দ্যাশ
...হঠাৎ
দরজায় ধাক্কানি। ঘুম ভেঙে যায় হাসানুল্লার। আদরের বউ ময়নামতিকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল সে।ইচ্ছে করে না সে-জড়ানো কামজ আরাম ছেড়ে
বেরিয়ে আসতে।দরজায় অবিরত ধাক্কা।এক সময় বেরোতেই হলো। ময়নামতি তখনো লেপটে আছে ওর
বুকে মাথা রেখে। বেঘোরে ঘুম।পাশের ঘর থেকে তার আব্বা জামালের হুপিংকাশির শব্দ ভেসে
আসে পরতে পরতে...।জামাল তো
সারা রাত্রিই তন্দ্রায় তন্দ্রায় কাশতে থাকে।ঘুম আর কোথায় হয় ওর।সে শ্লেষ্মামেশানো
ভীতস্বরে ডেকে ওঠে, ‘ হাসাইন্যা র্যা ক্যা আইল র্যা...!’ হাসানুল্লা ফিসফিসিয়ে
বউকে ডাকে, ‘অ ময়না, ময়নারে, বাইরে কেডা
আইচে, দজ্জা ধাক্কাইতাচে, উডদে অইব...।’ ময়নামতি স্বামীর বুকের ওম ছেড়ে
অলসভাবে মুখ তুলে তাকায়।তারপর ঘুম
জড়ানো গলায় জানতে চায়,‘উঁহু-উঃ, কেডা আইল আবার এই মাজ রাইত-অ...?’ হাসানুল্লা বলে
ওঠে, ‘উইঠ্যা পড়, দেরি করিচ না ,বাইরে কেউ আইচে, তুই পাক গর-অ গিয়া লুকা...।’
তারপর পাশের ঘরে শুয়ে থাকা আব্বাকে
উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বলে, ‘ আব্বা পাক ঘর-অ গিয়া বোডিডা হাত-অ লও, আমি
দাওডা লই...।’ বলতে বলতে সে বেড়ার গায়ে গুঁজে রাখা কাঠদাওটা টেনে নেয়। ময়নামতি
গা-ঝেড়ে উঠে তড়িঘড়ি আলুথালু পরনের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে শেষে আঁচলটাকে গাছ কোমর করে
বাঁধে। তারপর পাকঘরের দিকে ছোটে...।
হাসানুল্লা হাতে
কাঠদাওটা নিয়ে সন্তর্পণে দরজাটা খোলে।
খুলেই দেখে দরজায় দণ্ডায়মান একদল খাকি পোশাক। ওদের দু-জনের হাতে জ্বলছে বড়
ফোকাসওয়ালা টর্চ-লাইট।রয়েছে একজন মাইকি(মেয়ে)খাকিও। হাসানুল্লা ভ্যাবাচেখা খেয়ে কী
করবে ভেবে না পেয়ে হাতের দাওটা ওদের দিকেই
তুলে ধরে। সামনের দিকে দাঁড়িয়ে আছে যে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি সে প্রাণ বাঁচাতে হাত দুটো বাড়িয়ে রে রে করে
ওঠে, ‘ওই ওই কাক মারিয়াছা,আমি ডকাইত নহয়, আমি পুলিচ হয়,বড্ডার পুলিচ...।’ পেছনের রোগা-রোগা খাকি ক’টা
তড়িৎ গতিতে হাসানুল্লার দিকে বন্দুক তাক করে। হাসানুল্লা থিতিয়ে পড়ে। ফিরে আসে
নিজের ভেতর, ‘ হ হ বুজ্জি আফনেরা পুলিচ,কিন্তু কি করুম ভাইব্যা ফাই নাই...!’ বলতে
বলতে সে দাওসহ হাতটা নামিয়ে নেয়।ওই অবকাশে পেছনের একজন রোগা খাকি হাসানুল্লার হাত থেকে দাওটা তড়িঘড়ি ছিনিয়ে নেয়।
ওই মুহূর্তে হাতে বটি দাও নিয়ে উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে হাসানুল্লার পেছনে এসে
দাঁড়িয়েছে আব্বা জামাল। সে-ও পুলিশ
দেখে হকচকিয়ে গিয়ে বটিদাওটাকে হাত থেকে ছেড়ে দেয় ।বটি দাওটা মেঝেতে আছড়ে পড়ে সশব্দে।
পেছন থেকে আরেক রোগা খাকি খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ ক্যালা মাককহাই(গালি) বিদেহি(শি), তহতে
অ্যাটাক করার কারণে রেদি আছিল...।’ সামনের বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকিটিও গর্জে ওঠে, ‘ অইন্যাই ভাবে আমার(আমাদের)খাবি,আমার
থাকিবি তার-অ উপরি আমার ওপরতেই হ্যাংদাং(দাও)তুলিবি...ক্যালা...।’ বলতে বলতে সজোরে একটা ঘুষি
চালিয়ে দেয় সে হাসানুল্লার মুখের ওপর।
হাসানুল্লা ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়। এতক্ষণ পাকঘরের আড়াল থেকে সব লক্ষ করছিল
