প্রবন্ধ - তুষারকান্তি রায়


মহাযানপন্থার ভুবনে এক অগ্রগন্য পথিক এর নাম  সুধীর চক্রবর্তী 


লোকসংস্কৃতির গৌণ ধর্ম এবং সেই ধর্মের সাধকদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য এক ব্যক্তিত্বের নাম শ্রী সুধীর চক্রবর্তী (১৯৩৪ – ২০২০)। যিনি সারাজীবন কাটিয়েছেন নদিয়ার কৃষ্ণনগরে।  তবে কৃষ্ণনগরের নাগরিকত্ব বজায় রেখেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার সর্বজনশ্রদ্ধেয়। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান এই ছোট অথচ প্রাচীন, নিস্তরঙ্গ অথচ ঐতিহ্যময় এই শহরটির একজন উল্লেখযোগ্য দিগদর্শন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। অনেকেই (এমন কি কোলকাতার মানুষজনও) তাঁকে স্যর বা মাস্টারমশাই বলেই ডাকতেন। তাঁর স্নেহ ও মনোযোগের সমান অংশীদার কলেজপড়ুয়া, গবেষক, শিক্ষক, পত্রিকা সম্পাদক থেকে কুলি, মজুর, ভ্যানচালক এমন কি রাজমিস্ত্রি অথবা গ্রাম্য পালাগায়ক  কিংবা কথকঠাকুর পর্যন্ত।    


স্থানিকতার ইতিহাস, লোকায়ত জীবন, গৌণধর্ম যেমন তাঁর আগ্রহের বিষয়, তেমনই রবীন্দ্রনাথও তাঁর চর্চা এবং চর্যার অবলম্বন ছিলো। সংস্কৃতির নানা স্তরে ছিলো তাঁর অনায়াস গতায়াত। লিখন এবং বাক দুই সংস্কৃতিতে তিনি ছিলেন সমান সঞ্চরণশীল। বিদ্যায়তনিক গবেষণায় যেমন ছিলো তার অবাধ গতি, তেমনই তাঁর রচনায় ছিলো বৈঠকখানার ঢং, আর সেখানে ছিলো সাধারণ পাঠক সমাজের আনাগোনা। নিত্যযাত্রার বিবরণ, মেলার অভিঞ্জতা, এমনকি কখনও কখনও পরীক্ষার খাতার আশ্চর্য ভুলভ্রান্তিও তাঁর লেখার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিলো। তিনি যখন গান গাইতে গাইতে গান নিয়ে কথা বলতেন তখন তাঁর বক্তৃতাসভায় শ্রোতা – সমাবেশ ছিলো একটা দেখার মতো বিষয়। 


বাংলা সাহিত্যের সর্বমান্য এই লোকগবেষক ছিলেন অসাধারণ অনুসন্ধিৎসু। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের নতুন বয়ান প্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন স্ব- নিযুক্ত। তাই স্ব – উদ্ভাবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এবং অনুবদ্য। আর, তাই সেই গবেষণা ঠাণ্ডা ঘরে বসে বই ঘেঁটে সন্দর্ভ রচনায় নয়। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে সাধারণ এর সঙ্গে মিশে দেখতেন তাদের জীবন, তুলে আনতেন লেখার রসদ। বাংলার লোকায়ত জীবনের খোঁজে তিনি ছুটে বেড়াতেন নানা প্রান্তে। গ্রামজীবন, মেলা – মোচ্ছব, সংগীত, লোকশিল্প আর লোকধর্মের কথা – সুরের খোঁজে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন গ্রামে – জনপদে। পথচলতি মানুষের দেখা পেলে তার অন্তর স্পর্শের চেষ্টা করেছেন। এই আগ্রহ তাঁর এতোটাই ক্রিয়াশীল ছিলো যে জীবনের শেষ দিকেও সর্বদা খুঁজে বেড়িয়েছেন লোকজীবনের রহস্য। 


