বই কথা - সুবীর সরকার



কোট এবং আনকোটের ভিতর মাছের ছায়া



রিমি দে। বাংলা কবিতায় একটি স্বতন্ত্র ঘরানা। উত্তর জনপদেই তার জন্ম, যাপন। নিজের মতন করে লড়াই করে আজ কবি হিসেবে রিমি দে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছেন। প্রায় ২২ বছর ধরে আমি রিমির কবিতার মনোযোগী পাঠক। শুধু কবি রিমি দে নন, ’পদ্য’ পত্রিকার সম্পাদক রিমি দেও নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন সম্পাদনায়। ‘পদ্য’ নিজেই আজ একটি ঘরাণা; যেমত কবি রিমি দে। 

‘কালো বেড়াল’। রিমি দের অষ্টম কবিতার বই।প্রকাশকঃ পাঠক। নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন দেবাশিস সাহা। ৪৮ পাতার এই বই আসলে এক ম্যারাথন রেস। কবিতা করিডোরে আলোছায়ার অদ্ভূত এক ধরাছোঁয়ার খেলা! কবি এখানে নিজেকে বারবার ভাঙছেন গড়ছেন দর্পণে নিজেকেই দেখছেন। রিমি বলেন_

‘নাচ কেঁপে ওঠে বেড়ালটির হৃদয়

রুমঝুম গুঁড়ো হয়ে মিহি ভরে দেয়

বেড়ালটি ভাঁজ করে রাখা আছে

আদুরে ন্যাপথলিন আর কিছু

              আবছা রোমশ’



একেবারেই অন্যরকম এক দেখা। জাম্পকাটে দৃশ্য সরে যায়। পাঠককে বুঁদ হয়ে যেতে হয়! এভাবেই ভাবনারা দ্রুতগতির দৌড় শুরু করে_

‘দুটি গল্পের মাঝখানে ছায়াটি দুলতে থাকে

দুটি গল্পেই চরিত্রটি প্রধান

ছায়ার ভিতর তুলসী ও বেলপাতার মর্মর

নাবিকের শেষ স্মিত হাসি

বেড়ালের পদছাপ চাপ চাপ লালের মহিমা’

সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা মনে পড়ে! মিতকথনের সংকেতে রিমি এক মায়াভুবনকে নির্বিকার কুয়াশায় ছড়িয়ে দিতে থাকেন_

‘বেড়াল উপুড় করে লেখা হচ্ছে মাছ

মাছ উপুড় করে লেখা হচ্ছে নদী’

রিমির কবিতা জুড়ে আবহমানতা। দেশকালসময়ের কথ্যভাষা। তিনি পেছনের রাস্তায় গল্পের সারি জন্মাতে দেখেন। আর দেখেন, পাঁচফোড়ন কেমন গাঢ় বাদামী হয়ে উঠছে। রিমি আমাদের দেখাতে শেখান ‘পায়রা ছড়ানোর পর খই ফুটে ওঠে’। রিমি স্বগতোক্তির মতন বিড়বিড় করেন_

‘আমিও খোলা মাঠে উড়িয়ে দিয়েছি হেলে যাওয়া সাপ’

আর তাই তো_

‘দু-টুকরো রিমির জন্য মুরগিটির হলদে হয়ে আসা

ফ্যাকাসে হয়ে পেকে-ওঠা গান’_

বল্লমের ফলায় শিকার বিদ্ধ করা শিকারির মতন কবি রিমি দে তার এই কাব্যগ্রন্থে তার জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। তার মগ্নতা দিয়ে চিরায়ত শোলোকের এক ঘনঘোরের ভিতর পাঠককে টেনে নিচ্ছেন তীব্র ও তুমুল। রিমি কি এক তীব্র জায়মানতা নিয়েই লিখতে থাকেন-

‘চতুষ্কোণের ভিতর বসে আছি আরাম চেয়ারে

কালো বেড়ালের কাছে রাখা আছে হিম ও উত্তাপ’।

কুর্ণিশ রিমি। আপনি বাংলা কবিতার সম্পদ।



Comments