ময়নামতি। সে আকুলি-বিকুলি করে চেঁচিয়ে ওঠে। দৌড়ে এসে হাসানুল্লাকে আঁকড়ে ধরে।ময়নামতির এই আকস্মিক উপস্থিতি
খাকিগুলোর সব চোখ কেন্দ্রিভূত হয় ওর ওপর। জামাল
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে, ‘না বাবু , আমরা বুজদে ফারি নাই আফনেরা যে
আইবেন,আমরা সচাই ভাবছিলাম ডাকাইত ফাকাইত আইল নেকি...।’
--চোপ, তহতক
আমি(আমরা)ভালকে চিনি পাও,বেছি কথা ন-কবি ক্যালা...।’ সামনের বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি
ধমকে ওঠে।
--তহতর ত্যাল(তেল)উলাই
দিম এতিয়া, মাককহাই...।’পেছন থেকে আরেক রোগা খাকি হিস হিস করে খিস্তি ছোড়ে।
এবার সামনের
বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগা খাকিটিকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ওই
হরকাণ্ট লাইট পেলোয়া ...।’বলতে বলতে
সে তার হাতে থাকা ফাইলটা খুলতে থাকে।পেছনের হরকান্ত রোগা খাকি ফাইলটির ওপর টর্চ জ্বালায়।বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি ফাইলটি খুলতে খুলতে
জামালকে তোড়ে জিজ্ঞেস করে , ‘তর নাম কি কোয়াছুন?’ জবাব দিতে গিয়ে জামালের হঠাৎ
কাশি ওঠে,গলায় এসে আটকে যায় এক দলা কফ।ওই কফ জড়ানো স্বরে জামাল জবাব দেয়,
‘জামালুদ্দিন আহমদ...।’ বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা ফাইলের দিকে চোখ রেখেই খুঁজে পাওয়ার
আবেশেই বলে ওঠে, ‘ হয়,পাইছু, জামালুদ্দিন,
হাছানুল্লা আরু মইনামিতি...।’ তারপর জামালের দিকে চোখ তুলে আবার জানতে চায়, ‘ নোটিছ পাইছা নে?’ জামাল ওই
শ্লেষ্মাক্রান্ত স্বরে জবাব দেয়, ‘ হ, কাগজ এটটা দিয়া গেছিল...।’ বলে একটু থামে সে
।বুক ভরে শ্বাস নেয়, তারপর মুখে একটু ম্রিয়মাণ হাসি ফুটিয়ে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালাকে
উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আফনেরে ত আমি চিনি বাবু,মনত আছে,হেই বাউত্তর চন-অ মাইনকাচর বড্ডারে
আমার আব্বুর কাছ থিক্যা টেহা লইয়া আমাগরে ডুকাইয়া দিছিলেন এই দ্যাশ-অ, আফনের লগে
আছিল ইয়ানর এজন ঠিয়াদার...।’জামালের কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় না বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা,
‘ওই কুকুরর পোয়ালি(বাচ্চা) ক্যালা, কি উল্টা–পুল্টা বকিয়াছা, একদম বন্দুক দি
খুন্দা মারি(বাড়ি মেরে) ইয়াতেই মারি পেলাম তক,বেছি কথা ন কবি, মনে মনে থাক(চুপ করে
থাক)...।’ ধমক খেয়ে চুপসে যায় জামাল।ততক্ষণে হাসানুল্লা হাত-পা ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ‘আমরা কই যামু কন ত বাবু, আমরার ত
কুনানো যাওনের জেহা নাই অহন,আফনেরা যে দ্যাশডার কথা কন, আমার আব্বু ত হেই দ্যাশডার
কথা বুল্ল্যাই গেছে,আমিও ত দেহিই নাই দ্যাশডারে...!’ হাসানুল্লার কথাটা শুনে
খাকিবাহিনীর সবাই একত্রে হেসে ওঠে।একজন রোগা খাকি ওই হাসি বজায় রেখে বলে ওঠে, ‘ হয়
হয় আমার(আমাদের) অহমটু(আসামটা)তহতর গেছট হাউচ...।’ এরপর বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা বলে ওঠে, ‘নহয় নহয় তহতর ভাবিব নে লাগে, তহতর কারণে
চরকারে মহল বনাইয়াছে ন, তাত থাকিবি...।’বলতে বলতে একটা ফিচেল হাসি ছাড়ে সে।সঙ্গে
সঙ্গে বাকিরাও। পেছন থেকে একটা রোগা খাকি বলে ওঠে,‘আমি তহতক এছকোর্ট করি লই যাম
তাত...।’ আবার একটা হাসির রোল ওঠে খাকিদের মধ্যে।
