প্রবন্ধ - ফরহাদ খান চৌধুরী

উত্তরের উত্তরাধিকার


কবি গদ্যশিল্পী সুবীর সরকার উত্তর ভারতের কোচবিহারের একজন সুবিদিত সংস্কৃতিজন। ব্রাত্য ও প্রাকৃতজনদের নিয়ে তার মননের গেরস্থালী। প্রকৃতি তার প্রশ্রয়। তিনি তার প্রতিটি পদচারণের চিত্র ও বিচিত্রতা সবার সামনে তুলে ধরেন নির্দিধায়। যেখানে জড়িয়ে থাকে নিষ্ঠা পক্ষপাতহীন প্রচেষ্টা আর সম্মোহনী সুদক্ষতা।
কবি জ্যোতি পোদ্দারের মাধ্যমে সুবীরের সাথে আমার সম্পর্কের নবায়ন। দেরিতে হলেও আমাদের রসায়নটা এখন ঈর্শনীয় মাত্রায় নির্ণয়মান।
'যতটা রটে তার কিছুটা তো বটে'। সুবীর এই চটি প্রবাদটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রটিয়ে দিতে জানেন তার সদর-অন্দরের আনন্দ-বেদনার শের ও স্বর। সুবীর মোটেও 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক' নন। তিনি একসাথে গেয়ে যেতে পারেন বহুমাত্রিক জীবনের গান। তার হাতে মাটি-জল, কামার-কুমোর, কৃষি-কৃষ্টি সমসমাদরে পরিচর্যা পায়। ফলে, সে চাইলেন মাথাভাঙায় জমে ওঠে বাঁশরির মেলা, সে চাইলেই ডুয়ার্সের পানবাড়িতে জ্বলে ওঠে ক্যাম্পফায়ারের আলো। তোর্সায় দুলে ওঠে দোদূল্যযান নৌকার গলুই।

সুবীরের বীরত্বের দু’একটা নমুনা

একটা দুরন্ত মহিষ।
আর মহিষের পিঠে বসেই লিখে ফেলি
অসমাপ্ত চিঠি
দূরে গোল পাতার ঘর।
ভাঙা আয়নার সামনে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন
মৈষাল
হেমন্তের বাথান।
নদীতে মায়া ভাসে।
দুরন্ত মহিষ নীরবেই শুনতে থাকে
মৈষাল বন্ধুর গান।

[মৈষাল]

সুবীরের একটি বয়ান উদ্ধৃত করছি
আমি নিয়ম করে প্রতিদিন লোকসঙ্গীত শুনি।
ঢোল বাঁশি দোতরা আমাকে জড়িয়ে ধরে।
গান আর বাজনা আমার চোখে জল এনে দেয়।
আমি নিজের মতন করে হাউ হাউ করে কাঁদি।
ছায়ায় ঢুকি। ছায়ায় ঢুকি।
লোকগান আমার শিক্ষক।
উত্তরের লোকগানের কাছে আমি ঋণী।
জীবনে অনেক ভুল করেছি।
আমার সমস্ত জীবন হয়তো ভুলেই ভরা!
আমি ভালোবাসার কাঙাল।
ভালোবাসাই আমার কাছে সব।
আমি সাধারণ মানুষ।
জীবনের খুব গভীরে ডুবে যেতে যেতে
আমি বারবার লোকগানের কাছেই পৌঁছতে চেয়েছি।
কান্না আমাকে শেখায়।
কান্না আমাকে বাঁচায়।

কবি সুবীর সরকার

সুবীর এক ক্ষণজন্মা, যে দু:খেরঝাঁপি কাঁধে করে হাসে। উত্তাল আনন্দের মধ্যেও অশ্রæসিক্ত গৃহহীন রিক্ত-নিঃস্ব বৈরাগ্যে জারিতও হয়। আবার প্রাত্যহিক জীবনের উপধারায় একফালি ভাবাবেগ নিয়ে ভোঁ-দৌড়ে নেমে পড়েন ফসলের মাঠে। ধানের শীষের কাছে রেখে আসেন তার আনত প্রণাম, শিশিরের কাছে বলে আসেন বিবশগত বিশ্রামের গল্প। বলা যায় এই হল সকলের স্বজন সুবীর সরকার যিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত জাদুকরী মায়ার আধার বিনির্মাণ করে চলেছেন 'নয় নদী ছয় ফরেস্ট'র জনপদে।

বাংলা সাহিত্যের ভূভাগ জুড়ে তার সংযোগ সক্ষমতা ঈর্শনীয়। সেই নেটওয়ার্কের আওতায় সুবীর নিয়ে আসে তার পরিপার্শ্বের অগ্রজ অনুজ সকল অনুরক্ত কবি সাহিত্যিক ও লোকশিল্পী সমাজকে।
সুবীর নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গে বিশ্বাসী নন। আনন্দভ্রণে বেরিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নাকের উপরিভাগ গভীর গর্তে পরিণত হলেও প্রাথমিক শুশ্রæষা নিয়েই বসে যায় আড্ডাআয়োজনের কেন্দ্রে। ঋষিঅনুভবে উপভোগ করতে থাকেন লোকগানের অন্ত্যজ সৌন্দর্য, কথাকলির বৈরাগ্যবিভা। সুবীরের সরলতা, সুবীরের সহজতা, সুবীরের চৈতন্যলোক তাই ভরে থাকে অলৌকিক ঐদার্যে।

সুবীর দান গ্রহণ করেন না, দান করেনও না। তিনি শুধু মিলিয়ে দেন একের সাথে অন্যের হাত। সুবীরের লোকায়ত মনের লুকায়িত বাসনা পাঠ করা সবার জন্যে যেমন সহজ নয় তেমন কঠিনও নয়। যত তল তত জলের মতো সহজ তার জীবন। কিন্তু জলের গান আর কলের গান বলেও একটা কথার চল আছে। সেখানে সুবীরের মনন ও সৃজনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাসের লাইনটা স্মরণে নেয়া যাক 'কুয়াশা হতাশা নিয়ে সরে আমি আসি নাই পৃথিবীর থেকে'।

বাংলা কবিতায় ক্রমপ্রখর একটি নক্ষত্রের নাম সুবীর সরকার। তাঁকে আমার কখনো কোচবিহারের লোকশিল্প-সংস্কৃতি-শিল্পীসহ অবহেলিত অন্ত্যজ গুনীজনদের আত্মার আত্মীয় মনে হয়। কখনো মনে হয় স্থানীয় বিবর্তনবাদের বরপুত্র। আবার কখনো কখনো এও মনে হয় সুবীর উত্তরের যোগ্যতম উত্তরাধিকার।

সুস্বাস্থ্য ও সীমাহীন নতুনত্ব নিয়ে সুবীরের মননশীল জীবন ও কর্মসৃজনী যুগ যুগ বহমান থাকবে। একান্নর পর এতটুকু প্রত্যাশা কেউ না কেউ করতেই পারে, করতেই পারি।






Comments

  1. যথার্থ আলোকপাত
    দারুণ লাগলো

    ReplyDelete

Post a Comment