অজানা জীবনানন্দ : তিনটি বিক্ষিপ্ত ভাবনা
'জীবন স্মৃতি' গ্রন্থের এক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'কবিরে পাবে না তার জীবন চরিতে'। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন তাঁর 'অর্ধেক জীবন'।সেক্ষেত্রে যুক্তি হলো ,একজন লেখক বা কবি শিল্পী কখনোই তাঁর সম্পূর্ণ জীবন কথা লিখে যেতে পারেন না। কেন না, জীবন যখন সত্যি মৃত্যু-সমুদ্রের তটরেখায় গিয়ে মিলিত হয়, তখন সেইসব অনুভবের কথা লেখার কোনো অবকাশ থাকে না। কেউ কেউ আবার আত্মজীবনী গ্রন্থে নিজেকে অকপট ভাবে ব্যক্ত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সত্যি কি কবি-লেখকদের সম্পূর্ণ করে জানা যায়? এর উত্তর হ্যা বা না যাই হোক না কেন, কৌতূহলী পাঠক চিরকাল কবি শিল্পীদের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে কবিকেই খুঁজে ফেরে। এই অনুসন্ধান প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠকের মধ্যে চলতে থাকে। তাকে ঘিরে চলে সাহিত্য গবেষণা। আর সেই কবি যদি জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪)মতো আত্মপ্রচার বিমুখ, অন্তর্মুখী কবি হন তাহলে তো এই কৌতূহল আরও বেশী হওয়াই সমীচীন।
জীবনানন্দকে যতটা চর্চা তাঁর জীবিতকালে হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে। এবং এই চর্চার ধারা এখনও বহমান। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী জীবনানন্দ আজও আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে এক বিচিত্র বিস্ময়। বিশেষত তিনি নিজে নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলতে চাইতেন না। আর তাঁর জীবিতাবস্থায় যে পরিমাণ সৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছিল, মৃত্যুর পর তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষত তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলি সবই তাঁর মৃত্যুর পরে বেরিয়েছে। ফলে কবির সম্পর্কে অজস্র কৌতূহলী প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে গেছে। এবং সেসব নিয়ে তাঁর পাঠক গবেষক সমালোচকদের মধ্যে নানা মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে যেটুকু জীবনানন্দ পড়েছি তা থেকে কবি ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে অজস্র বিতর্কের মধ্যে তিনটি বিষয় সম্পর্কে ব্যক্তি আমার ভাবনাকে এই স্বল্প পরিসরের আলোচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গ -১: কবির নায়িকা বনলতা সেন
কবির প্রেয়সীর মধ্যে বাস্তবের নারীকে কৌতূহলী পাঠক সন্ধান করে চলে নিরন্তর। কবিতার নারীর সঙ্গে বাস্তবের নারীর একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করে প্রত্যেকে তাদের নিজের মতো করে। এই সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথের 'মানসসুন্দরী'র সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর যোগসূত্র নিয়ে দীর্ঘ চর্চা -বিতর্ক হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীরা' সম্পর্কের এমন কথা বলা যায়। এরকমই জীবনানন্দ দাশের নায়িকা বনলতা সেন কি বাস্তবের কোনো নারী? এই প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘকাল ধরেই চর্চা হচ্ছে এবং এখনও সেই চর্চা চলছে। কবির 'বনলতা সেন' কাব্যের বিখ্যাত কবিতা 'বনলতা সেন' এর সঙ্গে কবি যেন আজন্মকাল থেকেই অভিন্ন আত্মা ছিলেন। কিন্তু কে এই নারী? যিনি নাম ও পদবী সহ কবিতায় উঠে এসেছেন। এই নারীকে নিয়ে 'বনলতা সেন' শীর্ষক কবিতায় কবি পাঁচবার 'অন্ধকার' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। হাজার বছর পথ পরিক্রমা শেষে কবি বলেছেন,
'থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।' কবিকে পেলে এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যেত। অনেকেই বলেছেন 'বনলতা' কোনো রক্ত মাংসের নারী নয়। ইনি হলেন নাটোরের অরণ্য প্রকৃতি, যার সঙ্গে কবির আমৃত্যু আত্মিক যোগ ছিল। কলকাতায় চলে আসার পরেও তিনি পুনর্জন্ম লাভের মধ্যদিয়ে 'রূপসী বাংলা' তেই জন্মাতে চেয়েছেন। এই নারীকে নিয়ে কবি 'বনলতা সেন' কাব্যের 'হাজার বছর শুধু খেলা করে' কবিতাটি লিখেছেন, যেখানে হাজার বছরের পথ হাঁটার স্মৃতি রয়েছে। এছাড়াও তিনি বনলতাকে নিয়ে সরাসরি আরও তিনটি কবিতা লিখেছিলেন। 'বাঙালি পাঞ্জাবী মারাঠি গুজরাটি', 'একটি পুরোনো কবিতা' এবং 'শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন'। এই শেষ কবিতাটির সঙ্গে 'বনলতা সেন' কবিতাটির একটা বিশেষ সাযুজ্য রয়েছে। এটি যেন প্রথমটির পরিপূরক কবিতা, যার শুরুতেই কবি লিখেছেন,
'শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা।....