এবার বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা হেঁকে ওঠে, ‘ওই হরকান্ত, ওই ভোগেশ্বর ,ওই রুপহি অ্যারেস্ত করা এই
তিনিটাক...।’ বুড়ো ভুঁড়িওয়ালার আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগা খাকি তিনজনের দুজন
ঘরে ঢুকে ঝটপট জামাল আর হাসানুল্লার জামার কলার চেপে ধরে ।বাকি মাইকি-খাকি গিয়ে
ময়ানামতির একটা হাত চেপে ধরে। ময়নামতি গর্জে ওঠে, ‘ আমার হাত ধরছেন ক্যান, ছাড়েন,
আপনে গ কি দয়া মায়া নাই আমাগ উফর ...।’ বলতে বলতে সে নিজের হাতটিকে
ছাড়াতে হুটোপাটি করতে থাকে।কিন্তু মাইকি-খাকির শক্ত মুঠো থেকে পরিত্রাণ পায় না সে।
মাইকি-খাকি ফিস ফিস করে বলে , ‘তর একদম চিন্তা করিব নে লাগে, মই তোক চাম(দেখব),কোনেও
এক-অ করিব নয়ারিব-অ...।’ বলতে বলতে
সে ময়নামতিকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে থাকে।ময়নামতি শরীর দিয়ে না পারলেও,
মুখের ঝামটি,খিস্তি আর অশ্রাব্য গালাগালি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে।বাকি দুই
রোগা খাকি জামাল আর হাসানুল্লাকেও কলার ধরে বাইরে নিয়ে আসে।কাছেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে
আছে ধেধ্বেরা,তিরপলের আচ্ছাদন-ছেঁড়া পুলিশের একটি গাড়ি।ওদের ধরে ওটার দিকেই নিয়ে
যাচ্ছে ওরা। হাসানুল্লা কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চায়, ‘আমাগ কই লইয়া যাইবেন?’ বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘কলু নহয়,মহলত, তালৈ বুলা(সেখানেই চল)...।’ জামাল কিছু বলে না। শুধু
শ্বাসে-প্রশ্বাসে ওর ঘড়ঘড় শব্দ ওঠে আর ক্ষণে ক্ষণে কাশে।বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা আর কোনও
রা না করে গাড়িটির সামনের ড্রাইভারের পাশের সিটে গিয়ে উঠে বসে।বাকি দুই রোগা খাকি
জামাল আর হাসানুল্লাকে নিয়ে উঠে বসে পেছনে।ময়নামতির হাতটা চেপে ধরে রেখেছিল যে
মাইকি-খাকি সে ময়নামতির হাতটা তখনো ধরে রেখেই ওর গা ঘেঁষে বসে পড়ে । পাশে জামালকে নিয়ে বসে থাকা হরকান্ত নামের রোগা
খাকি মাইকি-খাকিকে উদ্দেশ্য করে নিচু গলায় বলে ওঠে, ‘ওই রুপহি তয় আমার ইয়াত আহি
বহা মই মইনামিতিক ধরিম...।’ রুপসী তির্যক চোখে তাকায় হরকান্তর দিকে। তারপর রুষ্ট
গলায় ধমকে ওঠে , ‘ ছারে তহতক যি কামটু করিবলই দিছে হেটুই করা, হইভ্য(সভ্য)হৈ
থকা...।’
গাড়িটি চলা শুরু
করে। এবড়ো-খেবড়ো তল্লাটের মেঠো রাস্তায় গাড়িটা খুব দুলছে। এই সুযোগে মুখোমুখি
হাসানুল্লাকে নিয়ে বসে থাকা ভোগেশ্বর নামের রোগা খাকি ময়নামতির বুকের ওপরই হুমড়ি
খেয়ে পড়ার ভান করে।ময়নামতি
খেঁকিয়ে ওঠে, ‘আফনে দেহি মহা অসইব্য...।’ বলতে বলতে সে ভোগেশ্বরকে হাত দিয়ে ঠেলা মেরে সরিয়ে দেয়। এই দৃশ্যে জামাল আর হাসানুল্লা
ফুঁসে ওঠে ,কিন্তু হরকান্তর ঘুষি তোলা দেখে কিছু বলতে পারে না। ময়নামতির এই ঠেলাতে
ভোগেশ্বর ছেঁদো হাসে, তারপর রগড় করে বলে, ‘ তয় বর ভাল মইনামিতি, তর নামটুও বর
ধুনিয়া(সুন্দর),তয়ই ছারর মন রইখ্যা করিব পারিবি...।’ ভোগেশ্বরের কথাটির রেশ ধরে হরকান্তও
বলে ওঠে, ‘হয় হয় তয়েই পারিবি...তয়েই পারিবি..।’ বলতে বলতে সে ভোগেশ্বরের
দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসে।ভোগেশ্বর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা খাকিকে উদ্দেশ্য করে হেঁকে বলে, ‘ কি কয় ছার,হছা(সত্য)হয় না নাই...?’
বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা কোনও জবাব দেয় না। রুপসী
হিস হিস করে বলে ওঠে, ‘তহতে ক্যালা পহুরও অধম...।’ ময়নামতি নীরবে কাঁদতে থাকে।
জামাল কাশে। হাসানুল্লা চোখ বুজে থাকে।চোখের দু কূল ওর ভিজে যাচ্ছে...।গাড়িটি এবার
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ছেড়ে উঠে আসে সমতল হাইওয়েতে...।
দীর্ঘ আঁধার
পথ অতিক্রম করে গাড়িটি আবার নেমে পড়ে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায়। ওই অসমতল রাস্তা দিয়েই
গাড়িটি কখনো মট-মট কখনো মচর-মচর শব্দ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। এখন গাড়ির ভেতরে
কারো মুখে কোনও কথা নেই। শুধু মাঝে মাঝে আল্লাকে ডাকতে ডাকতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামাল,হাসানুল্লা আর ময়নামতি
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে।ওরা সবাই বোঝে গাড়িটি এগিয়ে
যাচ্ছে একটি গ্রামের ভেতর দিয়ে।এখন তো কারো জেগে থাকার কথা নয় ওই গ্রামে। সারা
গ্রাম নিদ্রায় আচ্ছন্ন।চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখা যায় শুধু বিন্দু বিন্দু
জোনাকি। আর শোনা যায় শেয়ালের সমবেত হররা...।
একসময় গাড়িটি
এসে থামে। সামনে বসে থাকা বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি বলে ওঠে, ‘ এতিয়া নামিব লাগিব...।’
তারপর হেঁকে ওঠে, ‘ ওই রুপহি তাক লই নাম... হরকান্ত-ভোগেশ্বর টোপনি(ঘুম) মারিয়াছা
নেকি, কুনো মাত(কথা) নাই যে...?’ হরকান্ত
জবাব দেয়, ‘ কি করিম ছার, আমার লগত এজন ফুলনদেবী আছে না ...।’ রূপসী বড় বড়
চোখ করে তাকিয়ে থাকে হরকান্তর দিকে। কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে সেটা
সে বোঝে।রূপসী ময়নামতিকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামে।ময়নামতির হাত সে ছাড়ে না। সঙ্গে
সঙ্গে জামাল আর হাসানুল্লাকে নিয়ে নামে হরকান্ত আর ভোগেশ্বর।
জামাল,হাসানুল্লা আর ময়নামতির দু-চোখে অশান্ত কৌতূহল, এরা কোথায় নিয়ে এলো
ওদের?বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি গাড়ি থেকে নেমে ওর হাতের বড় ফোকাসওয়ালা টর্চ লাইটটা
জ্বালায়। ওর দেখাদেখি বাকি দুই রোগা খাকিও জ্বালায় ওদের হাতের টর্চ লাইট। ওই তিন
টর্চ-লাইটের আলো ঘোরাঘুরি করতে থাকে সামনের একটি নতুন রং লাগানো উঁচু লোহার ফটকের
দিকে।ফটকটিকে দেখেই কেমন চেনা চেনা লাগে জামাল,হাসানুল্লা আর ময়নামতির।বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা হাঁক মারে কারো উদ্দেশ্যে। ওর হাঁক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে কেউ
হাতে টর্চ নিয়ে দৌড়ে এসে তালা খুলে ফটকটি মেলে দেয়। ওরা জামাল,হাসানুল্লা আর
ময়নামতিকে ধরে ফটকের ভেতরে নিয়ে যায়। ফটক
আবার বন্ধ করে দেয় লোকটা। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা আগে আগে টর্চ লাইট দিয়ে নিশানা করতে
করতে এগোতে থাকে আর মাইকি-খাকি রূপসীকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, ‘ওই রুপহি, তয় তাক
লই মোর পিছে পিছে আহা...।’ রূপসী তাই করে।
পেছনে পেছনে দুই রোগা খাকি হরকান্ত-ভোগেশ্বর জামাল আর হাসানুল্লার কলার
চেপে ধরে রূপসীকে অনুসরণ করে। ওরাও মাঝে মাঝে ওদের হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে
এদিক-ওদিক ঘোরায়। একটু এগিয়ে গেলেই জামাল বিস্ময়ভরা কণ্ঠে ছেলে হাসানুল্লাকে
উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে, ‘ হাসাইন্যা র্যা এই কোঠাগুলান ত আমরাই বানাইচি...!’