প্রখ্যাত লোকগবেষক শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর প্রথম বই প্রকাশিত হয় তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়সে। মনন আর প্রজ্ঞার এমন এক মাহেন্দ্রক্ষণেই তিনি পাঠকের দরবারে এসেছেন যে তারপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পঞ্চাশেরও বেশী মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা এই মানুষটির মেধা আর বীক্ষণ তাঁর লেখায় কেবল নয় ফুটে উঠতো উৎসর্গ পত্রেও। ‘রূপে বর্ণে ছন্দে’ বইটি দু’জনকে উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নামের আগে লিখেছেন ‘উদ্যোগী পুস্তক প্রকাশক’, এবং ‘নিঃস্বার্থ পুস্তকপ্রেমী’। সম্পাদিত গ্রন্থ ‘গবেষণার অন্দরমহল’ যাঁকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর  নামের আগেও তিনি  লিখেছেন, ‘পরহিতব্রতী’। এই মুল্যায়ন যে তাঁর নিবিড় অন্তর – অবলোকনের ফল, আর ওই স্নেহের উৎসর্গও যে নিখাদ প্রীতিমাখা তা নিঃসন্দেহে সত্যি। তাঁর ঔদার্য নিজেকে জাহির করতো না, যার উপর পড়তো তাকে কাছে টেনে নিতেন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, ধুতি-পাঞ্জাবির ভারিক্কি গাম্ভীর্যে ভরা ছিলো তাঁর উপস্থিতি। তাঁর সাহিত্যলোকের দীর্ঘ পদযাত্রায় সুহৃদ সহযোগী হয়েছেন অজস্র ছাত্রছাত্রী। শুনেছি, তাদের কাছে তিনি ছিলেন মজলিশি গল্পকারের ভুমিকায় অতি আপনার জন। 


বিজ্ঞাপনবিহীন ‘ধ্রুবপদ’ পত্রিকার বারোটি সংখ্যার নির্মাণ তাঁর চিন্তা চেতনার এক শ্রেষ্ঠ ফসল। সম্পাদনা, বিষয় ও লেখক নির্বাচন থেকে লেখা সংগ্রহ বার বার তার পরিমার্জন ও পুনর্লিখন করানো, প্রুফ দেখা, পত্রিকার বিপণন ইত্যাদি তিনি নিজে করতেন। এই পত্রিকার প্রথম সংখায় প্রকাশিত একটি লেখা এবং প্রতি সংখায় ‘আত্মপক্ষ’ তিনি নিজের লেখা এতে প্রকাশ করেন নি। সেখানে তিনি তরুণ থেকে তরুণতর লেখকদের দিয়ে লিখিয়েছেন। লেখক তৈরির জন্য ছিলো তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা। পত্রিকার কাজকেও তাঁর একার কাজ বলে মনে করতেন না তিনি। প্রত্যেক সংখ্যায় থাকতো ‘যাদের কাছে ঋণী’ শিরোনামে থাকতো শতাধিক নামের একটি তালিকা। সেখানে তরুণ শিক্ষক, চিত্রকর, গায়ক থেকে সরকারি কর্মীর সকলেই থাকতো প্রায় তরুণ। 


‘বাউল ফকির কথা’ বইটির জন্য তিনি পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি ও আনন্দ পুরস্কার। বইটিতে যে শিরোনামগুলি ব্যবহার করেছেন তাতে বোঝা যায় তাঁর অ্যাকাডেমিক গবেষণার মধ্যেও থাকতো জনমোহিনীর ছন্দ। তাঁর লোকসংস্কৃতি চর্চার মূল পথ ছিলো দু‘টি  -- একটি  গানের মধ্য দিয়ে দেখা, আর একটি সাংস্কৃতিক নৃতত্বের মধ্য দিয়ে দেখা। লোকসাহিত্যের ছোটো পরিসর পেরিয়ে লোকসংস্কৃতির বড় আঙিনায় ছিলো তাঁর বৌদ্ধিক পরিক্রমণ। পথ চলতে চলতে দেখা আর চেনার মধ্য দিয়ে যে ভাষ্য তৈরি হয় তা আটপৌরে, চেনাজানা, সহজ – অথচ চমৎকার কথকতায় পূর্ণ। পাঠকের কাছে তা সত্যি রোমাঞ্চকর। 


লোকজীবনের ভাষ্যকার হয়েও যিনি মোহিনী গদ্যের ভূমিকে উর্বরা করেছেন তিনিই শ্রী সুধীর চক্রবর্তী। তাঁর সৃষ্টি সহজিয়া জীবনচর্যা অন্বেষণের এক অন্যতম অভিমুখ হয়ে রইলো।  বর্জনের অহমিকায় ঋজু নন বরং  হাস্যজ্জ্বোল স্বাতন্ত্রে সমাদরণীয় শ্রী সুধীর চক্রবর্তীর চলে যাওয়া বাঙ্গালির বিশেষ এক যাপনধারাকে রিক্ত করে দিলো। যিনি অধীত জ্ঞানকে তরল না করেও বঙ্গসংস্কৃতির যে সুসামাজিকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন যিনি, তিনি মহাযানপন্থার অন্যতম সাধক শ্রী সুধীর চক্রবর্তী। 

Comments