর যেতে চায় সে। বাবা সফল ব্যবসায়ী, ওদের বাড়িতে বড় করে রাস উৎসব হয়। রাধাকৃষ্ণর শ্বেতপাথরের বিশাল বিগ্রহ রয়েছে ওদের বাড়িতে। সপ্তপর্ণীদের ফ্ল্যাটের উত্তরদিকে একটা বিরাট পার্ক রয়েছে। ওর জানালার বাইরে তাকালেই চোখে পড়ে শিমুল আর রুদ্রপলাশ। গ্রীষ্মে ফোটা লাল টকটকে বর্ণ তাদের। আছে কিছু সাদা ফুলও। বন-চামেলি আর গন্ধরাজ। প্রতিদিন রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তির জন্য মালা গাঁথে সপ্তপর্ণী।


আত্রেয়ীর প্রোফাইলে উঁকিঝুঁকি মারছিলাম, চোখে পড়ল হর্ষদীপাকে। একবার দেখলে চোখ ফেরানো মুশকিল, এমন রূপসী সেই মেয়ে। বুক ঠুকে পাঠিয়ে দিলাম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। একদিন যায়, দু’দিন যায়, তিনদিন যায়, সাড়া আর আসে না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি যখন, তখন একদিন দেখি হর্ষদীপা আমার ফ্রেন্ডলিস্টে এসে গিয়েছে। ধীরে ধীরে আলাপ হল। ওয়াশিংটন ডিসি-তে তার বাস। মিলান কুন্দেরা থেকে অমিতাভ ঘোষ আর ঝুম্পা লাহিড়ি হয়ে গ্যাব্রিয়েল মার্কেজের বেশিরভাগ বই হর্ষদীপার পড়া। যত দূরেই যাক পাওলো কোয়েলহোর অ্যালকেমিস্ট বইটা নাকি তার ট্র্যাভেলব্যাগে থাকবেই থাকবে।


হর্ষদীপার সূত্র ধরে দিল্লির বাসিন্দা কথার সঙ্গে যন্ত্রমিতালি হল তারপর। চশমার আড়ালে টানাটানা দুটো চোখ, ফর্সা ধবধবে রং, ঘন কালো চুল মেয়েটির। দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন কথার জন্ম হয়েছিল। মা দুর্গার মতোই রূপ পেয়েছে সে। ছবি আঁকা তার প্যাশান। রং তুলি ইজেল নিয়ে দিন কাটে তার। সিনারি আঁকতেই বুঝি বেশি ভালোবাসে সে। বেশির ভাগই নিসর্গের ছবি। একজন শিল্পীর সৃষ্টির ভেতর লুকিয়ে থাকেন শিল্পী নিজে। এমনকী নিসর্গ রচনার ক্ষেত্রেও শিল্পীর মানসলোকের সৌন্দর্য ফুটে ওঠে ছবিতে। গভীর মননদীপ্ত আত্মগত বোধ ফুটে উঠেছে তার আঁকা ছবিগুলোতে। মনে হল কথা নামের এই মেয়েটি যেন অসম্ভব রকম স্নিগ্ধ, গভীর রকম নির্জন।


পুনের একটি গ্রুপ থিয়েটার দলের ডাইরেক্টর লাজবন্তীর সঙ্গে ভাব হল। পুনে শহরে যে নাটক নিয়ে এত মানুষের আগ্রহ আছে সেটা লাজবন্তীর সঙ্গে বন্ধুত্ব না হলে জানাই হত না। ঘাড় অবধি ছোট করে ছাঁটা চুল, গায়ের রং একটু মাজা, কিন্তু অসম্ভব উজ্জ্বল দুটো চোখ লাজবন্তীর। নিজের জীবনবোধ, নিজের জীবনদর্শন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা আছে মেয়েটির। নাটক নিয়ে পড়াশোনা করে, নাটক নিয়ে ভেবে ভেবেই সারাদিন কাটে তার। গতবছর কলকাতায় নাটকের এক উৎসবে নিজের প্রোডাকশান নিয়ে এসেছিল, বেস্ট ডাইরেক্টরের প্রাইজও নিয়ে গিয়েছিল লাজবন্তী।


(৩)