হাসানুল্লাও তাজ্জব বনে গিয়ে বাবার কথাটির
লেজ ধরে, ‘হ আব্বু ঠিকই কইছ, এগুলা ত আমরাই খারা করছি, তুমার-আমার ছেনির পালিছ
এগুলার গায়ে গায়ে অহন-অ লাইগ্যা আছে...।’ ছেলের এ কথায় জামাল যেন আবেগিক হয়ে ওঠে,
‘ হ হাসাইন্যা, হেই ছিমেণ্টর ঘেরান অহন-অ আমার নাক-অ আহে...।’ হাসানুল্লা বাবার
কথায় সায় দেয়, ‘ হ আব্বু আমিও পাইয়াতাচি হেই ঘেরান...’।ওই মুহূর্তে এক রোগা খাকি
খেঁকিয়ে ওঠে, ‘ওই ক্যালা বিদেহি(শি),তহতর হাহছ বেছি হৈ গইছে, বেছি মাত নে মাতিবি,
মনে মনে থাক...।’ এতক্ষণ ময়নামতি সামনের অনেকগুলো ছোটো ছোটো কোঠা নিয়ে গড়ে ওঠা
নতুন দোতলা লাল রঙা দালান-বাড়ি তিনটিকে দেখতে দেখতে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল।পাশাপাশি বাবাশ্বউর
আর স্বামীর কথাগুলোও শুনছিল। তখনই সে প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘ক্যান মনে মনে থাকুম, হচা
কথাডা কইতে খেতি কি? আমরা কি কম খাটছি এই খুপরি-খুপরি ঘরঅলা হাউলি তিনডা বানানের
লাইগ্যা, রাত-অ গুমাই নাই পজ্জন্ত...ঠিয়াদার তেড়া দিতাছিল আমাগ... হে কইতাছিল, পলম(দেরি)হইয়া
গেলে নাকি বড্ডার পুলিচে হেরে গুতাইব...।’
--ভালেই হইছে
,তহতে এই হাউলি বনাইছা, এতিয়া তহতে ইয়াতেই থাকিবি, ভালকে থাকিবি, যিহেটু তহতে মরম
করি বনাইছা...।’ বলতে বলতে খিক খিক করে হেসে ওঠে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি।
বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি
কথা শেষ করতে না করতে মাইকি-খাকি রূপসী গম্ভীরভাবে বলে ওঠে, ‘ওই মইনামিতি, হাউলি
বনোয়ার কারণে তহতকেই টু মাতিব লাগিব, ঠিকাদারে টু হস্তাত(সস্তায়) মানুহ নে পায়
নহয়...।’ বলতে বলতে সে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালার দিকে তির্যক তাকিয়ে একটা ভেংচি মারে।
বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা গর্জে ওঠে, ‘ওই রুপহি, ময় কিন্তু বহুত টাইম ধরি চাইআছু তয় ক্যালা
অহম-বিরোধী মাত মাতিয়াছা...।’
পাশ থেকে রোগা
খাকি হরকান্ত একটা ভেটকি মেরে বলে ওঠে, ‘ওই রুপহি, তয় দেখুন অহমিয়া নহয়, দালাল হয়?’
রোগা খাকি
ভোগেশ্বর উস্কানি মারে, ‘ অ অ মোর মূরতেও(মাথায়ও) হেই হন্দেহটোই উথল-মাথল(ঘুরপাক)
খাইয়াছে...।’
রূপসী সময়
নেয় না, তেড়ে জবাব দিয়ে ওঠে, ‘ওই তহতে কী ভাবিয়াছা, হচা কথা কলেই মই দালাল,
অহমিয়াই হছা(সত্য) কব নোয়ারে নেকি?’
হরকান্ত এবার ফোঁড়ন ছাড়ে, ‘ অ অ তয় তো
বাঁও...।’
এবার হরকান্ত-ভোগেশ্বর
একত্রে খিল-খিলিয়ে হেসে ওঠে।
বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা গাঁকগাঁক করে বলে ওঠে, ‘ওই হরকান্ত-ভোগেশ্বর,
তহতে দেখুন তহতর ডিউটি পাহরি গলি(ভুলে গেলি),আরু মাত নে মাতিবি, জলডি বুলা(তাড়াতাড়ি
চল)...।’ বলতে বলতে সে টর্চ জ্বালিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে।
বাকিরা ওর পেছন পেছন।
এক সময় ওরা
দালান-বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। প্রবেশ করা মাত্রই বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা টর্চটা নিভিয়ে
দেয়। ওরা এবার আঁধারেই এগোতে থাকে।জামাল,হাসালুল্লা আর ময়নামতির কোনো অসুবিধা হচ্ছে
না। কারণ এই তিন দালান-বাড়ির অলি-গলি, প্রবেশদ্বার, পার্শ্বদ্বার, পেছনদ্বার,
গুপ্তদ্বার, সিঁড়ি-সোপান সবই ওদের নখদর্পণে। ওদের নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে
ওরা।প্রথম তলে উঠে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা হেঁকে ওঠে, ‘ওই হরকান্ত-ভোগেশ্বর ওই দুটাক দছ
নম্বরক হুমাই দিয়া,...ওই রুপহি, মইনামিতিক লই অহা মুর অফিচত...।’ বলতে বলতে সে
এগোতে থাকে। পেছন থেকে রূপসী কৌতূহলী হয়ে শুধোয়, ‘অফিচত কিয়, তাক তো উনইচ(উনিশ)নম্বরত
রখার কথা, ফিমেল ছেল...।’
--এটু তোর চিনটা(চিন্তা)
করিব নে লাগে, তয় তাক লই অহা...।’ বলতে বলতে সে তার অফিসের দিকে পা বাড়ায়।
রূপসী নিয়ে আসে
ময়নামতিকে। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা তার
অফিস-রুমটি খুলে ভেতরের বিজুলি বাতিটি জ্বালিয়ে দেয়।রূপসী সঙ্গে সঙ্গে ময়নামতিকে
নিয়ে ভেতরে যায় না। বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা হাঁকে, ‘ওই রুপহি তাক
ভিতরত লই অহা...।’ ইতিউতি করে ময়নামতিকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে রূপসী। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা
এবার আদেশের সুরে রূপসীকে বলে, ‘এতিয়া তয়
যা...।’
রূপসী আশ্চর্য
হয়ে বলে, ‘কিয়, মুর ডিউটি এতিয়া লইকে হেহ(শেষ)হুয়া নাই,মইনামিতিক উনইচ নম্বরত লই
যাব লাগিব...।’
--হেটু মই চাম(ওটা
আমি দেখব)...।’
বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালার এই কথায় রূপসী সন্দিগ্ধ হয়ে বলে ওঠে, ‘এতিয়া তাক কি করিব ছার?’
