ও কি মাহুত রে
১.
তামারহাটের ভেঙে যাওয়া হাটের বাইরে আসতে আসতে সিকান্দার মিস্তিরি তার ঝাঁকড়া চুল নাড়াতে নাড়াতে বেশ মজাদার এক ভঙ্গি তার দীঘল শরীরে বহন করে আনতে থাকে আর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েই গানের দু এক কলি কিংবা গেয়েই ওঠে_
"ও কি মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে"
এই গানের হাহাকারের মতন সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত লয়ে।গঞ্জ বাজার খেত খামার আর মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে এই গান তার সুরসমেত মিশে যেতে থাকে গঙ্গাধর নদীর মস্ত বালার চরে।
সিকান্দারের চোখ ভিজে ওঠে। এই জীবন এই জীবন মায়া নিয়েই তো আবহমান বেঁচে থাকা মানুষের।
সিকান্দার হাঁটতেই থাকে।লিলুয়া বাতাসে দোল খায় সিকান্দারের মাথার বাবরি চুল।
ফাঁকা প্রান্তরে সে আচমকা দু তিন পাক নেচেই ওঠে আর ঝুঁকে পড়ে নুতন গানের ওপর_
"বিনা বাতাসে ভাসা
ঢোলে রে"
সিকান্দার সিকান্দার হয়েই থেকে যায়। দূরে ক্রমে আবছা হয়ে আসে তামারহাটের ভরসন্ধ্যাবেলা।
২.
গঙ্গাধরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিকান্দার মিস্তিরির শরীরের পুলক সহসা ভেঙে যায়। তার প্রাচীন কালের কালো পাথরের মত কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সে কি তবে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়!
সিকান্দার আসলে নৌকো বানানোর দক্ষ এক কারিগর। আর এই জল ও জলার দেশে ধনী বল জোতদার বল জমিদার বলো বা গৌরীপুরের রাজাই বলো, নৌকো বানাবার কাজে প্রায় সারা বছরই ডাক পড়ে সিকান্দারের। প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে এই কাজ করে চলেছে সে। এই জনপদ তাকে সিকান্দার মিস্তিরি বলেই জানে। চেনে। একসময় সিকান্দার কালু বয়াতির দলে সারিন্দা বাজাতো। তার সারিন্দা কত কত ভরযুবতী নারীকে উন্মনা করেছে!কত নারীকে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে ঠেলে দিয়েছে!কত চেংড়া কে বাউদিয়া করেছে! তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই।
তাকে দেখলে এখনও কত মানুষ মজা করে গেয়ে ওঠে_
"কি ডাং ডাঙ্গালু বাপই রে
নাঠির গুতা দিয়া"
তবে কি সিকান্দার তার সারিন্দার জীবনের কথা ভাবছিল! না কি গয়েশ্বর ধনীর জোতজমি আর বাইচের নাও তাকে আরো আরো এক ভাবনার জটিলতায় ঠেলে দিচ্ছিল!
৩.
'ধওলি রে মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোনো জনে যুক্তি করি চল পলেয়া যাই'
গঙ্গাধরের পাড়ে পাড়ে চরে চরে সেই কত কত যুগ ধরে গোয়ালপাড়ার মেয়েরা এই গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিয়ে কি এক হাহাকারের সুরে সুরে তাদের শরীরে নাচ জাগাতে জাগাতে জীবনের আবহমান এক আর্তি ছড়িয়ে দেয়। দূরের মাঠপ্রান্তরে তখন বিকেলশেষের মায়া। মায়ায় মায়ায় বুঝি আস্ত এক জীবনের ঘোর। গানের দেশে নাচের দেশে হেমন্তের হিমের দেশে গানভরা এক জীবনের গল্প প্রখরতার উত্তাপ ছড়াতে থাকলে আবার ঘুরে ঘুরে গান নেমে আসে মরণ ও জন্মের এই দুনিয়াদারির ভিতর-
'নাল টিয়া নাল টিয়া রে তোর ভাসা নলের আগালে / বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে'
৪.
এইসব চলতে থাকে। ভরা হাটের ভেতর থেকে এক পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসে নাজিমুদ্দিন ওস্তাদ।সে তার জীবনের গল্পের দিকে একপর্বে আমাদেরকে প্রবল টেনে আনবে। আমরা নুতন করে শুনে নেব চর দখলের লড়াই আর হাতিক্যাম্পের গল্প। বিষ্ময় নিয়ে শুনতে থাকবো কিভাবে গান আর বাজনা আর নাচ দিয়ে বুনো হাতিদের পোষ মানানো হত কুমারসাহেবের জঙ্গলবাড়ির সেই ক্যাম্পে।
নাজিমুদ্দিন তখন গাবুর বয়সের চেংড়া। আব্বার সাথে রূপসীর জমিদারের লেঠেলবাহিনীর হুকাতামাকের দায়িত্ব তার উপর। পাশাপাশি মুন্সি চাচার কাছে লাঠি চালনার তালিম নিচ্ছে। আর ফাঁক পেলেই গঙ্গাধরের কাছারে কাছারে জল ভরতে আসা সুন্দরী কইন্যাদের সাথে রঙ্গরস করা আর খোসা নাচের মত গেয়েও ওঠা-
'আন্ধ্যারে ধান্দারে নাচবা নাকি দুলাভাই
দুলা তুই হ্যাচাকের বায়না দে'
এইসব দেখে জরিনা আবেদা হাসিনা ফুলেশ্বরীদের কি খলখল হেসে ওঠা। তারাও কখনো গানে গানে প্রতি উত্তর দিত-
'ফাতেরা রে ফাতেরা
বগরিবাড়ির ফাতেরা"
কি অন্যরকম জীবন ছিল তখন। আলো ছিল। স্বপ্নের ভেতর খেলে বেড়াতো মরিচের খেত। আর সেই নদীপাড়ের জীবন থেকেই তো সে তার জীবনে টেনে এনেছিল জরিনাকে।
হায়রে জীবন! সে বারবার তাকে ডুবিয়েই মারলো এই ধানপাটকামলাকিষান আর ভরা সব হাট পাচালির ভিতর!
Comments
Post a Comment