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
তুমি নাই বনলতা সেন।'
এই বনলতা সেনের সঙ্গে একজন রক্তমাংসের নারীর বাস্তব সংযোগ ছিল। একথা আমরা অনেক পরে জানতে পারি কবির আত্মজৈবনিক উপন্যাস 'কারুবাসনা' তে। উপন্যাসের নায়ক জানিয়েছে, 'চারিদিকে তাকিয়ে দেখি শুধু মৌসুমীর কাজলঢালা ছায়া। কিশোর বেলায় যে কালো মেয়েটিকে ভালবেসেছিলাম কোন এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙিনার নিকটবর্তিনী ছিল, বহুদিন যাকে হারিয়েছি -আজ সে-ই যেন, পূর্ণ যৌবনে উত্তর আকাশের দিগঙ্গনা সেজে এসেছে।....
সেই বনলতা --আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে।কুড়ি-বাইশ বছর আগের সে এক পৃথিবীতে; বাবার তার লম্বা চেহারা, মাঝ -গড়নের মানুষ -- শাদা দাড়ি, স্নিগ্ধ মুসলমান ফকিরের মত দেখতে, বহুদিন হয় তিনিও এ পৃথিবীতে নেই আর; কত শীতের ভোরের কুয়াশা ও রোদের সঙ্গে জড়িত সেই খড়ের ঘরখানাও নেই তাদের আজ।পনের বছর আগে দেখেছি।....
বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল।দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললে সে।তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল।....
তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
তারপর তাকে আর আমি দেখি নি।'
এই নারী সত্তাই কবি চেতনায় শেষ দিন পর্যন্ত 'বনলতা সেন' হয়েই ছিল হয়তো।
প্রসঙ্গ- ২: অশ্লীল কবিতা লেখার জন্যে চাকরি যায়
'ধূসর পাণ্ডুলিপি' কাব্যের 'ক্যাম্পে' কবিতাটি কবি লিখেছিলেন যাতে অশ্লীলতা ছিল। এবং এরজন্য তাঁর সিটি কলেজের অধ্যাপনার চাকরি চলে গিয়েছিল।এমন অভিযোগ করেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু, যাঁকে কবি তাঁর এই কাব্যটি উত্সর্গ করেছিলেন। কিন্তু এই অভিযোগ ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কারণ কবিতাটি 'পরিচয়' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। আর সিটি কলেজ থেকে কবির চাকরি যায় ১৯২৮ খ্রী। আসলে সিটি কলেজ থেকে কবির চাকরি গিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্যকারণে। কলেজের আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ায় কলেজের অধ্যক্ষ হেরম্ব চন্দ্র মৈত্র কবিকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়েছিলেন এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল হিন্দু-ব্রাহ্ম বিরোধ। সেইসঙ্গে বলা যায় 'ক্যাম্পে' কবিতাটি আদৌ কোনো অশ্লীল কবিতা নয়।এটিতে পি.বি.শেলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কবি লিখেছিলেন,
'আজ এই বিস্ময়ের রাতে
তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;
তাহাদের হৃদয়ের বোন
বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোত্স্নায়--'
এই কবিতার 'হৃদয়ের বোন' অংশটি ছিল সমালোচনার মূল কারণ। প্রসঙ্গত শেলী তাঁর 'Emily' কবিতায় লিখেছিলেন,
"The merry mariners are bold and free/ Say, my 'heart's sister, wilt thou sail with me?"