--কিবা
হুধাম(শুধোবো)...।’
বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালার এই কথায় আরও সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে রূপসী। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।
বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালা ধমকিয়ে ওঠে, ‘কি হল, মুর কথা হুনিবলই পোয়া নাই নেকি? যা যা বহুত রাতি
হৈ গইছে, অমূল্যই রুখিয়াছে(অপেক্ষা করছে) তর কারণে...।’
রূপসী চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে, ‘কামটু
ভাল হব না কিন্তু ছার...।’
বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা এবার ধমকিয়ে সতর্ক করে দেয়
রূপসীকে, ‘ওই রুপহি,একদম মুখ ন খুলিবি, তর চাকুরি টু যাবই, অমূল্যরও যাব...।’
বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালার এই ধমকে রূপসীর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।অনন্যোপায় হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে
আসে সে। ওই মুহূর্তে এসে হাজির হয় হরকান্ত আর ভোগেশ্বর।
ময়নামতি এক অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে আর গোঁফে তা দিচ্ছে।কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা হরকান্ত-ভোগেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বারে বারে কী যেন ইশারা করে।একসময় হরকান্ত ময়নামতির কাছে এসে সান্ত্বনাচ্ছলে অভয় দেয়, ‘ওই মইনা, তয় ইমান চিন্তা করিয়াছা কিয়,ছার ভাল মানুহ, তেঁও তোক রইখ্যা করিব...।’
ভোগেশ্বরও কাছে
এসে হরকান্তর সঙ্গ ধরে বলে, ‘হয় মইনা,তয় একদম নে ভাবিবি,ছারে তোক
হোনকালেই(শীঘ্রই)এরি দিব(ছেড়ে দেবে)...।’
--খালি
তোক নহয়, তোর ভতার(স্বামী) আরু হোহুরওকো(শ্বশুরকেও)এরি দিব হোনকালে...।’ হরকান্ত যোগ করে।
ময়নামতির
নড়বড়ে চোখমুখে যেন নিমেষে নেমে আসে অন্য এক ছায়া...।যেন ডুবতে ডুবতে এক টুকরো কাঠ হাতের কাছে পেলো। সে উদগ্রীব হয়ে বলে
ওঠে, ‘ হছা কইতাছেন বাবু আমরা ছাড়া পামু!’
--হয় হয় তর নিজা ঘরত উভতি(ফিরে) যাব পারিবি...।’
--কবে বাবু, কবে?’
--এই কলু নহয়, হোনকালে...।’
--আমাগ গেরামের ভুঁইয়াকত্তার ধান খ্যাত-অ আমরা কাম করি
অহন। হালি ধানর সময় হইয়া আইছে।বিজ বুনতে অইব বিজতলাত। পেত্যেকবার ত আমরাই হাল মারি
ভুঁইয়াকত্তার খ্যাত-অ। খ্যাত হেউজিয়া হইয়া যায়...।’একটু দম নেয় ময়নামতি তারপর আবার
বলে, ‘ভুইয়াকত্তার গরু-ছাগলি, হাহ-মুগগি ত আমরাই দেহি...।’ বলতে বলতে এবার সে তার
দু-ঠোঁটে অবোধের হাসিটি দু-দিকে ছড়িয়ে দেয়।
-- হব
হব হকলো হব ,তয় খালি ছারর অডডারটু মানিবি...।’
--কী
অডডার?’ ময়নামতির গলায় অতলান্ত কৌতূহল।
--ছারর
অডডারটু মানিলেহি তোর গোটেই(সব) হমইছ্যার হমাধান হৈ যাব...।’
--ছারের
অডডারটা কী আগে কন?’