রোজ সকালে ভাত শিকারে বেরিয়ে পড়ি। একসময় বিকেল আসে। তার পর সন্ধে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা ন’টা বেজে যায়। তার পর থেকে আমি অন্য মানুষ। সমস্ত কায়িক আর মানসিক ধকল ভেতরে ভেতরে শুষে যায় নিজে থেকেই। মন আনচান করতে থাকে। সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা আমি সন্ধোবলা নিজেকে হারিয়ে ফেলি এক রঙিন জগতে।


ফেরার পথে গলির মোড়ের দোকানটা থেকে রুটি-সবজি কিনে নিয়ে আসি। তালা খুলে ঘরে ঢুকি। দোতালায় খোকন দস্তিদারের গলা শোনা যায়। মদ খেয়ে এসে বউ পেটানোর অভ্যাস আছে লোকটার। লেদ মেশিন আছে, আরও কী কী সব ব্যবসা আছে খোকন দস্তিদারের। লোকটার পলিটিকাল কানেকশান আছে শুনেছি। বউটার চেল্লামিল্লি শুনেও কেউ যে এগিয়ে আসে না সেটাই তার আসল কারণ। এই নরক গুলজারের মধ্যেই অন্য কোনও এক জগত থেকে সাতজন নারী নেমে আসে আমার কাছে। তাদের ঘ্রাণ পাই। তাদের সঙ্গে প্রায়ান্ধকার ঘরে একা হই আমি। গল্প করি, হাসির কথা বলি, খুনসুটি করি, গভীর গোপন কথাও হয় আমাদের। তাদের উষ্ণ শ্বাস নিজের চোখের পাতায় নিতে নিতে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাই একসময়।


পূবের জানালার ওপরে একটা ভেন্টিলেটর। সেই ফাঁক দিয়ে রোদ এসে চোখে লাগলে ঘুম ভাঙে। দগদগে সিঁদুর কপালে লেপে বালতি হাতে সামনের কলে জল নিতে আসে খোকন দস্তিদারের বউ। শীর্ণ চেহারা, খড়ি ওঠা হাত-পা, চোখাচোখি হলে আবছা হাসে। রাতের অপমান-অত্যাচারের কোনও চিহ্ন লেগে থাকে না বউটার চোখেমুখে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আমার কাগজপত্রে মন দিই। বেঁধে দেওয়া টার্গেটে পৌঁছবার জন্য ছক কষতে থাকি মনে মনে । একটু বাদে টাইমকল থেকে বালতিতে করে জল নিয়ে এসে স্নান সারি একচিলতে বাথরুমে। প্যান্টশার্ট চাপিয়ে বেরোই। রাস্তার দোকানে চা আর রুটি-সবজি খেয়ে পথে নামি সারা দিনের নামে। কোনও ভাতের হোটেলে সেরে নিই দুপুরের আহার। সন্ধে গাঢ় হলে ক্লান্ত গরুর মতো ফিরে আসি নিজের খোঁয়াড়ে।


বেদদ্যুতির ফুলগাছের শখ। ওদের বাড়ির ছাতে অসংখ্য ফুলগাছ। রক্তকরবী, সূর্যমুখী, ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, জিনিয়া। সব গাছ নিজের হাতে পরিচর্যা করে সে।


নীলাঞ্জনার কয়েকটা লাইন এসে জমে থাকে আমার ইনবক্সে। স্পষ্ট দেখতে পাই তাকে। কম্পিউটারের সামনে রিভলভিং চেয়ারে বসে মগজ খাটিয়ে রাইট আপ তৈরি করে নীলাঞ্জনা আর মনে মনে একটা বড় ছুটিতে পাহাড়ে বা সমুদ্রে গিয়ে রিফ্রেশ হয়ে আসার স্বপ্ন দেখে।


আত্রেয়ী সামনে এসে দাঁড়ায়। ফাস্টফুড খেতে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটা। পকেটমানির পুরোটাই আত্রেয়ী উড়িয়ে দেয় কোল্ড কফি আর জাঙ্কফুড খেয়ে খেয়ে।


সপ্তপর্ণীর বাবা-মা মারা গিয়েছেন প্লেন ক্র্যাশে। এখনও চোখ বুঁজলেই মায়ের মুখ থেকে শোনা সেই পাপ্পা বেয়ার আর মাম্মা বেয়ারের বেডটাইম স্টোরিজ শুনতে পায় সপ্তপর্ণী।