এই কবিতায় বর্ণিত 'heart's sister (কোথাও কোথাও সেটি "soul's sister" রয়েছে) এর অনুষঙ্গেই কবি 'হৃদয়ের বোন' লিখেছিলেন। আসলে এমিলি কবি শেলীর আপন বোন নন, ছিলেন তাঁর এক অনাত্মীয়া, যার প্রতি কবির 'প্লেটোনিক প্রেম' ছিল। বোনের প্রতি এই প্লেটোনিক প্রেম অনুচিত নয় কোনোভাবেই। এর আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে যা এই স্বল্প পরিসরে আনা গেল না।
প্রসঙ্গ -৩: ট্রাম অ্যাক্সিডেন্ট -এ কবির মৃত্যু
জীবনানন্দ দাশের জীবনের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা এটি। কবি তখন বেশ অসুস্থ। প্রতিদিনের মতোই ১৯৫৪ সালের ১৪ ই অক্টোবর বিকেলে তিনি বেড়াতে বের হন। তাঁর স্ত্রী লাবণ্য তাঁকে বেরোতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কবি শোনেন নি সে কথা। হাঁটতে হাঁটতে তিনি রাস বিহারী অ্যাভিনিউ ও ল্যান্সডাউন রোডের সংযোগস্থলের প্রায় কাছাকাছি এসে দক্ষিণ দিকের ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তা অতিক্রম করবার জন্যে পথে নামলেন ।তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।ছুটন্ত ট্রাম এসে কবিকে প্রচন্ড ধাক্কা দিল। ও কবি পড়ে গেলেন। রাত্রি আটটা-নয়টা নাগাদ শম্ভুমিত্র হাসপাতালে তাঁকে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি করা হয়।কয়েকদিন লড়াই চলে। ২২ শে অক্টোবর রাত্রি ১১-৩৫ মিনিটে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়।
এই যে মৃত্যু, তা আপাত দৃষ্টিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলে মনে হলেও আসলে এর পেছনে ছিল অনেককালের সুপ্ত মানসিক অবচেতনজাত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। 'সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে' 'একা' হয়ে যাওয়া কবি এই ঘটনার প্রায় হুবহু বর্ণনা তিনি করে গেছেন প্রায় ১৬ বছর আগে লেখা একটি কবিতায়।সেখানেও ছিল এরকম ট্রামলাইনের কথা -
'অনেক রাত হয়েছে --অনেক গভীর রাত হয়েছে ;
কলকাতায় ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে --ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে --
কয়েকটি আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো
এই যে ট্র্যামের লাইন ছড়িয়ে আছে
পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ
অনুভব ক'রে হাঁটছি আমি।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে -কেমন যেন ঠাণ্ডা বাতাস
কোন্ দূর সবুজ ঘাসের দেশ নদী জোনাকির কথা মনে পড়ে আমার --
তারা কোথায়?
তারা কি হারিয়ে গেছে?
পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন - মাথার ওপরে
অসংখ্য জটিল তারের জাল
শাসন করছে আমাকে।'
এতো শুধু কবিতা মাত্র নয়। এ যেন অনেক আগে লিখে যাওয়া কবির সুইসাইড নোট। অর্থ কীর্তি প্রেম শিশু গৃহ স্বচ্ছলতা সব থাকা সত্ত্বেও 'আট বছর আগের একদিন' কবিতার নায়ক যেভাবে 'অন্তর্গত রক্তের ভেতরের' বিচিত্র বিস্ময়ের' কারণে ফাল্গুনের রাতের আঁধারে পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে যাবার পর একগাছা দড়ি হাতে আত্মহননের জন্যে বেরিয়ে পড়েছি , তারই এক ভিন্নতর দৃশ্যপট এখানে ফুটে উঠেছে কবির ভাবনায়।
যদিও এর উত্তর হয়তো অমীমাংসিত। তবুও চারপাশের অসুস্থতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারার জন্যে একদিন কবিকে লিখতে হয়েছিল 'পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন'। সেই অসুস্থ পৃথিবীর 'অবাঞ্ছিত' মানুষটি নিজেকে এইভাবে সরিয়ে নিয়েছিলেন একেবারে নীরবেই।
তথ্যঋণ : ১. জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি, কলকাতা।
২. জীবনানন্দ - গোপাল চন্দ্র রায়, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা।
৩. জীবনানন্দ পরিক্রমা- ড. সুশীল ভট্টাচার্য, দীপ প্রকাশন, কলকাতা।
৪. অনন্য জীবনানন্দ- ক্লিন্টন বি সিলি, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, বাংলাদেশ।
Comments
Post a Comment