--ওচরর(কাছের)ঘরটু
আছে চা(দেখ)...।’ ময়নামতি দেখল পাশেই একটা ঘর রয়েছে। দরজাটা খোলা।
--তাতে
হুমাই যোয়া(ঢুকে পড়), তাতেই ছারে তোক অডডার দিব,তোর ছব মানিব লাগিব,অমাইন্য করিলেই
বিপদ, তহতর আরু মুকটি ন হব...।’
ময়নামতি খোলা দরজাটার দিকে নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আড়চোখে
দেখে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকিকে। বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা খাকি যেন ওর দিকে হাত তুলে আশীর্বাদ
করছে। আসলে বুড়ো ভুঁড়িওয়ালা ওকে হাত দিয়ে দেখাচ্ছে খোলা দরজাটা। ময়নামতি কিছুক্ষণ দোনামনা
করে অবশেষে ঢুকে পড়ে ঘরটার ভেতরে। বুড়ো
ভুঁড়িওয়ালার মুখে ফুটে ওঠে প্রসন্নতার হাসি। হরকান্ত-ভোগেশ্বর দু-জনেই ঠোঁট দিয়ে বাজায় বর্বরতার শিস...।
… ময়নামতি জেগে ওঠে। জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসে।উঠে বসা মাত্রই একটি যন্ত্রণা নীচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। দেখে, যেখানে সে রয়েছে সেটা একটা চাপা-চাপা আলোছায়াঘেরা খুপরিঘর। গারদ রয়েছে তাতে। ওই গারদ দিয়ে ভেতরে ঢুকছে মরা আলো।সে-আলোয় নিজেকেও পরিষ্কার ঠাহর করা যায় না। ময়নামতি বুঝে উঠতে পারে না, সে কেমন করে এখানে এলো?যদিও এখানে আসারই কথা ছিল তার।ভাবতে ভাবতে একটু আত্মস্থ হলে পর গত রাতের ঘটনাগুলি একটা একটা করে মনে পড়ে গেল তার।মনে পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।ওটা শুধু রাত নয়,একটা দুঃস্বপ্নের রাত। ওই নর-খাদক তিনটি...!ওই স্বল্পালোকে তৎক্ষণাৎ ময়নামতির চোখ চলে যায় নিজের শরীরের দিকে। দেখে,তার পরিহিত সব বসন অসংবৃত। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়চোপড় যথাস্থানে জড়িয়ে নেয়।তারপর গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে সে।সঙ্গে সঙ্গে ডাকতে থাকে তার স্বামী হাসানুল্লা আর বাবাশ্বউর জামালকে। ওই কান্না,ওই ডাক খুপরিঘরের তিন দেয়ালের ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে হতে ঘুরপাক খেতে থাকে...ঘুরপাক খেতে থাকে...।অবশেষে একসময় ময়নামতি একটু ধাতস্ত হয়।কিন্তু অনবরত বেরিয়ে আসছে তার চোখের জল। দুই বাহু দিয়ে মোছার অক্ষম প্রচেষ্টা চালায় ওই জল সে।তারপর পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় গারদের কাছে।বোঝার চেষ্টা করে এখন দিনালোকের কোন ভাগ চলছে? দিন তো বটেই। কিন্তু সকাল না দুপুর না বিকেল বুঝে উঠতে পারে না ময়নামতি।একটা ক্ষীণ দিনের আলো দূর থেকে লম্বা অলিন্দ বেয়ে এসে পড়ছে ওর এই খুপরিঘরের গারদের ওপর।আকাশ দেখা যায় না, শোনা যায় না পাখির ডাক। সে ভাবে তার স্বামী-বাবাশ্বউরের কথা।ওরা কোথায় আছে, কী ভাবে আছে? খুব মন দিয়ে কানটা পাতে ময়নামতি। বাবাশ্বউরের কাশির শব্দ শোনা যায় কিনা? অনেক মনঃসংযোগের পর সে শুনতে পায়,বাবাশ্বউর জামালের কাশির শব্দ।ময়নামতি বুঝতে পারে, ধারে-কাছেই কোনও খুপরিতে রাখা হয়েছে ওদের।বাবাশ্বউর এখনো কাশছেন!তিনি সর্বক্ষণই কাশেন। ঘুমের মধ্যেও।যে-মানুষটা তার ‘পরানের পদিপ’, স্বামী হাসানুল্লা।সে কেমন আছে,কী করছে?ময়নামতি খুব উতলা হয়ে ওঠে।হাসানুল্লার কথা ভাবতেই ভেজা চোখ আরও ভিজে ওঠে ওর। মনে পড়ে যায় সেদিনটির কথা, যেদিন এই দালানবাড়িরই কোনও একটা নির্মীয়মাণ খুপরিঘরের দেয়ালে সিমেন্টের মশলা পালিশ করা শেষ করে হাসানুল্লা ওই দেয়ালেরই কাঁচা পালিশের ওপরে আঙুল দিয়ে ওর নামটি লিখে ওকে ডেকে দেখিয়েছিল ‘ওই ময়না দ্যাখ’। স্বামীর হাতে লেখা তার নামটি দেখে সেদিন সে ‘অ্যারাম’ বলে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল।আর মনে মনে কী যে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল সেদিন আজও ভোলেনি সে!ময়নামতি এটাও ভোলেনি, হাসানুল্লা তাকে আবার ডেকে বলেছিল, ‘ ওই ময়না তর এই নামডা আমি আর মুছতাছি না,খুদাতালায় যেতদিন রাখনের রাখব...।’ ভাবতে ভাবতে,যদি পাওয়া যায় এই ভেবে, ময়নামতি তার এই খুপরিঘরের দেয়ালেই খোঁজার প্রয়াস চালায় হাসানুল্লার আঙুলে আঁকা তার সেই নামের লিপি।কিন্তু তিন দেয়ালের গায়ে অন্ধকার ছাড়া চোখে পড়ে না কিছুই। তবে সে নিশ্চিত,স্বামীর ওই আঙুলে লেখা তার নামটি এই তিন দালানবাড়ির কোনও না কোনও এক খুপরিঘরে এখনো রয়ে গেছে।নিজেকে আর সংবরণ করতে পারে না ময়নামতি। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে কান্না। চোখ দিয়ে ফেটে বেরোতে থাকে আরও জল...।
ওই মুহূর্তে গারদের ওপারে কেউ এসে দাঁড়ায়। এই আলো-অন্ধকারে অশ্রুভেজা দু’চোখ দিয়ে ময়নামতি পরিষ্কার চিনতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারে, ওই ব্যক্তি আর কেউ নয়, মাইকি-খাকি রূপসী। রূপসীর চোখমুখ থমথমে। ওই থমথমে চোখ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে ময়নামতির দিকে।ময়নামতির মুখেও কোনও রা নেই।তবে চোখমুখে তার গভীর আগ্রহের প্লাবন।একসময় রূপসী গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘ কেনে(কেমন)আছা মইনামিতি?’ ময়নামতি তার চোখ দু’টি এবার আঁচল দিয়ে ভালো করে মোছে।যেন সে তার ভরসার স্থল খুঁজে পেল। তারপর মুখে হাসির প্রলেপ এঁটে,রূপসীর প্রশ্নের জবাবটিকে এড়িয়ে গিয়ে,ওই আগ্রহের তোড়ে, রূপসীর কাঙ্ক্ষিত জবাবের দুর্মর আশায় বলে উঠে, ‘ছার কইছে আমাগ ছাইড়া দিব, কবে ছাড়ব কন ত দিদিমণি?’