ওয়াশিংটনে হর্ষদীপাদের অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক বাইরে চেরি ব্লসম গাছে ফুল ধরেছে থরে থরে। সেই গাছে অনেক পাখি এসে বসে। শালিকগুলো অন্য রকম। বুকের কাছটা মরচে রঙা। লাল টুকটুকে কিছু পাখি আছে, তাদের বলে কার্ডিনাল। গির্জার কার্ডিনালদের মতো লাল ক্লোক পরেছে বলে ভুল হয়।


কথা একটা নিসর্গের ছবি এঁকেছে। পুঞ্জীভূত একরাশ অন্ধকার ধীরে ধীরে আলোর দিকে গিয়েছে। হলুদ আর ধূসর রং মিলেমিশে বিনম্র এক সুরের ঐকতান জাগিয়ে তুলেছে যেন। নিসর্গ রচনায় কি শিল্পীর আত্মমগ্নতার কোনও ভূমিকা থাকে? আমি মনিটরের ওপর দিয়ে আঙুল বুলোই, কথার প্রাণ স্পর্শ করতে চাই সন্তর্পণে।


আমেরিকায় বাঙালি কমিউনিটি আছে প্রচুর। পাপুয়া নিউ গিনিতেও আছে একটা। সেখান থেকে লাজবন্তীর ডাক এসেছে তার প্রোডাকশান নিয়ে যাবার জন্য। সামনের মাসে অতলান্তিক পাড়ি দিচ্ছে লাজবন্তী। পাসপোর্ট আর ভিসা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে সারাদিন। পাপুয়া নিউ গিনির ওখানে অনেক নদী। সেপিক, ফ্লাই, র‍্যামু, মার্কহ্যাম। সেই সব নদী থেকে ভেসে আসা সুবাতাস ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লাজবন্তীকে।


(৪)

অফিস থেকে হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরেছি। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নেটওয়ার্ক নেই। মোড়ের দোকান থেকে রুটি-তড়কা নিয়ে এসেছি। ভেতরে ঢুকে কম ওয়াটের পিএল বাল্বটা জ্বালিয়ে সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে দিলাম। রাতের আহার সারতে সারতে খিস্তি-খাস্তার আওয়াজ পাচ্ছি। বাংলা টেনে এসে লেদ কারখানার মালিক খোকন দস্তিদার বাওয়ালি করছে। হঠাৎ লোডশেডিং হল। সিলিং ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছিল, থেমে গেল ঘূর্ণন। জানালা দিয়ে একটুও হাওয়া আসছে না। গুমোট গরম লাগছে। ঘামতে ঘামতেই মোবাইলের ওপর ঝুঁকে পড়েছি। নেটওয়ার্ক এখনও আসেনি।


চিত হয়ে শুয়ে আছি। বেদদ্যুতি, নীলাঞ্জনা, আত্রেয়ী, সপ্তপর্ণী, হর্ষদীপা, কথা আর লাজবন্তীর নামগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছি আপন মনে। সকলের চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাতজনের প্রত্যেকের নামের প্রথম অক্ষরগুলি সাজিয়ে ফেললাম মনে মনে। এবং কী আশ্চর্য, বে নী আ স হ ক লা হয়ে সেজে উঠল তারা!


ধৈর্যের ফল মিলেছে। অবশেষে পাওয়ার এল। আলো জ্বলে উঠল ঘরে। ঘটাং ঘটাং করে নড়তে শুরু করল সিলিং ফ্যান। সেই সঙ্গে এসে গেছে ফোনের নেটওয়ার্কও। উঠে বসেছি সটান। এতক্ষণ অধৈর্য লাগছিল, এখন আমার মধ্যে আর বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য নেই, একটুও অসহিষ্ণুতা নেই। সারা দিনের এই ঘষটানি, এই দিনগত পাপক্ষয়, প্রতিদিনের এই অপমান আর প্রত্যাখ্যানের কথা এখন আমাকে ভুলিয়ে দিতে চলেছে এক অলীক পৃথিবী।


এই অপরিসর ঘুপচি ঘর থেকে এবার দিতে হবে উড়াল। এই কাদা পাঁক নর্দমার রাজত্ব ছাড়িয়ে পাড়ি দিতে হবে নিজস্ব আকাশে। এক অলৌকিক রামধনুর জলছবি আঁকতে হবে অচেনা দিগন্তে। আমার সস্তার স্মার্টফোনের স্ক্রিনে একটু একটু করে ফুটে উঠবে এক ভার্চুয়াল ভিবজিওর।


Comments

Post a Comment