রূপসী কোনও জবাব দেয় না।এবার চোখমুখ ভারী হয়ে
ওঠে ওর। ওই ভারী চোখে আবার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ময়নামতির দিকে।তারপর একসময় বলে
ওঠে, ‘তহতে কিয় এই দ্যাহ(দেশ) এরি গুছি ন গলি (ছেড়ে চলে গেলি না)...।’
রূপসীর এ কথায়
ময়নামতি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।ওই মুহূর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না
সে।অবশেষে নিজের মনটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে ওঠে, ‘এই দ্যাশডারেই ত আমাগ নিজের
দ্যাশ বইল্যা ভাবছি দিদিমণি, অ্যা ছাড়া ত আমাগ আর কুন দ্যাশ লাই...।’
এবার যেন তেঁতে
ওঠে রূপসী, ‘এতিয়া গম পাইছা নে(বুঝতে পেরেছিস তো) তহতে কুন দ্যাহত(দেশে)আছা, বুডঢ-মহাটমার(বুদ্ধ-মহাত্মার)
দ্যাহ(শ)...।’ বলতে বলতে একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসলো সে।রূপসীর ইঙ্গিতটা ময়নামতি
বুঝে উঠতে পারে না। সে বদ্ধ হাবাগোবার মতো
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রূপসীর দিকে।সে দেখে রূপসীর মুখাবয়াবটা ক্রমশ যেন
পাথর হয়ে উঠছে। ওই মুহূর্তে ময়নামতি অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই বিবেচনা না করতে পেরে,
থতোমতো খেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে, ‘হ হ গম পাইছি দিদিমণি, ওই যে কার কার নাম
যানি কইলেন, এই দ্যাশডা হেগই, হ্যারাই আমাগ এই দ্যাশ-অ থাকতে দিব না...।’বলতে বলতে
সে অকাট অবোধের মতো হাসতে থাকে রপসীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
ময়নামতির কথাটা
শুনে রূপসীর ওই পাথর-মুখে নিমেষে বিরক্তিতে সহস্র চিড় ধরে গেল যেন। ওই চিড়-ধরা মুখ
নিয়েই সে এবার একটা খিস্তি ছোড়ে ময়নামতির উদ্দেশ্যে, ‘ক্যালা বিদেহি(শি)’।
ওদিকে দশ নম্বর খুপরিতে জামাল কাশতে কাশতে ঈশ্বরের কাছে দণ্ডবৎ হয়ে মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে জবাব চাইছে , ‘হায় আল্লা-আ, এইডা কি তাইলে আমাগ-অ দ্যাশ না-আ... তাইলে আমাগ দ্যাশ কুনডা-আ...কই গেল-অ হেই দ্যাশ...হেই দ্যাশডা কি হারায়া গ্যাছে-এ...আর কুনোদিন ফির্যা আইব না-আ-আ...?’বলতে বলতে কান্নায় আছড়ে পড়ে সে। আর হাপরের মতো কষ্টের বুকটাতে হাত চেপে ঠেলে ঠেলে কাশতেই থাকে...কাশতেই থাকে...।
.............................................................................................
**অসমিয়া সংলাপগুলি অসমিয়া উচ্চারণ অনুযায়ী লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। হরফ অনুযায়ী নয়।
ভালো লেগেছে। অসমের বিদেশী বিতারনের নামে অত্যারের মর্মান্তিক করুন কাহিনী এখানে গল্পাকারে চিত্রায়িত করা হয়েছে। লেখকের অসমীয়া সংলাপ গল্পকে আরো বাস্তব রূপ দিয়েছে।- আশিস ধর।
ReplyDelete